রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৫, ০৩:৫৬:৪৮

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবনী

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবনী

নিউজ ডেস্ক: সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, বাংলাদেশে যিনি সাকা চৌধুরী হিসেবিই পরিচিত। তার জন্ম মার্চ ১৩, ১৯৪৯- এবং ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যু বরন করেন নভেম্বর ২২, ২০১৫। তিনি ছিলেন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ এবং জাতীয় সংসদের চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে ছয় বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দণ্ডাদেশ অনুযায়ী তার ফাঁসি কার্যকর হয়। তাকে দোষী সাব্যস্ত করায় ট্রাইব্যুনালের বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর যুদ্ধের সময় নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। উচ্চআদালত ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর তার রায়ের পর্যালোচনার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। জেল কর্মকর্তাদের মতে, সালাউদ্দিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছে কৃপাভিক্ষাপত্রের আবেদন জানায়, কিন্তু তার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল; যদিও তার পরিবারের সদস্যরা এ ঘটনা স্বীকার করেন নি।সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য। প্রাথমিক জীবন: সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী চট্টগ্রামের রাউজানের ১৩ মার্চ, ১৯৪৯ সালে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম ফজলুল কাদের চৌধুরী যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ববর্তি সময়ে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের একজন স্পিকার ছিলেন এবং কয়েক দফায় পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার দুই ভাই গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী। তার দুই ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী ও ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং এক মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী। শিক্ষাজীবন: সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পাকিস্থানের সাদিক পাবলিক স্কুলে। পরবর্তীতে সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে চট্টগ্রামের সেন্ট প্লাসিড স্কুলে ভর্তি করানো হয়, সেখান থেকেই মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর পাকিস্থানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন। যদিও আদালত যুদ্ধাপরাধের বিচার চলাকালীন তার সার্টিফিকেটকে ভূয়া বলে ঘোষণা করেন। রাজনৈতিক জীবন: চৌধুরী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাংসদ ছিলেন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ সম্পর্কিত কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সাত মেয়াদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে নির্বাচনী অঞ্চল রাউজান থেকে পূণঃনির্বাচিত হন। মানবতাবিরোধী অপরাধ: ২০১০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন। প্রাথমিকভাবে তাকে বিএনপির ডাকা হরতালে গাড়ি ও এর মালিককে পোড়ানোর মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরবর্তিতে তাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ঠা এপ্রিল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের ২৩টি অভিযোগ গঠন করে। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আনীত অভিযোগগুলোর মধ্যে কিছু হলঃ ১। ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল রাউজানের মধ্য গহিরা হিন্দু পাড়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে গণহত্যা ২। ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল কুন্দেশ্বরী ওষুধালয়ের মালিক নতুন চন্দ্র সিংহাকে হত্যা। ৩। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে মিলে ৩২ জনকে হত্যা, বাড়িতে আগুন দেওয়া ও ধর্ষণের অভিযোগ ৪। ১৪ই এপ্রিল সতিশ চন্দ্র পালিত হত্যা, তার বাড়িতে আগুন ও পরিবারের সদস্যদের ধর্মান্তরে বাধ্য করা। ৫। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে মিলে বোয়ালখালির শাখাপুর হিন্দু অধ্যুষ্যিত অঞ্চলে হামলা ও ৭৬ জনকে হত্য। ৬। ১৯৭১ সালের ৪-৫ই এপ্রিল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭ জনকে অপহরণ ও এর মধ্যে ৬ জনকে হত্যা করেন। মানবতাবিরোধী মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ : ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (১) ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। চলতি বছর ২৯ জুলাই তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের রায়ে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে চারটি অভিযোগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এর সবই বহাল রাখা হয় আপিল বিভাগের রায়ে। গত ১৮ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ রায় পুনরায় বিবেচনার আবেদন খারিজ করে চূড়ান্ত রায় দেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালিয়া থানায় হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, নির্যাতন দেশান্তরকরণসহ মানবতাবিরোধী মোট ৩২টি অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। সেখান থেকে ২৩টি অভিযোগে চার্জ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগের মধ্য থেকে ১৭টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষী হাজির করে। ১৭টি অভিযোগের মধ্য থেকে তাকে ৯টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। বাকি আটটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়। ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোরে গ্রেফতার করা হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। ২০ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৪ অভিযোগ : ট্রাইব্যুনালের রায়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে যে চারটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো ৩, ৫, ৬ ও ৮ নং অভিযোগ। অভিযোগ-৩ : রাষ্ট্রপক্ষের এ অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে এবং তার নির্দেশে রাউজানের গহিরায় অবস্থিত কুণ্ডেশ্বরী কমপ্লেক্সের প্রতিষ্ঠাতা সমাজসেবক অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে পাকিস্তান আর্মি গুলি করে হত্যা করে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজেও তাকে গুলি করেন। অভিযোগ-৫ : এ অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয়, ১৯৭১ সালে ১৩ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কিছু অনুসারী নিয়ে রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেন। অভিযোগ-৬ : ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় সশস্ত্র অভিযান চালানো হয়। এ সময় ৫০ থেকে ৫৫ জন হিন্দুকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। অভিযোগ-৮ : ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার পুত্র শেখ আলমগীরসহ তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য প্রাইভেটকারে চট্টগ্রামের রাউজান থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসছিলেন। পথে হাটহাজারী থানার খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি তিন রাস্তার মোড়ে বেলা অনুমান ১১টায় পৌঁছামাত্র আসামি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে থাকা পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যরা তাদের প্রাইভেট গাড়িটি আটকিয়ে শেখ মোজাফফর আহম্মেদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে আর তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ৪ পাকিস্তানিসহ আট বিশিষ্ট নাগরিকের সাক্ষ্য দেয়ার আবেদন: সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ আবেদনের শুনানির সময় তার পক্ষে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আটজন বিশিষ্ট নাগরিকের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আবেদন করা হয়। গত ১৯ অক্টোবর আপিল বিভাগে এ আবেদন দায়ের করা হয়। পাকিস্তানের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী মোহাম্মাদ মিঞা সুমরো, পাকিস্তানের সাবেক রেলমন্ত্রী ইসহাক খান খাকওয়ানি, ডন মিডিয়া গ্রুপের চেয়ারপারসন আম্বার হারুন সাইগাল, স্থপতি মুনিব আরজামান্দ খান, ভিকারুননিসা নূনের নাতি ফিরোজ আহমেদ নূন, ফিজিতে দায়িত্ব পালনকারী আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত ওসমান সিদ্দিক, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি শামীম হাসনাইন এবং বিচারপতি শামীম হাসনাইনের মা জিনাত আরা বেগম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আবেদন করেন। তবে গত ১৬ নভেম্বর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ আবেদনের সাথে আটজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। দন্ড: ১লা অক্টোবর ২০১৩ তারিখ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল চৌধুরীকে ২৩টি মামলার মাঝে হত্যা, নির্যাতন, গণহত্যা ইত্যাদির মোট নয়টি মামলায় দোষী প্রমানিত হওয়ায় ফাঁসির আদেশ প্রদান করে। তার রাজনৈতিক দল বিএনপি অভিযোগ করে যে, এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে তার পক্ষ থেকে আপিল করা হলে আপিলের রায়ে ২০১৫ সালের ১৮ই নভেম্বর একটি অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়া হলেও অন্য অপরাধের জন্য ফাঁসির সাজা বহাল থাকে। ২১শে নভেম্বর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও অপর দন্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ কারাকর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নিকট প্রাণভিক্ষার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি দুজনের আবেদনই নাকচ করে দেন। ২২শে নভেম্বর ২০১৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে তাদের দু'জনকে একই সাথে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ২২ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে