মঙ্গলবার, ২০ মার্চ, ২০১৮, ১০:৩২:৪৪

‘ভাই আমি আর কী বলব, আমার তো সব শেষ হয়ে গেল’

‘ভাই আমি আর কী বলব, আমার তো সব শেষ হয়ে গেল’

নিউজ ডেস্ক : দক্ষিণখানের হলান সড়কটি শোকে স্তব্ধ হয়ে আছে। গলির মাথায় একটি শোক ব্যানারে নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া উম্মে সালমার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করা হয়েছে। গলির ভেতর ইঞ্জিনিয়ার রায়হান আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের ভিড়। কেউ কাঁদছে, কেউ মলিন মুখে বসে আছে।

এ বাড়িতেই মেধাবী উম্মে সালমা বড় হয়েছেন। একটু পরই বাড়িতে আসবে তাঁর লাশ। একটি মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় মাত্র ৩৪ বছরেই তাঁকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হলো। স্থানীয় মধুবাগ কবরস্থানে বাবার কবরের পাশেই তাঁর কবর খোঁড়া হচ্ছে।

চোখ মুছতে মুছতে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিকিৎসক, ভগ্নিপতি ডা. ফয়েজ আহমেদ বললেন, ‘দুই বছর আগে সালমার বাবা মারা যান। পরিবার তাঁর কবরের পাশেই স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসার কবরের জায়গা নির্ধারণ করে রাখে। এ জন্য কবরের জমিও কিনে রাখা হয়। কিন্তু সেখানে মায়ের পরিবর্তে জায়গা করে নিচ্ছে মেয়ে সালমা।’

‘পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মেয়ে হওয়ায় সে ছিল সবার চোখের মণি। শিক্ষাজীবনে অত্যন্ত মেধাবী এবং ধার্মিক উম্মে সালমার এভাবে মৃত্যু আমরা কেউ মেনে নিতে পারছি না। কিভাবে এ ক্ষতি পূরণ হবে, সেটা কেউ বলতে পারছি না।’

পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবা রায়হান আলী ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন বলে মেয়েকেও ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চেয়েছিলেন। এ জন্য বুয়েটে পড়িয়েছিলেন। বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ আহমেদ ভূঁইয়ার সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন। বুয়েট থেকে পাস করার পর সালমা ইকোনমিকস ক্যাডারে বিসিএস দিয়ে সেখানেও কৃতিত্বের প্রমাণ রাখেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে আসেন। সরকারি চাকরি নেন।

সালমার ফুফাতো বোনের স্বামী মো. শাহজাহান বলেন, ‘নিয়তি বড় নিষ্ঠুর। মাত্র দুই ঘণ্টার নোটিশে সালমাকে নেপাল ফ্লাই করতে হয়েছিল। ১০টায় তাঁর হাতে সরকারি আদেশ (জিও) ধরিয়ে দিয়ে বলা হলো বেলা ১২টায় নেপাল ফ্লাইট ধরতে হবে।

পরদিনই সেখানে একটি মিটিংয়ে যোগদান করতে হবে। দুই বছর বয়সী একমাত্র মেয়েকে দাদির কাছে রেখে তাঁকে বিমানবন্দরে দৌড়াতে হয়। বিদেশ যাওয়ার সংবাদটি কাউকে জানাতে পর্যন্ত পারেননি। ইমিগ্রেশন শেষ করে অল্প সময়ে মা ও বড় দুলাভাইকে ফোনে শুধু নেপাল যাওয়ার কথা জানান।’

পরিবাগের সরকারি কোয়ার্টারে দুই বছরের সামারাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন দাদি। তিনি বলেন, ‘সালমা যেমন মেধাবী ছিল, তেমনি ছিল দায়িত্বশীল। সকালে অফিসে যাওয়ার পর তাকে জানানো হয় আজই বেলা ১২টায় তাকে নেপালে যেতে হবে। দায়িত্বশীল ছিল বলেই দুই বছরের দুধের বাচ্চাকে রেখে সে বিদেশে রওনা দিয়েছিল। কিন্তু সে আর আমাদের কাছে জীবিত ফিরে এলো না।’

বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বিয়ের ১০ বছর পর সালমার একমাত্র মেয়েটির জন্ম হয়। যার কারণে মেয়েকে সে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাকে সময় দিত। দুই সপ্তাহ আগে মেয়েকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে এসেছে। আমাদের বলেছে, আগামী ডিসেম্বরে বার্ষিক ছুটিতে সে স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে ওমরাহ হজ করতে যাবে।’

ছোট্ট সামারা এ-রুম থেকে ও-রুমে যায়। তার চোখের পাতা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। দুর্ঘটনার পর সালমার স্বামী মাসুদ নেপালে যান। প্রথম দফায় লাশ শনাক্ত না হওয়ায় তিনি দেশে ফিরে আসতে পারেননি। দ্বিতীয় দফায় লাশ শনাক্ত হওয়ার পর লাশের সঙ্গে তিনি দেশে ফেরেন। দেহ আগুনে পুড়ে যাওয়ায় লাশ শনাক্ত করতে সমস্যা হয়।

কিন্তু সালমা ছিলেন অনেক লম্বা। তাঁর দেহের বিবরণ থেকেই স্বামী এবং বড় ভাই লাশ শনাক্ত করেন। ফোনে কথা বলার সময় তিনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থান করছিলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ভাই আমি আর কী বলব। আমার তো সব শেষ হয়ে গেল।’

আর্মি স্টেডিয়ামে যৌথভাবে জানাজা শেষে আত্মীয়-স্বজনের কাছে সবার লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর হলান ইসলামবাগের বাবার বাড়িতে সালমার কফিন আনা হয়। বাড়ির পাশে আল মানার একাডেমি মাঠে জানাজা শেষে তাঁকে মধুবাগ কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়। এ সময় অসংখ্য লোক সমাবেত হয়ে সালমার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে।

এমটিনিউজ২৪/এম.জে/ এস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে