নিউজ ডেস্ক : অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় আটক ফয়জুল হাসান শৈশবেই কওমি মাদরাসায় ভর্তি হয়েছিল। দিরাই উপজেলার তারাপাশা মাদরাসায় সপ্তম শ্রেণীর পড়ালেখা শেষ করে ভর্তি হয় ধল দাখিল মাদরাসায়। মেধাবী ছাত্র হিসেবে ফয়জুল ২০১১ সালে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে জেডিসি পরীক্ষায় জিপিএ ৩.৭৮ পাশ করে।
এরপর ২০১৪ সালের দাখিল পরীক্ষায় ফয়জুল জিপিএ ৪.৫৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। দাখিল পাশ করার পর সে কোথায় ভর্তি হয়েছে তা আর জানা যায়নি। তবে এলাকার লোকজন জানান, গত তিন চার বছর ধরে সে মাঝে মাঝে এলাকায় এসে ফেরি করে কাপড় বিক্রি করত। তার পরিবারের মধ্যে দুই চাচা আব্দুল জাহের ও আব্দুল কাহার আহলে হাদিস ধারার অনুসারী। তারা দীর্ঘদিন যাবত মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতে থাকেন ।
রোববার সকাল ১০ টায় হামলাকারী ফয়জুলের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কলিয়ার কাপন গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের একেবারে দক্ষিণে লম্বা দুটি দালান বিশিষ্ট বসতঘরের আলাদা বাড়িতে পরিবারের কোনো লোকজন নেই। সবগুলো কক্ষ তালা বদ্ধ। পাশের বাড়িটি ফয়জুলের ফুফুর বাড়ি। সেই বাড়িতে গিয়ে তার ফুফু রেহেনা বেগমের সাথে কথা বললে তিনি প্রথমে কান্নাকাটি শুরু করেন। পরে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে তিনি বলেন তবে তার ফুফু রেহেনা বেগম জানান, ৫ ভাই ও চার বোন তাদের।
ফয়জুল হাসানের পিতা হাফিজ মাওলানা আতিকুর রহমান পরিবার নিয়ে সিলেটে থাকেন। এলাকায় যিনি হাফিজ কুরেশ আলী নামেই বেশি পরিচিত। ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে হাফেজ কুরেশ আলীর। এদেও মাঝে ফয়জুল ৩য় সন্তান। ফয়জুলের বড় ভাই ভাই এনামুল হাসান বর্তমানে ঢাকায় চাকরিরত। মেঝ ভাই আবুল হাসান কুয়েত প্রবাসী। ফয়জুল হাসানের পিতা পরিবারসহ সিলেট শহরতলিতে বসবাস করেন। বছরখানেক আগে সিলেট শহরতলীর কুমারগাঁও এলাকায় শেখপাড়ায় নিজস্ব বাসা তৈরি করে তার পরিবার। এর পর থেকে এখানেই বসবাস করছিল ফয়জুল। সে নগরীতে ফেরি করে কাপড় বিক্রি করত। সিলেটে পরিবারসহ বসবাসের ফলে গ্রামের বাড়ি কলিয়ার কাপনে তার যাতায়াত কম ছিল।
কলিয়ার কাপন গ্রামের লোকজন জানান, আনুমানিক ৫ বছর আগে মাজহাববিরোধী মতাদর্শ নিয়ে কথাবার্তা বলতে গেলে মুসল্লিদের বাধায় মসজিদ থেকে বের হয়ে আসার পর আর সে আর গ্রামের বাড়িতে যায়নি।
কলিয়ার কাপন গ্রামের বাসিন্দা জগদল ইউপির সাবেক সদস্য আব্দুষ শীষ জানান, পারিবারিকভাবে ফয়জুলের দাদা এলাকায় একজন ভালো লোক হিসেবে সবাই জানত। ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে মতো ভিন্নতার কারণে ফয়জুল হাসানের আপন চাচা জাহার মিয়াকে ভাতিজার মতো গ্রামের মসজিদ থেকে বের করে দিয়েছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। বর্তমানে জাহার কুয়েতপ্রবাসী।
গ্রামের বাসিন্দা যুবলীগ নেতা লুৎফুর রহমান চৌধুরী জানান, জাহারের পথ ধরেই ভাতিজা ফয়জুল তার মতাদর্শ গ্রামের মসজিদে প্রচারনার চেষ্টা চালায়। আমরা স্বাভাবিক যে নিয়মে মসজিদে জামায়াতে নামাজ আদায় করি তারা সে নিয়মে নামাজ পড়ে না। এ নিয়ে গ্রামের মুসল্লিদের প্রবল বাধায় চাচা-ভাতিজা দুজনকেই মসজিদ আসতে নিষেধ করা হয়।
গ্রামের আরেক বাসিন্দা ইউপি আওয়ামী লীগ সভাপতি মিজানুর রহমান ছোবা মিয়া বলেন, গ্রামবাসীর বাধায় তারা চাচা ভাতিজা গ্রাম ছাড়া হওয়ার পর মাঝে মাঝে ফয়জুল লুঙ্গি গামছা বিক্রির ভান ধরে গ্রামে আসত।
কলিয়ার কাপন জাসেম মসজিদের ইমাম হাফেজ হাবিবুর রহমান জানান, আমি তিন চার বছর থেকে এ মসজিদে ইমামতি করছি। শুনেছি ফয়জুল হাসান ও তার দুই চাচা মাজহাববিরোধী প্রচারণা চালালে সুন্নি মতাবলম্বী মুসল্লিরা তাদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করেন। এরপর তারা আর নামাজ পড়তে আসেনি।
এদিকে অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের উপর ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হামলাকারীর ছবি ভাইরাল হলে প্রত্যন্ত হাওর এলাকা কলিয়ার কাপনে তোলপাড় শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে স্থানীয় লোকজন হামলাকারী ফয়জুল কলিয়ার কাপনের বাসিন্দা বলে শনাক্ত করেন। এলাকার একটি ছেলে একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদের উপর এমন ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনায় এলাকাবাসী প্রতিবাদ জানিয়ে রোববার দুপুর ১২ টায় কলিয়ার কাপন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
মানববন্ধনে বক্তারা ন্যাক্কারজনক ঘটনাকারী ফয়জুলের শাস্তি দাবি করে বলেন, এ ঘটনায় তার সাথে আর কারা জড়িত সে কোথা থেকে এই হামলার মদদ পেয়েছে তা উদঘাটন করে নেপথ্য নায়কদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
তারা আরো বলেন, ফয়জুল হলো কলিয়ারকাপন তথা দিরাইয়ের জন্য কলঙ্ক। দিরাই থানার ওসি (তদন্ত) এবিএম দেলোয়ার হোসেন বলেন, ফয়জুলের পিতা সিলেটে বসবাস করলেও সে মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতো। সে এলাকায় ফেরি করে কাপড় বিক্রি করত, এর বেশি আর কিছু জানা যায়নি।
র্যাব -৯ সুনামগঞ্জের একটি দল ফয়জুল হাসানের বাড়ি থেকে রোববার ভোর ৫টায় তার চাচা আব্দুল বাতিনকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন তিনি।।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস