শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৫, ০১:৫৭:৫৪

রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা ফাঁসির জন্য

রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা ফাঁসির জন্য

নিউজ ডেস্ক : বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি যেকোনো সময় কার্যকর হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক দুই মন্ত্রীর ফাঁসি কার্যকর করার জন্য সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কারাগারের চারপাশে। রাস্তায় যানবাহন চলাচল সীমিত করা হয়েছে। দুই অপরাধীর রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন খারিজ করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত এ রায়ের কপি রাতে হাতে পাওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষ সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদকে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। এর আগে দুজনের সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করেছে তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। তবে স্বজনদের এটাই শেষ সাক্ষাৎ নয়। দণ্ড কার্যকর করার আগে তাঁরা আরো একবার সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাবেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ছাড়া মুজাহিদের আইনজীবীদের একটি দল শুক্রবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেছে। রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর এই দুই মানবতাবিরোধী অপরাধী কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করার জন্য কেবল কিছুটা সময় পাবেন। তবে তাঁরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করবেন কি না তা জানা যায়নি। তাঁদের সিদ্ধান্ত জানার পরই সরকার ফাঁসি কার্যকর করার সময় নির্ধারণ করবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী দণ্ড কার্যকর করবে সরকার। মুজাহিদের আইনজীবী গাজী এস এম তামিম জানান, জামায়াতের এই নেতার সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আইনজীবী দল যাতে আজ কারাগারে মুজাহিদের সঙ্গে দেখা করতে পারে সে জন্য অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে। অনুমতি পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন গাজী এস এম তামিম। সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হলে তা হবে মানবতাবিরোধী অপরাধে তৃতীয় ও চতুর্থ ব্যক্তির ফাঁসি। এর আগে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। দুই রায় প্রকাশ : সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার জন্য করা আবেদন বুধবার খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ওই দিনই প্রকাশ্য আদালতে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদেশের কপি দেওয়ার আবেদন করলে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, রায় হবে সংক্ষিপ্ত এবং তা তাড়াতাড়ি দেওয়া হবে। এ অবস্থায় গতকাল সকালে অ্যাটর্নি জেনারেল আবারও রায়ের কপি পাওয়ার জন্য আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি আদালতকে কাদের মোল্লার রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি দেখিয়ে বলেন, ‘সে সময় আপনারা সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়েছিলেন। তাই এবারও সে রকম সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি দেওয়ার আবেদন করছি।’ জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি দেওয়া হবে না। তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রায়ের কপি দেওয়া হবে।’ এ অবস্থায় গতকাল সাকা চৌধুরীর রিভিউ অবেদন খারিজ-সংক্রান্ত ১৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় এবং মুজাহিদের বিষয়ে ২৯ পৃষ্ঠার রায় লেখা শেষ করে তাতে সই করেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও অপর তিন বিচারপতি। এরপর রায়ের কপি পাঠানো হয় আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায়। সন্ধ্যার পর ওই শাখা থেকে রায়ের কপি পাঠানো হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনাল রায়ের কপি পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রাতেই তা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেন বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে। এরপর রাতেই কারা কর্তৃপক্ষ সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদকে রিভিউ আবেদন খারিজ করার তথ্য জানিয়ে দেয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ রায়ের কপি গত রাতেই সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়। আপিলের রায়ে আইনগত ভুল ছিল না : রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেওয়া রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার রায়ে আইনগত কোনো ভুল ছিল না। এ কারণে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রায় পরিবর্তনে আদালতের হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ নেই। পূর্ণাঙ্গ রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, একাত্তরে যেসব সাধারণ ও স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে সেসব ক্ষতিগ্রস্ত নারী-শিশুর অসহনীয় যন্ত্রণা, চোখের পানি এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব থেকেই ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। রায়ে আরো বলা হয়েছে, ঘটনার গভীরতা ও অপরাধের ভয়াবহতা বিবেচনায় অপরাধীকে যথাযথ শাস্তি দেওয়া আদালতের দায়িত্ব। আর সেই দায়িত্ববোধ থেকেই দুজনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। সাকা চৌধুরী ১৯৭১ সালের এপ্রিলের পর বাংলাদেশে ছিলেন না-এটা প্রমাণ করতে গত ১৬ নভেম্বর আপিল বিভাগে পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সনদ দাখিল করেন তাঁর আইনজীবী। গত বুধবার এ বিষয়ে প্রায় এক ঘণ্টা শুনানি হয়। রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, আদালত এ বিষয় সম্পর্কে বুঝতে পারছেন না যে কেন এ ধরনের সনদ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের সময় এবং আপিল শুনানির সময় দাখিল করা হলো না। শেষ সময়ে দাখিল করা পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ সম্পর্কে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, আদালতকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলতে এ ধরনের জাল সনদ দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়া আসামিপক্ষ রায় পুনর্বিবেচনা করা যায় এমন কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেনি। আগের দেওয়া রায়ে কোনো ভুল আছে-এ ধরনের কোনো যুক্তি উপস্থাপনেও আইনজীবীরা ব্যর্থ হয়েছেন। মুজাহিদের আবেদন সম্পর্কে রায়ে বলা হয়েছে, মুজাহিদ পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপিত ছিলেন-এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সংগঠিত করেছেন, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় বদরবাহিনীতে রূপ নেয়। মুজাহিদ বদরবাহিনীরও নেতৃত্ব দেন। ইসলামী ছাত্রসংঘ ও বদরবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা তাদের অপরাধ বিবেচনা করা হয়েছে। ওদের নৃশংসতার দায় বদরবাহিনীর প্রধান হিসেবে মুজাহিদ এড়াতে পারেন না। কারাগারের চারপাশে বাড়তি নিরাপত্তা : সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর সময়ের ব্যাপার হওয়ায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চারপাশে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সীমিত করা হয়েছে রাস্তায় যান চলাচল। ব্যাপকসংখ্যক র‌্যাব ও পুলিশের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাদা পোশাকধারী সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। বিভিন্ন ভবনের ছাদেও পাহারা দিতে দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। কারাগারের মূল ফটকের সামনে মোতায়েন করা হয়েছে একটি এপিসি বা সাঁজোয়া যান। রাতে দফায় দফায় বৈঠক করেন ঊর্ধ্বতন কারা কর্মকর্তারা। কারাগারে দুই পরিবারের সদস্যরা : এদিকে রায়ের কপি প্রকাশ হওয়ার আগেই গতকাল দুপুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের সঙ্গে দেখা করেছেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সাকা চৌধুরীর স্ত্রী-সন্তানসহ ২২ জন যান দেখা করতে। পরে কারা কর্তৃপক্ষ সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী, ছেলে ফজলুল কাদের ফাইয়াজ, হুম্মাম কাদের চৌধুরী, মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী, দুই বোন জোবায়দা কাদের চৌধুরী, হাসিনা কাদের চৌধুরী, ফাইয়াজের স্ত্রী দানিয়া খন্দকার, জামাতা জাফর খান ও সাকার ভাই জামালউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ ১৫ জনকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেয়। দুপুর দেড়টার দিকে তাঁরা বেরিয়ে চলে যান। কারাগারের ভেতরে যাওয়ার আগে বা বাইরে বেরিয়ে সাকা পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি। সাকা চৌধুরী শেষ সুযোগ হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করবেন কি না জানতে চাইলে জামালউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন, ‘মার্সি পিটিশন!’ এরপর সাংবাদিকদের কোনো সুযোগ না দিয়েই দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে যান তিনি। কারা সূত্র জানায়, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সঙ্গে দেখা করতে গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে মুজাহিদের স্ত্রী তামান্না ই জাহান, ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর, আলী আহমেদ তাহজিব, আলী আহমেদ তাহকীক, মেয়ে তামান্না বিনতে মুজাহিদ, ভাই মোহাম্মদ খালেদ, পুত্রবধূ সৈয়দা রুবাইয়াজা, নাসরিন আকতার ও ফারজানা জেরিন, আত্মীয় নুরুল হুদা মাহমুদ, আ ন ম ফজলুল হাবিব সাব্বির ও ওযায়ের এম এ আকরামসহ পরিবারের ১২ জন সাক্ষাৎপ্রার্থী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে যান। পরে দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটের দিকে তাঁরা কারাগারে প্রবেশ করে কথা বলেন মুজাহিদের সঙ্গে। দুপুর ২টা ৪০ মিনিটের দিকে কারাগার থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মুজাহিদের ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর। তিনি জানান, তাঁর বাবা রাষ্ট্রের অভিভাবক রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি না তা আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানাবেন। প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মাবরুর বলেন, ‘তিনি (বাবা) বলেছেন, রাষ্ট্রপতি আমাদের রাষ্ট্রের ও জনগণের অভিভাবক। তিনি একজন আইনজীবীও। সুতরাং তাঁর কাছে আবেদন করব কি না আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেব।’ তবে মুজাহিদ আইনগত একটি বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে চান বলে জানান তাঁর ছেলে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদের ছেলে বলেন, ‘বাবা রিভিউ পিটিশন খারিজ হওয়ার কথা শুনেছেন। তবে জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে লিখিতভাবে জানায়নি বা খারিজের কপি দেখায়নি।’ মুজাহিদ সুস্থ রয়েছেন বলেও জানান মাবরুর।-কালের কণ্ঠ ২১ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে