সোমবার, ০৫ মার্চ, ২০১৮, ০২:০০:২৬

এই হামলার নেপথ্যে কারা?

এই হামলার নেপথ্যে কারা?

নিউজ ডেস্ক : জনপ্রিয় লেখক, শিক্ষাবিদ ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর ওরফে শফিকুর রহমানকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে র‌্যাব। বর্তমানে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। অবস্থার উন্নতি হলে তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ফয়জুরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), যা বর্তমানে আনসার আল ইসলামের অনুসারী বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই সে মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার উদ্দেশ্যেই হামলার কথা স্বীকার করেছে। একই সঙ্গে সে বিশিষ্ট এই ব্যক্তি সম্পর্কে তার ভ্রান্ত ধারণার কথাও জানিয়েছে।

এদিকে এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে ফয়জুরের মামা ফজলুর রহমান ও চাচা আবুল খায়েরসহ চারজনকে। ঘটনার পরপরই ফয়জুরের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে কালিয়াকাপনে বসবাসকারী তার আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। রাত ১১টার দিকে ফয়জুরের বাবা-মাকে আটক করেছে পুলিশ। এছাড়া দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে দুই পুলিশকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

জানা গেছে, ফয়জুর সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার কালিয়াকাপন গ্রামের বাসিন্দা। সে সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজারের মাদ্রাসা শিক্ষক হাফিজ আতিকুর রহমানের ছেলে। সদর উপজেলার কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ায় প্রায় তিন বছর থেকে বাবা-মা ও ভাইয়ের সঙ্গে বসবাস করে আসছে হামলাকারী ফয়জুর।

শাবি ক্যাম্পাস থেকে ফয়জুরদের বাড়ি দেড় কিলোমিটার দূরে ছয় নম্বর টুকেরবাজার ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডে। স্থানীয়দের কাছে এ বাড়িটি ‘মোল্লা’ বাড়ি নামে পরিচিত। বাড়িটির কোনো নম্বর না থাকলেও সামনের দেয়ালে ঠিকানাসহ লেখা আছে, ‘আং মুতালিব ও কাঁচা মঞ্জিল। মালিকের নাম হাফিজ আতিকুর রহমান।’

ফয়জুর সর্বশেষ সিলেটের রাজা ম্যানশনে মঈন কম্পিউটারে কাজ করত। র‌্যাবের পাশাপাশি এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাটির ছায়া তদন্ত শুরু করেছেন।

গতকাল র‌্যাব-৯ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘ফয়জুর জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাবের একটি দল কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে র‌্যাব তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এ ধরনের হামলা কেউ একা করতে পারে না। তার সঙ্গে আরও কেউ ছিল বলে আমরা ধারণা করছি। তবে জিজ্ঞাসাবাদে ফয়জুর র‌্যাবকে বলছে সে একাই এ হামলা চালিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ফয়জুর একসময় মাদ্রাসায় দাখিল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। এরপর সে আর পড়েনি। বিভিন্ন সময়ে সে বিভিন্ন স্থানে কাজ করেছে। তার সঙ্গে আর কারা জড়িত তা র‌্যাব তদন্ত করছে। হামলার ঘটনার মূল বিষয় দেখবে পুলিশ। আর পুলিশের পাশাপাশি আলোচিত এ ঘটনার ছায়া তদন্ত করবে র‌্যাব।

সিলেটের শেখপাড়ার স্থানীয় ইউপি সদস্য গিয়াস উদ্দিনসহ কয়েকজন জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে শেখপাড়ায় আসে ফয়জুর ও তার পরিবার। কয়েক বছর ধরে এখানে বসবাস করলেও আশপাশের কারও সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। শুধু পার্শ্ববর্তী মামার বাসায় যাতায়াত ছিল তার।

তারা আরও জানান, কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ফয়জুরকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তার বাবাকেও বলা হয়েছিল, ফয়জুরকে এখান থেকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু তার বাবা এ বিষয়টি আমলে নেননি।

ইউপি সদস্য গিয়াস উদ্দিনসহ অন্যরা জানান, ফয়জুর জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী কিংবা সে এরকম উগ্র মনোভাবের তা টের পাননি তারা। তবে তার গ্রামের বাড়ি দিরাইয়ে এবং সিলেটের শেখপাড়ার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই বলেছেন, ফয়জুর বুকের ওপর হাত বেঁধে নামাজ পড়ত। অনেকটা আহলে হাদিস কিংবা শিয়া মতাবলম্বীদের মতো ছিল তার এবাদত।

ওই নিয়মে নামাজ না পড়ার কারণে সে এলাকার মসজিদে নামাজ পড়ত না। স্থানীয়দের সঙ্গেও সে কোনো সম্পর্ক রাখত না। দিরাই জগদল ইউনিয়নের ধল দাখিল মাদ্রাসার সুপার ফারুক আহমেদ জানান, ধল দাখিল মাদ্রাসায় ফয়জুরের জন্ম তারিখ ৫ জুলাই ১৯৯৯ লেখা আছে। সে ২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। ২০১৪ সালে সে এই মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে। পরে কোথায় লেখাপড়া করেছে তিনি তা জানেন না।

র‌্যাব সূত্র বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফয়জুর দাবি করেছে, জাফর ইকবালের প্রতি তার দীর্ঘদিনের আক্রোশ ছিল। তিনি নাকি ইসলামের শত্রু, নাস্তিক। তিনি নাস্তিকদের প্ররোচনা দেন। সেই আক্রোশের জের ধরেই তার ওপর হামলা চালায় ফয়জুর। শেখপাড়ার তাদের বাড়ি থেকে র‌্যাব বিভিন্ন ধরনের ইসলামী বই ও বেশকিছু আলামত সংগ্রহ করেছে। সেগুলো র‌্যাবের অপর একটি দল খতিয়ে দেখছে।

মামলা দায়ের : জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা দায়ের করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত শনিবার দিবাগত মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইশফাকুল হোসেন বাদী হয়ে নগরীর জালালাবাদ থানায় মামলাটি দায়ের করেন। গতকাল মামলাটি সন্ত্রাস দমন আইনে রেকর্ড করা হয়েছে।

সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া বলেন, বর্তমানে ফয়জুর চিকিৎসাধীন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। প্রাথমিকভাবে আমরা যেসব তথ্য পেয়েছি সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

এর আগে গতকাল সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজধানীর পূর্ব রাজারবাজারে নাজনীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, ড. জাফর ইকবালের নিরাপত্তায় কোনো ত্রুটি ছিল না। তাহলে হামলাকারী ধরা পড়ত না।

চারজন আটক : ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় চারজনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনকে আটক করেছে র‌্যাব, অপরজনকে পুলিশ। আটককৃতদের মধ্যে ফয়জুরের মামা কৃষক লীগ নেতা ফয়জুল ইসলাম ও চাচা আবুল কাহার রয়েছেন। র‌্যাব জানিয়েছে, আটককৃত অপর দুজনের মধ্যে একজন কম্পিউটার ব্যবসায়ী রয়েছেন। জানা গেছে, ওই কম্পিউটার ব্যবসায়ী সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারের রাজা ম্যানশনের এম এ মঈন। এ ছাড়া আটক অপর ব্যক্তির পরিচয় তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করতে রাজি হয়নি র‌্যাব।

কে এই ফজলু :  ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টার পর ফজলুর রহমান ফজলু নামের সুনামগঞ্জ জেলা কৃষক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ককে আটকের ঘটনায় বিব্রত জেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। কৃষক লীগের এই নেতাকে আটকের খবরে তোলপাড় সুনামগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গন। কে এই ফজলু— এ নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন সবাই।

ফজলুর রহমান আহত জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর রহমানের মামা। তিন বছর আগে যুবলীগের রাজনীতির মাধ্যমে আওয়ামী রাজনীতিতে আসা ফজলু জগন্নাথপুর পৌর এলাকার শেরপুর গ্রামের হাজী আরফান উল্লার ছেলে। সম্প্রতি জেলা কৃষক লীগের নতুন যে কমিটি হয়েছে তার যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। -বিডি প্রতিদিন

এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে