শনিবার, ০৩ মার্চ, ২০১৮, ১২:৫৭:৪৪

ফুটপাতেই রাত কাটে যাদের

ফুটপাতেই রাত কাটে যাদের

আফরোজ ইসলাম : নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন রংপুরের বড় দর্গার মানিক দেওয়ান। কথায় কথায় ইংরেজি বলেন। মোহাম্মদপুরের একটি সেলুনে কাজ করতেন। ১২ বছরের ছেলে আর বউকে নিয়ে ভালোই চলছিল তার সংসার।

পরপর গলা আর কিডনির অপারেশনের পর কাজে অক্ষম হয়ে পড়েন। অন্যদিকে একমাত্র ছেলের চিকিৎসার জন্য বিক্রি করেছেন ভিটে মাটি, কিন্তু বাঁচাতে পারেননি। ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। ভিটে নাই, কাজের ক্ষমতা নাই বলে বউও ছেড়ে চলে গেছে। আপন বলতে তার কেউ নেই এখন। তাই নেই কোনো স্বপ্ন।

ঢাকায় থাকেন যদি কিছু করে দু-বেলা খেয়ে বেঁচে থাকা যায়। মাঝে মাঝে কাজ পায়, দু-এক বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। না হলে দিনে একবেলা মিরপুরের শাহ্‌ আলি মাজার থেকে খেয়ে আসেন। রাতে ঘুমান শাহ্‌ আলি বালিকা বিদ্যালয় মার্কেটের ফুটপাথে। মানিকের মতো প্রায় ৫০-৬০ জন অসহায় মানুষ রাত কাটান এখানে। মানিকের সঙ্গে একই বিছানা ভাগাভাগি করে থাকেন সিলেটের সোলায়মান।

তারও আপন বলতে কেউ নেই। সম্পত্তি যা ছিল তা কব্জা করে নিয়েছে মামারা। কিছু করে ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন ঢাকায়। কিন্তু নিয়মিত কোনো কাজ না পাওয়ায় ফুটপাথেই রাত কাটাতে হয় সোলায়মানকে। এমন হাজারো সোলায়মান মানিকেরা কাজের খোঁজে পাড়ি জমায় রাজধানীতে, কাজ না পেয়ে যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় ফুটপাথে।

রুটি-রুজির শহর ঢাকাতে অনেকেই আসে আশেপাশের জেলাগুলো থেকে। এদের অনেকে কাজ শেষে ফিরে যায় নিজ জেলায়। কিন্তু খরচ, সময় আর শ্রমের চিন্তা করে অনেকেই থেকে যান ঢাকাতে। যাদের কাছে থাকে না রাত কাটানোর প্রয়োজনীয় বিছানাপত্র। এসব মানুষ খোঁজে কোথায় অল্প খরচে কোনোমতে রাত কাটানো যায়। এদের অনেকেই রাস্তায় রাত কাটাতেও দ্বিধা করেন না। এদের মতোই একজন কাপড় বিক্রেতা হাবিবুর রহমান।

বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর একরামপুর। শারীরিক প্রতিবন্ধী হাবিবুর সারাদিন শহরের বিভিন্ন জায়গায় কাপড় বিক্রি করেন। কাপড় বিক্রি করে রাতে বাড়ি ফেরা কষ্টসাধ্য, রাস্তায় থাকে প্রচণ্ড যানজট। তাছাড়া খরচও অনেক। তাই রাত কাটান শাহ্‌ আলি মাজার মার্কেটের সামনে। মার্কেটের নৈশ প্রহরীদের জনপ্রতি ৪০ টাকা দিয়ে পাওয়া যায় রাত কাটানোর প্রয়োজনীয় বিছানাপত্র।

হাবিবুর রহমানের মতো যাদের রাত কাটানোর মতো নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই, নেই নির্দিষ্ট সময় তাদের অনেকেই এখানে টাকা দিয়ে রাত কাটায়। এ ছাড়া নামের সঙ্গেই ‘পথ’ শব্দটি যাদের সঙ্গে যুক্ত এমন পথশিশুদের বেশিরভাগেরই ঠিকানা ফুটপাথ। গাবতলী বাস টার্মিনালে রাত কাটায় ১১ বছরের পথশিশু বাপ্পি। বাড়ি বরিশালে। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। তাই বাড়িতে ঠাঁই হয়নি তার। মা থাকেন বিদেশে। কিন্তু কোন দেশে থাকে তা জানে না বাপ্পি। বাপ্পির সঙ্গে একই চাটাইতে রাত কাটায় শাহাদাৎ, মামুন ও জীবন। এসব পথশিশুদের অনেকেই জানে না কোথায় তাদের বাড়িঘর বা কোথায় তাদের পরিবার।

প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকাতে খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। কাজের সন্ধানে প্রতিদিন হাজার হাজার খেটে খাওয়া মানুষ পাড়ি জমায় ঢাকাতে। এ ছাড়া কোনো না কোনোভাবে নিঃস্ব হওয়া মানুষের বড় একটা অংশই কাজের সন্ধানে আসে রাজধানীতে। দু- বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা হলেও যাদের অনেকেই পারেন না মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে। তাই বাধ্য হয়েই রাস্তার পাশের ফুটপাথে, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ টার্মিনাল বা রেল স্টেশনে রাত কাটাতে হয় তাদের।

অনেকে দুই-এক রাতের জন্য রাস্তায় রাত কাটায়। আবার অনেকে বছরের পর বছর। অনেকে আবার রাস্তায় থেকেই সংসারও পেতেছেন। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, গাবতলী বাস টার্মিনাল, কমলাপুর রেল স্টেশন, গুলিস্তান, ফার্মগেট, পল্টন, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, কাকরাইল মসজিদ, হাইকোর্ট মাজারের সামনে, মিরপুর শাহ্‌ আলি মাজার এলাকায়ই বেশি দেখা যায় এসব মানুষদের। যাদের আরাম আয়েশের কোনো বালাই নেই, কোনোমতে শুধু রাতটা কাটাতে পারলেই হয়।

সরকারের কাছে এসব মানুষের নির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৪ সালের জরিপ অনুযায়ী ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা ৭২৪৭ জন। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের মতে এ সংখ্যা আরো বেশি। বাংলাদেশ আরবান স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৩ অনুযায়ী ঢাকার ভাসমান মানুষের ৪১.৯ ভাগই ঢাকা জেলার। বাকিরা আসে দেশের অন্যান্য জেলাগুলো থেকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় ভাসমান মানুষ বাড়ার জন্য এসব মানুষের কর্মবিমুখতা ও শারীরিক অক্ষমতাই প্রধান কারণ। তবে, তৃণমূল পর্যায়ে এদের পুনর্বাসন করা গেলে এই সমস্যা কমে আসবে বলে মনে করেন তারা। ঢাকায় ভাসমান মানুষ বাড়ার কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. আমিনুল হক বলেন, গ্রাম অঞ্চলে কাজ কম থাকায় কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসে এসব মানুষ।

তাছাড়া ভাসমান মানুষের মধ্যে বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে নিঃস্ব হওয়া মানুষ ও সিজেনাল কাজের সন্ধানে আসা মানুষের সংখ্যাও কম না। তিনি বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা, কারিগরি শিক্ষার অভাব ও শারীরিক অক্ষমতা এসব মানুষকে ফুটপাথে থাকতে বাধ্য করছে। তবে, তিনি এসব মানুষের নিয়মিত কাজ করতে অনীহা ও ভিক্ষাবৃত্তিতে আগ্রকেই ভাসমান মানুষের সংখ্যা না কমার জন্য দায়ী বলে মনে করেন।

ঢাকার পরিবেশ ঠিক রাখতে এসব ভাসমান মানুষের সংখ্যা বাড়তে দেয়া উচিৎ নয় বলে মনে করেন আমিনুল হক। ভাসমান মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনতে সরকারের পাশাপাশি নগরবাসীরও দায়িত্ব নেয়া উচিৎ বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, ভবিষ্যতে এসব মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনতে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন নিশ্চিত করতে সরকারকে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া উচিৎ।

এক্ষেত্রে বিভিন্ন ফান্ড তৈরি করে উপজেলা পর্যায়ে পুনর্বাসন ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তবে, শহরে রাত্রিনিবাস তৈরি করে ভাসমানদের আশ্রয় দেয়াকে তিনি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন না। তিনি মনে করেন, ভাসমান মানুষদের কাজ করতে ও ভালোভাবে জীবন যাপনে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। -এমজমিন

এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে