রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৫, ০৩:২৪:২৪

এই প্রথম একসাথে ফাঁসি দুই মন্ত্রীর

এই প্রথম একসাথে ফাঁসি দুই মন্ত্রীর

নিউজ ডেস্ক: যে দেশের জন্ম ঠেকাতে মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্যতম ও বর্বরতম অপরাধ সংঘটন করেছিলেন, সেই স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে সদর্পে ঘুরে বেরিয়েছেন তারা। কিন্তু আইনি লড়াইয়ের সর্বোচ্চ ধাপ মোকাবেলা করেও শেষ রক্ষা হয়নি তাদের; যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত হয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হিসেবে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুললেন বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। এর আগে অন্য কোনো অপরাধে দণ্ডিত হয়েও বাংলাদেশে কোনো মন্ত্রীর ফাঁসি হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে এই দুজনকে সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হওয়ার মধ্য দিয়ে দুই আসামির আইনি লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে। প্রাণ রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন দুই যুদ্ধাপরাধী। শনিবার রাতে তাও নাকচ হলে রোববার প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একাত্তরের দুই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়; অবসান হয় একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা আর ক্ষতিগ্রস্তদের চার দশকের অপেক্ষার। ২০০১ সালে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি জোট ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী এই দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী করে। বাংলাদেশে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া প্রথম মন্ত্রীর রেকর্ডটি মুজাহিদের দখলে, ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই যে রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ওই দণ্ড কার্যকর করার ওই রায় আপিল বিভাগেও বহাল থাকে। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর সেই সময়কার অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমানও বলেছিলেন, বাংলাদেশে এর আগে কোনো মন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড হয়নি। “অবশ্য আজও কোনো মন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড হয়নি। আজ এক নিকৃষ্ট যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।” তৎকালীন কারা উপ-মহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার বলেন, “আমার জানা মতে, এটাই প্রথম সাবেক কোনো মন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড।” মুজাহিদের আগে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে কয়জন জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে, তাদের কেউ মন্ত্রী ছিলেন না। একাত্তরে ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রাদেশিক প্রধান হিসেবে আল বদর বাহিনীর নেতৃত্বে চলে আসেন মুজাহিদ। এই দলটি পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। স্বাধীনতার পর আড়ালে থাকলেও পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া মুজাহিদ পারিবারিক আবহেই সেই রাজনীতিতে যুক্ত হন, যে রাজনীতি অসাম্প্রদায়িক ধারার বিপরীত। তার বাবা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের অন্যতম সদস্য আব্দুল আলী ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির ফরিদপুর জেলা শাখার প্রধান ছিলেন। ফরিদপুর থেকে সংসদ সদস্য হতে কয়েকবার প্রার্থী হলেও একবারও ভোটে জিততে পারেননি মুজাহিদ। এরপর ২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করলে জোটসঙ্গী দল থেকে টেকনোক্রেট মন্ত্রী করেছিলেন তাকে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর চট্টগ্রামের ত্রাস সালাউদ্দিন কাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। চট্টগ্রামের রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের চার অভিযোগে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড আপিল বিভাগও বহাল রাখে। সাকা চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তান মুসলিম লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফজলুল কাদের চৌধুরী ফকা চৌধুরী নামে পরিচিত ছিলেন। ষাটের দশকে তিনি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকারও হয়েছিলেন। বাবা আদর্শ অনুসরণ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও রাজনীতি শুরু করেন মুসলিম লীগের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই মুসলিম লীগ সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। সংসদ সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সাকা চৌধুরী হিসেবে পরিচিত এই যুদ্ধাপরাধীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার গহিরা গ্রামে। মুসলিম লীগ দিয়ে শুরু করলেও পরে জাতীয় পার্টি ও এনডিপি হয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। ভাষা ও বাচনভঙ্গিমায় ঔদ্ধত্য ও তীর্যক মন্তব্যের জনবিতর্কিত এই রাজনীতিক ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সর্বশেষ ২০০৮ সালের র্নিবাচনে চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসন থেকে বিএনপির সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। সাকা চৌধুরী এরশাদের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এই দুই যুদ্ধাপরাধীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল দুজনের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে এবং ১ অক্টোবর দুই ফাঁসির আসামিকে তা পড়ে শোনায় কারা কর্তৃপক্ষ। ওই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য দুই যুদ্ধাপরাধী আপিল বিভাগে আবেদন করলেও শুনানি শেষে বুধবার তা খারিজ করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও আপিল বেঞ্চের অন্য তিন বিচারকের দেওয়া দুই রায়েই বলা হয়, আপিল শুনানির পর দেওয়া রায়ে কোনো ত্রুটি বিচারকদের নজরে আসেনি। সুতরাং দণ্ড পুনর্বিবেচনার কোনো কারণও তারা খুঁজে পাননি। দণ্ড কার্যকরের আগে দুই যুদ্ধাপরাধীর শেষ আইনি সুযোগ ছিল রিভিউ আবেদন। তা খারিজের মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়। এর মধ্যে মন্ত্রিসভার সাবেক আরও দুই সদস্য মতিউর রহমান নিজামী ও সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে প্রাণদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এদের মধ্যে জামায়াত আমির নিজামী ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারে পর্যায়ক্রমে কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। আর এরশাদ সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন কায়সার। যুদ্ধাপরাধে ফাঁসির রায়ের আগেই ১০ চট্টগ্রামে ট্রাক অস্ত্র আটকের মামলায় নিজামীর মৃত্যুদণ্ড হয়। ওই মামলায় তার সঙ্গে বিএনপি নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় চট্টগ্রামের একটি আদালত। ২২ নভেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২০১৫/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে