শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫, ০৪:৪৪:০৩

কলমের শক্তিকে উদ্যাপন

কলমের শক্তিকে উদ্যাপন

নওশাদ জামিল : ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাড়ে ১০টা। বাংলা একাডেমি চত্বর জুড়ে উৎসবের সাজ। ঐতিহাসিক বর্ধমান হাউস ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা আমগাছের তলে ছোট-বড় কিছু স্টল। প্রতিটিতেই বই আর বই। বইমেলার চিরচেনা দৃশ্য যেন। কিন্তু তা বইমেলা নয়। বইয়ের লেখকদের নিয়ে উৎসব। শুধু লেখক-সাহিত্যিক নন, সংস্কৃতির আরো কিছু শাখা-লোকজ নৃত্য, সংগীত, চলচ্চিত্রসহ নানা কিছুর সমাবেশ। দেশ-বিদেশের যশস্বী কবি-সাহিত্যিক-অনুবাদক-নাট্যকারদের নিয়ে আয়োজিত এই উৎসবের নাম ‘ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল লিট ফেস্ট’। সাহিত্য উৎসব কি শুধুই বই বিক্রি ও লেখকদের মতবিনিময়? ঢাকা লিট ফেস্টের আয়োজকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের বক্তব্য, আন্তর্জাতিক এই সাহিত্য উৎসব আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শব্দের শক্তিকে উদ্যাপন করা। আরো সহজ করে বললে, কলমের শক্তিকে উদ্যাপন করা; শব্দের শক্তি এবং কলমের শক্তি যে পৃথিবীকে পাল্টে দিতে পারে তা লেখক-পাঠক ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে উপলব্ধি করা এবং পৃথিবীকে পাল্টে দেওয়ার নতুন পথ আবিষ্কার করা। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে লেখক-সাহিত্যিকরা যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বলেন, সবার মধ্যে তা ছড়িয়ে দিতেই রাজধানীতে শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব। তিন দিনের এই উৎসবের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘সারা বিশ্ব বাংলাদেশকে সাহিত্যসমৃদ্ধ জাতি হিসেবে চিনুক’। গতকাল বৃহস্পতিবার উৎসবের উদ্বোধনীতে অংশ নিয়ে লেখক-সাহিত্যিকরা বললেন, দেশে দেশে অস্থিরতা, জঙ্গিবাদের উত্থান, বাকস্বাধীনতা আক্রান্ত। এসব বাধা মোকাবিলা করেই মুক্তচিন্তার ধারকদের এগিয়ে যেতে হয়। যুগে যুগে কালে কালে লেখকদের এই বাধা অতিক্রম করেই সত্য ও সুন্দরের কথা বলে যেতে হয়েছে। লেখকরা নানা দেশের হলেও তাঁদের লক্ষ্য এক-মানুষের মুক্তি। সকাল থেকেই বাংলা একাডেমির সবুজ প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে ওঠে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের আনাগোনায়। নানা দেশ থেকে এসেছেন লেখকরা। বাংলাদেশের লেখক আর পাঠকদের সঙ্গে নানা আলোচনায়, উৎসবের বিভিন্ন নির্ধারিত বত্তৃদ্ধতায় অংশ নিচ্ছেন তাঁরা। গতকাল মূল আনুষ্ঠানিকতার আগেই উৎসবকে রাঙিয়ে তোলেন ঘাসফড়িং দলের শিল্পীরা। তাঁরা সাদা পোশাকে গানের সুরে শান্তির বারতা ছড়িয়ে দেন অতিথি ও দর্শকদের মনে। একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শুরু হয় মূল উদ্বোধনী পর্ব। প্রধান অতিথি হিসেবে এর উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক নয়নতারা সেহগাল। সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য দেন তিন উৎসব পরিচালক-সাদাব সায সিদ্দিকী, কাজী আনিস আহমেদ ও আহসান আকবর। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘বাংলা একাডেমি ও তার আশপাশের এ অঙ্গন বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র। এ জায়গাটিতে এই সাহিত্য সম্মেলন নতুন প্রাণের সঞ্চার করবে। সারা বিশ্বেই মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর সাহিত্য সম্মেলন হতে পারে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ।’ আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘সারা বিশ্বেই উগ্রবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ সন্ত্রাস মোকাবিলায় শেখ হাসিনার সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে। শান্তি ও সৌহার্দ্যরে প্রতি আমরা দায়বদ্ধ।’ মূল প্রবন্ধে নয়নতারা সেহগাল বলেন, ‘সাহিত্য হোক আমাদের আনন্দ উদ্যাপনের অংশ। এখানে সেটাই হচ্ছে, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। সারা বিশ্বে লেখকরা নানাভাবে আক্রান্ত। ভারতের লেখকদের চিন্তার স্বাধীনতা আজ আক্রান্ত। কিন্তু আমরা বসে নেই, আমরাও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। এখানে লেখকদের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী, অভিনেতা, সংস্কৃতিকর্মী, বিজ্ঞানীরাও রয়েছেন। মানুষের ধর্ম থাকতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না।’ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘এই উৎসব হচ্ছে মনের মিলন। এটি বাংলা ভাষা উদ্যাপনেরও উৎসব। আমরা বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের নানা প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টায় অবিরাম কাজ করে যাচ্ছি।’ স্বাগত বক্তব্যে কাজী আনিস আহমেদ বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরাই এ উৎসবের মূল লক্ষ্য। বাংলা সাহিত্যিকদের মধ্যে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে পঞ্চকবিসহ বাংলা ভাষার অনেক লেখকই উঁচুমানের সাহিত্য রচনা করেছেন। কিন্তু ইংরেজি ভাষায় তাঁদের সাহিত্যকর্মগুলো প্রকাশিত না হওয়ায় অনেকেই অন্তরালে রয়ে গেছেন। আমরা সেই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে বাংলা ভাষার লেখকদের সাহিত্যকর্ম ইংরেজিতে অনুবাদের উদ্যোগ নিয়েছি।’ উৎসবে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী হ্যারল্ড ভারমাস। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে থাকছেন ভারতের স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক নয়নতারা সেহগাল, নারীবাদী লেখক শোভা দে, ব্রিটিশ সাংবাদিক ও টেলিভিশন উপস্থাপক জন স্নো, কিউবান শীর্ষ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক হোসে ফার্নান্দেজ ইয়োস, কেনিয়ার শিশুসাহিত্যিক ও বক্তা মুথোনি গারল্যান্ড, ফিলিস্তিনি কবি ঘাসান জাকতান, ঔপন্যাসিক অমিত চৌধুরী, কবি অরবিন্দ কৃষ্ণ মেহরোত্রাসহ ১৪টি দেশের ২৫০ জন সাহিত্যিক, লেখক, কবি, সমালোচক, সম্পাদক ও প্রকাশক। থাকছেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য সাহিত্যিকরাও। উৎসবে থাকছে শতাধিক সেশন। তাতে রাজনীতি, সাহিত্য, ক্রিকেট, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন এবং জীবনযাপন নিয়ে আলোচনা করবেন অতিথিরা। গতকাল দুপুর ১২টায় মূল মঞ্চে কাজী আনিস আহমেদের পরিচালনায় ব্রিটিশ সাংবাদিক জন স্নো, ভারতীয় শিক্ষাবিদ রমাচন্দ্র গুহ এবং নারীবাদী সংগঠন ওয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা জুড কেলি বসেন ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ রাউন্ড’ প্যানেল নিয়ে। এরপর দুপুর ১টায় শুরু হয় ফারুক ওয়াসিফের সঞ্চালনায় ‘জাতীয়তাবাদের বৃত্ত ভেঙে’ শীর্ষক সেমিনার। ২টায় মূল মঞ্চে খ্যাতনামা অভিনেতা আলী যাকের এবং সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর আলোচনা করেন ‘মঞ্চ জীবন নিয়ে’। এ ছাড়া দিনব্যাপী ছিল কবিতা পাঠ, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, নৃত্য, ওয়াসাফিরি জার্নালের বাংলাদেশ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন, শিশুদের জন্য গল্প বলাসহ আরো অনেক আয়োজন। পুরো ঢাকা লিট ফেস্ট আয়োজিত হচ্ছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহযোগিতায়। এটির টাইটেল স্পন্সর ইংরেজি , প্লাটিনাম স্পন্সর সিটি ব্যাংক। অনুষ্ঠানের সার্বিক আয়োজনে রয়েছে যাত্রিক। কো-হোস্ট হিসেবে রয়েছে বাংলা একাডেমি। এ ছাড়া গোল্ড স্পন্সর হিসেবে রয়েছে ওরিয়ন ফুটওয়্যার, ইউল্যাব ও ব্র্যাক ব্যাংক। সিলভার স্পন্সর হিসেবে রয়েছে পুনর্ভা লিমিটেড ও ইগনাইট পাবলিকেশন লিমিটেড।-কালের কণ্ঠ ২০ নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে