সোমবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, ০১:৩৩:১০

খালেদা জিয়ার মুক্তিতে আরও অপেক্ষা

খালেদা জিয়ার মুক্তিতে আরও অপেক্ষা

আরাফাত মুন্না : বিদেশ থেকে এতিমদের জন্য আসা টাকা আত্মসাতের দায়ে পাঁচ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে কারাভোগী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদনের শুনানি শেষ হলেও কোনো আদেশ দেয়নি হাই কোর্ট।

গতকাল দুপুরে এক ঘণ্টার বেশি সময় শুনানি নিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ বলেছে, বিচারিক আদালত থেকে এ মামলার নথি এলে তা দেখে আদেশ দেওয়া হবে। ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তিতে অপেক্ষা আরও বাড়ল।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে আছেন তিনি। এর আগে ২২ ফেব্রুয়ারি একই বেঞ্চ খালেদা জিয়ার আপিল আবেদন শুনানির জন্য গ্রহণ করে আদেশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে বিচারিক আদালত থেকে মামলার নথি হাই কোর্টে পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছিল। গতকাল হাই কোর্টের এ আদেশের কপি বিচারিক আদালতে পৌঁছেছে। ফলে ১৫ দিনের বেঁধে দেওয়া সময়ের আরও ১৪ দিন এখনো বাকি।

নিম্ন আদালত সূত্র জানায়, হাই কোর্টের আদেশ পাওয়ার পরই নথি পাঠানোর কাজ শুরু করা হয়েছে। গতকাল আদালতে বিএনপি চেয়ারপারসনের পক্ষে উপস্থাপন করা যুক্তি দুটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান।

আর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে এতিমের টাকা আত্মসাতের ঘটনা ইতিহাসে এটাই প্রথম। অ্যাটর্নি জেনারেলের এই বক্তব্য ‘রাজনৈতিক’ বলে মন্তব্য করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। এদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার শুনানি আজ সোমবার পর্যন্ত মুলতবি করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনের মেয়াদ সে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের আবেদনে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক গতকাল এ আদেশ দেন। ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ ড. মো. আখতারুজ্জামান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি তার ছেলে তারেক রহমানসহ অপর পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেন। এ ছাড়া আসামিদের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা জরিমানা করেন বিচারক।

রায়ে বিচারক বলেন, সরকারি এতিম তহবিলের টাকা এতিমদের কল্যাণে ব্যয় না করে পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাৎ করে খালেদা জিয়াসহ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামিরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন। ওই রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর ২০ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টে আপিল করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা। পরে বৃহস্পতিবার বিষয়টি আদালতে উঠলে তখনই জামিনের আবেদন করা হয়।

বৃহস্পতিবার আপিল আবেদন শুনানির জন্য গ্রহণ করে বিচারিক আদালতের দেওয়া অর্থদণ্ড আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করে হাই কোর্ট। তবে জামিন আবেদনের কপি পেতে বিলম্বের কারণ দেখিয়ে দুদক শুনানির জন্য সময় চাইলে হাই কোর্ট রবিবার বেলা ২টায় শুনানির সময় ঠিক করে দেয়।

গতকাল শুনানিতে খালেদার পক্ষে আদালতে উপস্থিত ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রমুখ। দুদকের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান ও অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

‘মনে হচ্ছে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে’ : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি গ্রহণ করতে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ বেলা ২টা ১০ মিনিটে এজলাস কক্ষে প্রবেশ করে। কিন্তু আইনজীবীদের অতিরিক্ত উপস্থিতিতে দুই বিচারক এজলাস কক্ষ ত্যাগ করেন।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এজলাস কক্ষে প্রবেশ করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীনকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট, এমনটি হলে আমরা কীভাবে বিচারকাজ পরিচালনা করব।’ জয়নুল আবেদীন জবাবে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, এটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। এ মামলার প্রতি দেশবাসীর আগ্রহ আছে, আইনজীবীদেরও আগ্রহ আছে।’ এ সময় অপর বিচারপতি সহিদুল করিম বলেন, ‘আপনাদের উপস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।’ আদালত এ সময় বলে, ‘আপনারা ঠিক করেন, আমরা ১০ মিনিট পর আবার বসব।’

যা হলো শুনানিতে : গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি শুরু করেন। প্রথমে তিনি এ আবেদনের পক্ষে থাকা আইনজীবীদের আদালতের সামনে পরিচয় করিয়ে দেন। পরে তিনি বলেন, মূল আবেদনের শুনানি করবেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী। এরপর এ জে মোহাম্মদ আলী শুনানি শুরু করেন।

শুনানিতে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, আপিলকারী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এটা লঘু প্রকৃতির দণ্ড। কোর্টের প্রথা রয়েছে, কেউ নারী হলে এবং সাজা কম হলে আদালত জামিন দিয়ে থাকে। তিনি জামিন আবেদন থেকে খালেদা জিয়ার শারীরিক জটিলতার বিষয়গুলো তুলে ধরেন।

পরে জামিনের বিরোধিতা করে দুদকের কৌঁসুলি খুরশীদ আলম খান বলেন, আপিল বিভাগের রায় রয়েছে, এ ধরনের লঘুদণ্ডের ক্ষেত্রে দ্রুত আপিল নিষ্পত্তি করতে হবে। আর জামিনও দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, আপিলকারীর শারীরিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে জামিন চাওয়া হয়েছে। কিন্তু এর সপক্ষে কোনো মেডিকেল সার্টিফিকেট তারা আদালতে দাখিল করেননি।

এ সময় আদালত বলে, ‘তারা তো শারীরিক অবস্থার বিষয়টি এফিডেভিট আকারে দিয়েছেন। আপনি যদি অস্বীকার না করেন তাহলে ধরে নিতে হবে এটা ঠিক আছে।’ দুদকের কৌঁসুলি বলেন, ‘দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় এ মামলার আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্টের ২৬ ধারা বিবেচনায় নিয়ে ৪০৯ ধারায় সাজা দেওয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ সাবেক রাষ্ট্রদূত এ টি এম নাজিমউল্লাহর মামলার রায়ে এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।’

এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘এ বিষয়টি তো বিচারিক আদালতের আদেশের অংশে দেখতে পাচ্ছি না। যদিও বিচারক রায়ে অনেক কথাই বলেছেন।’ দুদকের কৌঁসুলি বলেন, ‘আগে তো দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। এরপর আসে দণ্ড দেওয়ার বিষয়টি।’

খালেদার গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিলের নির্দেশ : কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, চৌদ্দগ্রামে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় আটজনকে হত্যা মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ ৪৮ জনের গ্রেফতারি পরোয়ানা ২৪ এপ্রিলের মধ্যে তামিলের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। রবিবার কুমিল্লার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম জয়নব বেগম এ আদেশ দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুমিল্লার কোর্ট ইন্সপেক্টর সুব্রত ব্যানার্জি।

আদালতের সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে ২০-দলীয় জোটের অবরোধের সময় চৌদ্দগ্রামের জগমোহনপুরে একটি বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। এতে আটজন যাত্রী দগ্ধ হয়ে মারা যান, আহত হন ২০ জন। এ ঘটনায় চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই নুরুজ্জামান বাদী হয়ে ৭৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলায় খালেদা জিয়াসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ছয়জন নেতাকে হুকুমের আসামি করা হয়।

৭৭ জন আসামির মধ্যে তিনজন মারা যান, পাঁচজনকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়। খালেদা জিয়াসহ অপর ৬৯ জনের বিরুদ্ধে কুমিল্লা আদালতে তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক ফিরোজ হোসেন চার্জশিট দাখিল করেন। আদালতে ২১ জন উপস্থিত থাকায় খালেদা জিয়াসহ অনুপস্থিত অপর ৪৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিলের নির্দেশ দেন। এ মামলার পরবর্তী তারিখ ২৪ এপ্রিল। বিডি প্রতিদিন

এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে