রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৫, ০৬:৩০:৩৬

ঘাতকের ক্ষমা নেই

ঘাতকের ক্ষমা নেই

নিউজ ডেস্ক: শনিবার মধ্য রাত। কোটি কোটি মানুষের চোখ টিভির পর্দায়। কখন দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী বিএনপির প্রভাবশালী নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। রাত ১টা ৫ মিনিটে সবগুলো টিভি চ্যানেলে ঘোষিত হলো প্রত্যাশিত সেই সংবাদ : রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে সাকা ও মুজাহিদকে একসঙ্গে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এই সংবাদে উল্লাসে ফেটে পড়ল কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সমবেত শত শত মানুষ। শাহবাগে 'গণজাগরণ মঞ্চে'র কর্মীরা গভীর উল্লাসে মেতে উঠল। সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি একসঙ্গে দেওয়া হয়েছে এ তথ্য নিশ্চিত করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। দুই খুনি অপরাধ স্বীকার করে শেষ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি তাদের ক্ষমা করতে পারেননি। কারণ তিনি জানেন, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করেনি, জনগণও ক্ষমা করেনি। তাদের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। অবশ্য সাকা ও মুজাহিদের পরিবার দাবি করেছে, তারা দুজন কেউই ক্ষমাভিক্ষা করেননি। লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে সাকা-মুজাহিদের কটূক্তি বিষিয়ে তুলছিল মানুষের মন। একাত্তরের গণহত্যার সেই ভয়ঙ্কর খলনায়কদের গাড়িতে যারা জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিল তারাও কম অপরাধ করেনি। গতকাল রাতে কারাগার সূত্র নিশ্চিত করেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কুখ্যাত দুই যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত ফাঁসির মঞ্চে পরপর দু'জনের দণ্ড কার্যকর করা হয়। এই প্রথম একসঙ্গে শীর্ষ দুই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো। এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধে বিএনপির কোনো শীর্ষ নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হলো। বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের আমলের সমাজকল্যাণমন্ত্রী মুজাহিদ ২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে দম্ভ করে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। অতীতেও কোনো যুদ্ধাপরাধী ছিল না।' স্বাধীনতা যুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বারবার দম্ভোক্তি ও কটাক্ষ করেন সাকাও। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর রায় ঘোষণার পর সাকা বলেছিলেন, 'যুদ্ধে ৩০ লাখ লোক মারা গেছে তো, লেইখ্যা দিলেই হয় তার মধ্যে ২০ লাখ আমি মারছি। এই রায় বেলজিয়াম থেকে এসেছে।' মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে তাদের দম্ভের চূড়ান্ত পতন হলো। গতকাল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার জন্য আবেদন করেন শীর্ষ দুই যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় হয়ে তা যায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দপ্তরে। দুই যুদ্ধাপরাধীর প্রাণভিক্ষার আবেদন নিয়ে আইন সচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিব এক ঘণ্টা বঙ্গভবনে ছিলেন। রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করেন। এর আগে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী প্রাণভিক্ষার আবেদন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়। মধ্যরাতে সাকা ও মুজাহিদকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানোর পর চিকিৎসক পরীক্ষার পর মৃত্যু নিশ্চিত করেন। ময়নাতদন্তসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে সাকার মরদেহ পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের রাউজানে। আর মুজাহিদের মরদেহ পাঠানো হয় ফরিদপুর সদরের পশ্চিম খাবাসপুরে। তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী নিজ নিজ গ্রামে তাদের দাফন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ফাঁসির রায় কার্যকর করার ঐতিহাসিক মুহূর্তের খবর জানতে দেশ-বিদেশের কোটি কোটি বাঙালি সরাসরি টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখেন। সন্ধ্যার পর থেকেই রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে যান চলাচল কমে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করা হয় দোকানপাট। কারাগারের বাইরে র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা নিরাপত্তাব্যুহ তৈরি করেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সতর্ক অবস্থান নেয় বিজিবি-পুলিশ-র‌্যাব। রায় কার্যকরের খবর ছড়িয়ে পড়লে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। আনন্দ মিছিল হয়েছে চট্টগ্রামের রাউজান, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। মিষ্টি বিতরণ করা হয় বহু স্থানে। কারা সূত্র জানায়, স্বজনদের সাক্ষাৎ শেষে রাতে সাকা-মুজাহিদকে গোসল করানো হয়। এরপর তারা নামাজ আদায় করেন। কেন্দ্রীয় কারা মসজিদের ইমাম মনির হোসেন তাদের তওবা পড়ান। এরপর ফাঁসির মঞ্চে নেওয়া হয়। প্রথা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর কবীর তার হাতে রাখা একটি রুমাল মাটিতে ফেললে একজন জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের লিভার (লোহার তৈরি বিশেষ হাতল) টান দেন। এতে সাকা ও মুজাহিদের পায়ের নিচ থেকে কাঠের পাটাতন সরে যায়। কার্যকর হয় ফাঁসি। ২০ মিনিট ঝুলে থাকার পর তাদের ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানো হয়। ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে একাধিক দফায় চিকিৎসক তার শারীরিক পরীক্ষা করেন। সূত্র জানায়, ফাঁসি কার্যকরের সময় কেন্দ্রীয় কারাগারে উপস্থিত ছিলেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইফতেখার উদ্দিন, ঢাকা জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন, অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল ফজলুল কবীর, ডিবির ডিসি শেখ নাজমুল আলম, সিভিল সার্জন এম এ মালেক, কারা চিকিৎসক বিপ্লব কান্তি রায়, দুই ম্যাজিস্ট্রেট ও ইমাম মনির হোসেন। আগের ঘটনা: গত বুধবার সাকা ও মুজাহিদের করা ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেন আদালত। বৃহস্পতিবার বিকেলে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রাতে তা পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বৃহস্পতিবার রাতে সাকা-মুজাহিদকে রায় পড়ে শোনানোর পর প্রাণভিক্ষার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত গতকাল শনিবার রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ। গতকাল দুপুরে সাকা-মুজাহিদের প্রাণভিক্ষার আবেদন কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এরপর তা প্রাথমিক যাচাইয়ের পর আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয় তা পাঠায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে। এরপর রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ পরামর্শ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। এরপর সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করেন তিনি। তবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন দুই যুদ্ধাপরাধীর পরিবারের সদস্যরা। জামায়াতও বিবৃতি দিয়ে জানায়, মুজাহিদের প্রাণভিক্ষার খবরটি বিভ্রান্তিকর ও অসত্য। এর আগে দুই যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি। রিভিউ আবেদন খারিজের পর সাকা-মুজাহিদের সামনে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া-না চাওয়ার বিষয়টি বাকি ছিল। গতকাল সকাল সোয়া ৯টার দিকে দু'জন ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন। তারা এক ঘণ্টা আলাদাভাবে সাকা-মুজাহিদের সঙ্গে প্রাণভিক্ষার চাওয়া-না চাওয়ার ব্যাপারে কথা বলেন। এ সময় দুই যুদ্ধাপরাধী স্বাভাবিক আচরণ করেন। এর কিছু পরই সাকা একাত্তরে তার কৃতকর্মের জন্য 'ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে' দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। মুজাহিদও পৃথকভাবে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। জেলকোড অনুযায়ী কোনো আসামিকে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কে দোষ স্বীকার করেই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে হয়। এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দু'জনই প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন। তারা প্রাণভিক্ষার আবেদন ছাড়া আর কিছু পাঠাতে পারেন না। কারা ফটকে সাকা পরিবার: রাতেই 'শেষ সাক্ষাতের' জন্য ডাক পড়ে সাকার স্বজনদের। কারা কর্তৃপক্ষ ফোন করে সাকার সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। সাকা পরিবারের ১৮ জন সদস্য রাত ৯টার দিকে কারা ফটকে যান। তাদের মধ্যে ছিলেন সাকার স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী, দুই ছেলে ফাইয়াজ কাদের ও হুম্মাম কাদের চৌধুরী, পুত্রবধূ তানিয়া খন্দকার, মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী, জামাতা জাফর খান, সাকার দুই ভাই গিয়াস কাদের ও জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরী, দুই বোন জুবায়দা মনোয়ারা ও হাসিনা কাদের চৌধুরী, সাকার ভাবি সেলিনা কাদের চৌধুরী, ভাগি্ন মাহবুবা চৌধুরী, শ্যালক হুম্মান আহমেদ কাদের, ভাতিজা সাকিব কাদের চৌধুরী এবং চাচাতো ভাই ইকবাল হোসেন চৌধুরী। রাতে সাকার পরিবার যা বললেন: সাকা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে তার পরিবারের সদস্যরা ১০টা ৫২ মিনিটে কারাগার থেকে বের হন। এরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন সাকা চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী। তিনি মার্সি পিটিশনের বিষয়ে বলেন, ''আমরা যখন বাবাকে মার্সি পিটিশনের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছি তখন তিনি বলেছেন, 'এই বাজে কথা তোমাদের কে বলেছে? আমি কোনো মার্সি পিটিশন করিনি।'' সাকার ছেলে আরও বলেন, 'এই সরকার এখন অনেক কাগজই বের করবে। তারা যেহেতু তাকে (সাকা) নির্বাচনে হারাতে পারেনি, তাই হয়তো একটু পর প্রাণ নেবে।' মুজাহিদের পরিবারের ২৫ সদস্য: শেষ সাক্ষাতের জন্য রাত ১০টা ২২ মিনিটে মুজাহিদের পরিবারের ২৫ সদস্য কারাগারে প্রবেশ করেন। তারা হলেন- মুজাহিদের ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর, মেয়ে তামরিনা বিনতে মুজাহিদ, স্ত্রী তামান্না ই জাহান, পুত্রবধূ নাসরিন কাকলী, সৈয়দা রোফাইজা, ফারজানা জেরিনসহ ২৫ জন। তাদের সঙ্গে ছিল দুই শিশু। দুই ঘণ্টার সাক্ষাৎ শেষে রাত ১২টা ২০ মিনিটে তারা কারাগার থেকে বেরিয়ে যান। এ সময় মুজাহিদের ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর বলেন, 'আমার বাবা প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি। তিনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। ছয় ঘণ্টা কারাগারে দুই ম্যাজিস্ট্রেট: শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জেলা প্রশাসনের দুই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুশফিকুর রহমান ও তানভীর আহমেদ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন। কনডেম সেল 'রজনীগন্ধা'য় পাশাপাশি বন্দি সাকা ও মুজাহিদের কাছে তারা প্রাণভিক্ষার আবেদন চাওয়া ও না চাওয়ার ব্যাপারে জানতে চান। সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তারা এ ব্যাপারে আলাদাভাবে কথা বলেন। দুই ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে ছিলেন সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, জেলার নেছার আলম ও ডেপুটি জেলার শিরিন আক্তার। দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে খবর আসে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তারা মানবতাবিরোধী সকল অপরাধের দায় স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রাণভিক্ষার লিখিত আবেদন করেন। লিখিত আবেদন তারা ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে জমা দেন। ছয় ঘণ্টা পর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে দুই ম্যাজিস্ট্রেট কারাগার থেকে বের হয়ে মাইক্রোবাসে চলে যান। এ সময় তারা গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। প্রাণভিক্ষার আবেদন গেল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে: প্রত্যক্ষদর্শী ও দায়িত্বশীল কারা সূত্র জানায়, সাকা ও মুজাহিদের প্রাণভিক্ষার আবেদনপত্র নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার সর্বোত্তম দেওয়ান ও মো. আরিফ দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে কারা ফটক থেকে বের হন। আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে দেওয়ার পর ৩টা ২৫ মিনিটে তারা আবার কারাগারে ফিরে আসেন। দুই ডেপুটি জেলার ফেরার পাঁচ মিনিট পর কারাগার থেকে বেরিয়ে যান ঢাকা জেলা প্রশাসনের দুই ম্যাজিস্ট্রেট। সাকা-মুজাহিদের আইনজীবীদের অপেক্ষা: সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দুই আইনজীবী হুজ্জাতুল ইসলাম খান ও জাকারিয়া ইউনূছ দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আবেদনপত্র নিয়ে কারাফটকের সামনে অপেক্ষা করেন। তবে তারা কারা কর্তৃপক্ষের সাক্ষাৎ পাননি। মুজাহিদের আইনজীবী এমএম কাজী তামিম পৃথক আবেদনপত্র নিয়ে কারাফটকে গেলেও তা গ্রহণ করেনি কর্তৃপক্ষ। কারাগারের একজন কর্মকর্তা জানান, এই পর্যায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামির সঙ্গে আইনজীবীদের সাক্ষাতের সুযোগ নেই। দিনভর দুই পরিবারের তৎপরতা: সাকা ও মুজাহিদ মৃত্যুদণ্ড এড়াতে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন বলে আইনমন্ত্রী জানালেও তার সত্যতা নিয়ে সন্দিহান এই দুই যুদ্ধাপরাধীর পরিবারের সদস্যরা। সাকার ছেলে ফাইয়াজ কাদের চৌধুরী গতকাল বিকেলে কারাফটকে সাংবাদিকদের বলেন, 'ক্ষমাপ্রার্থনার খবরে আমরা বিব্রত। গণমাধ্যমে হঠাৎ দেখলাম বাবা নাকি প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছেন। আমরা তার সঙ্গে কথা বলার আগে এটা বিশ্বাস করব না।' এ সময় ফাইয়াজ কাদের চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন তার বোনজামাই জাফর খান। এর আগে শনিবার দুপুরে পৃথকভাবে সংবাদ সম্মেলন করেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। তবে ওই সময় প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি তারা। এদিকে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদেরের পরিবারের সদস্যরা রাষ্ট্রপতির কাছে একটি আবেদন নিয়ে বঙ্গভবনে যান। তাতে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে তার প্রতিবিধান চাওয়া হয়। তবে বঙ্গভবন তাদের সেই আবেদন গ্রহণ করেনি। কারাগারের আশপাশে নিরাপত্তা জোরদার: ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গতকাল সকাল থেকেই কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে এবং আশপাশে র‌্যাব-পুলিশের অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে বাড়ানো হয় নিরাপত্তা। রাতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয় বিজিবি। পুলিশের লালবাগ জোনের উপ-কমিশনার মফিজউদ্দিন আহমেদ জানান, কারাগারের নিরাপত্তায় অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। যে অভিযোগে মুজাহিদের ফাঁসি: স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। এ ছাড়া সাত নম্বর অভিযোগে ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর নির্যাতন ও গণহত্যার দায়ে আপিল বিভাগ রায়ে মুজাহিদের আপিল মঞ্জুর করে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেন। পঞ্চম অভিযোগে সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ কয়েকজনকে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে আটক রেখে নির্যাতন এবং হত্যার ঘটনায় মুজাহিদকে দেওয়া যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখা হয়। সাকা-মুজাহিদের দাফন: মুজাহিদের পরিবারের সদস্য এবং ফরিদপুর জামায়াত নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মুজাহিদের লাশ তার নিজ বাড়ি ফরিদপুর শহরের পশ্চিম খাবাসপুর এলাকার আইডিয়াল ক্যাডেট মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে দাফন করা হবে। তারা রাত সাড়ে ৯টার দিকে তার কবরের জায়গা নির্ধারণ করেন। মুজাহিদের লাশ ফরিদপুরে পৌঁছার পর এ মাদ্রাসা প্রাঙ্গণেই জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বলে তারা জানান। ফরিদপুরে ছিল কঠোর নিরাপত্তা। এদিকে সাকা চৌধুরীর লাশ দাফন করা হবে রাউজানের বকশ আলী চৌধুরী বাড়ির মসজিদের সামনে পৈতৃক কবরস্থানে ছোট ভাই সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর কবরের পাশে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্লোগানে মুখর কারা ফটক: মুজাহিদ আর সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকরের খবরে কারাফটকে 'বিজয় উৎসব' করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা '৭১-এর রণাঙ্গনের বিভিন্ন স্লোগানে মুখর করে রাখেন গোটা এলাকা। দুই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তিযোদ্ধারা স্লোগান দিতে থাকেন- 'ফাঁসি হলো/ফাঁসি হলো সাকার ফাঁসি হলো, ফাঁসি হলো/ফাঁসি হলো মুজাহিদের ফাঁসি হলো। জয় বাংলা।' জয়সূচক ভি-চিহ্ন দেখিয়ে তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। আনন্দে অনেকে চিৎকার করেন। এর আগে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা কারাফটকে অবস্থান নেন। এতে নেতৃত্ব দেন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা বিচ্চু জালাল। গভীর রাতে কারাফটক দিয়ে সাকা ও মুজাহিদের মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স বের করার সময় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তা ধাওয়া করেন। ঘৃণা প্রকাশ করেন অ্যাম্বুলেন্স ঘিরে। এ সময় বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষও তাদের সঙ্গে অংশ নেন। গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা মিছিল নিয়ে সেখানে যান। ফিরে দেখা: সর্বোচ্চ আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের ওপর শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বুধবার আবেদন দুটি নিষ্পত্তি করেন। রিভিউ আবেদন খারিজের মধ্যে দিয়ে দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর 'গলা বাঁচানোর' চূড়ান্ত আইনি লড়াই শেষ হয়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে। এরপর চলতি বছর ১১ এপ্রিল রাতে জামায়াতের আরেক নেতা কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সাকা চৌধুরী দেশ ছেড়ে পালান। এরশাদ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ-বিষয়ক উপদেষ্টা হন। মুক্তিযুদ্ধের পর আলবদর নেতা মুজাহিদ ছিলেন আত্মগোপনে। জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পেলে মুজাহিদসহ অন্য নেতারা সামনে আসেন। মুজাহিদ সমাজকল্যাণমন্ত্রীও ছিলেন।-সমকাল ২২ নভেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২০১৫/পিবি/পিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে