মঙ্গলবার, ২৭ মার্চ, ২০১৮, ০৯:১৯:৫৫

যে কারণে হঠাৎ ঢাকায় আসলেন ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা

যে কারণে হঠাৎ ঢাকায় আসলেন ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিমসটেক-ভুক্ত দেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা প্রধানদের দ্বিতীয় বৈঠক আগামীকাল বুধবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বৈঠকে যোগ দিতে আজ মঙ্গলবার বিকালে ঢাকায় এসে পৌঁছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতার বঙ্গোপসাগরীয় জোটের (বিমসটেক) বৈঠকে এ অঞ্চলের সামগ্রিক নিরাপত্তার স্বার্থে সহযোগিতা জোরদারের বিষয় গুরুত্ব পাবে। রাজধানীর একটি হোটেলে এক দিনের রুদ্ধদ্বার বৈঠকটি হবে। গত বছরের মার্চে দিল্লিতে নিরাপত্তা প্রধানদের প্রথম বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা নিয়ে বৈঠকে পর্যালোচনা করা হবে।

গত বছরের গত বছরের ২১ মার্চের ওই বৈঠকে আইন প্রয়োগকারী, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা, সমন্বয়ের উন্নতি ও সক্ষমতা বাড়িয়ে সহিংস চরমপন্থা ও মৌলবাদের বিস্তার রোধ করার জন্য জোটবদ্ধভাবে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সব দেশ রাজি হয়। এ ছাড়া অন্তর্জাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি ফোরাম গঠনের মাধ্যমে সহযোগিতা বাড়াতেও সদস্যদেশগুলো সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে, বিমসটেকের নিরাপত্তা প্রধানেরা বুধবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। তবে বিমসটেক বৈঠকের ফাঁকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের আলাদাভাবে কোনো বৈঠক হচ্ছে কি না, সেটি আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত জানা যায়নি।

ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই অজিত ডোভালের প্রথম ঢাকা সফর। অবশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরসঙ্গী হয়ে ২০১৫ সালের জুনে ঢাকায় আসার কথা ছিল তার। কিন্তু ওই সময়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সীমান্তের ভেতরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের তত্ত্বাবধানের জন্য ঢাকায় আসেননি অজিত ডোভাল।

কে এই অজিত ডোভাল?

১৯৮৮ সালে মে মাসের প্রথম দিক। চার বছর আগের অপারেশন ব্লু-স্টারের স্মৃতি তখনও ম্লান হয়নি। আবার স্বর্ণমন্দিরের দখল নিল খলিস্তানপন্থী সশস্ত্র জঙ্গিরা। জঙ্গিদের জন্য স্বর্ণমন্দিরের ভিতরে আটকে গিয়েছেন পুণ্যার্থীরা। এই দলে আছেন রোমানিয়ার কূটনীতিক লিভিউ রাড়ু। ভারতে তখন রাজীব গাঁধীর সরকার।

পাঞ্জাবের পুলিশ প্রধান কেপিএস গিল। সরকারের কাছে খবর ছিল, জঙ্গির সংখ্যা ৪০ জন। জবাবে ৭০০ বিএসএফ জওয়ান স্বর্ণমন্দির ঘিরে ফেলেছে। দিল্লি থেকে হাজির হয়েছে ৩০০ এনএসজি কম্যান্ডো। জঙ্গিদের সঙ্গে কথা চললেও কোনও ফল মিলছে না। যখন-তখন শুরু হতে পারে অভিযান। পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত।

এই কয়েক দিন ধরেই স্বর্ণমন্দিরের সামনে ঘুরঘুর করছিলেন এক ফেরিওয়ালা। বেঁটেখাটো চেহারা। কেউই বিশেষ লক্ষ করেনি। কিন্তু এক দিন জঙ্গিরা তাকে ভিতরে ডেকে নিয়ে গেল। কয়েক দিন পরে প্রায় সবার অলক্ষ্যে বেরিয়ে এলেন সেই ফেরিওয়ালা। না, কোনও অভিযান হল না। মে মাসের তীব্র গরমের মধ্যে স্রেফ বিদ্যুৎ আর জল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হল। কয়েক দিনের মধ্যে সুরসুর করে বেরিয়ে এল জঙ্গির দল, সোজা আত্মসমর্পণ। রক্তপাত ছাড়া দখলমুক্ত হল স্বর্ণমন্দির।

এই ফেরিওয়ালাই এখন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। ফেরিওয়ালার বেশে আইএসআই-এর গুপ্তচর পরিচয় দিয়ে জঙ্গিদের আস্থা অর্জন করেছিলেন। হাতে চাঁদ পেয়েছিল জঙ্গিরা। এ বার পাকিস্তানের সাহায্য মিললো বলে। ফলে স্বর্ণমন্দিরের ভিতরে অবাধ চলাচলের সুযোগ মেলে ডোভালের। আর তাতেই জানা যায়, ৪০ নয়, জঙ্গিরা সংখ্যায় ২৫০ জনের মতো। ফলে অভিযানের বদলে জল, বিদ্যুৎ বন্ধ করে অবরোধ শুরু হয়।

ছোটখাটো চেহারার মুখচোরা এই মানুষটি ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) প্রধান হিসেবে অবসর নেন ২০০৫ সালে। কিন্তু তার আগে এক বর্ণময় কেরিয়ার তৈরি হয়েছে তার। ১৯৪৫ সালে ইউনাইটেড প্রভিন্স, অধুনা উত্তরাখণ্ডের গারওয়ালে জন্ম। পড়াশোনা আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে। তারপরে আইপিএস হয়ে ১৯৭২ সালে সোজা আইবিতে। এরপরে একের পর এক কঠিন পরিস্থিতি সামলেছেন।

নিজের সম্পর্কে বেশি কথা বলেন না। এবং সব তথ্য বলার মতোও না। যা মেলে সেটুকু ডোভালের কেরিয়ারের আভাস মাত্র। ১৯৬৬ সালে থেকে মিজোরামে শুরু হয়েছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। নেতৃত্বে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ)। কেরিয়ায়ের শুরুতেই গা-ঢাকা দিয়ে কাজ শুরু করেন ডোভাল। অচিরেই এমএনএফ-এর পাঁচ-ছ’জন নেতার আস্থা অর্জন করে তাদের আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। ফল আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে।

ডোভালের চাকরি জীবনের বড় অংশ কেটেছে কাশ্মীর সমস্যা সামলাতে। ঠিক এখন যেমন সামলাচ্ছেন। আইবির কাশ্মীর গ্রুপ-এর (‘কে’ গ্রুপ) নেতৃত্ব দিয়েছেন ডোভাল। এখানে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতি নিয়ে কাজ করেছেন। জঙ্গি নেতাদের দলে টেনে জঙ্গি দমনের কাজ করেছেন। সে কাজের জন্য প্রচুর দুর্নামও কুড়িয়েছেন। এবারেও পরিস্থিতির অবনতির জন্য হুরিয়ত নেতাদের অনেকে সরাসরি ডোভালের দিকে আঙুল তুলেছেন। আঙুল তুলেছে বিরোধী দল কংগ্রেসও। কিন্তু ডোভাল অবিচল।

অবিচল না থাকলে প্রায় সাত বছর পাকিস্তানে আত্মগোপন করে থাকা যায় না। নিজের মুখেই সেই আত্মগোপনের কথা জানিয়েছিলেন ২০১৪ সালের নভেম্বরে। এমনিতে সাবলীল উর্দু বলতে পারেন ডোভাল। ফলে পাকিস্তানে মিশে যেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হিন্দু প্রথা মেনে ছোটবেলায় কানে ফুটো করা হয়েছিল। সেই চিহ্ন মেটাতে প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছিলেন ডোভাল। কিন্তু সাত বছর পাকিস্তানে কী করছিলেন?

না, এ সম্পর্কে স্বভাবতই নীরব ডোভাল। কিন্তু সূত্র বলে, পাকিস্তানের পারমাণবিক গবেষণার গোপন তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডোভাল। বর্ণময় কেরিয়ারে মিলেছে পুলিশ মেডেল, প্রেসিডেন্ট মেডেল, কীর্তিচক্র। আর এই সব নিয়ে ডোভালকে ঘিরে তৈরি হয়েছে মিথের বলয়। এখন সংবাদমাধ্যমে ডোভালকে ‘০০৭’ বলেও উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু ডোভালের বড় গুণ মাথা ঠান্ডা রাখা। তাই ব্যর্থতাতেও অবিচল থাকেন।

কাঠমাণ্ডু থেকে ছিনতাই করা আইসি-৮১৪-র যাত্রীদের মুক্ত করার জন্য মাসুদ আজহারকে ছাড়তে বাধ্য হয় ভারত। বিমানে মাসুদ আজহারকে সঙ্গে নিয়ে যান তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা। সেই বিমানে ছিলেন ডোভালও। এত বড় বর্থ্যতার পরে যে কেউ ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু পরিচিতদের বয়ানে জানা যায়, পরের দিন একটি পার্টিতে যথারীতি প্রিয় পানীয় নিয়ে মশগুল ছিলেন ডোভাল।

পাঠানকোটে বিমানসেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হানার সময়ে পরিস্থিতি সামলানোর দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন ডোভাল। তার নির্দেশে পৌঁছে গিয়েছিল এনএসজি। কিন্তু পরিস্থিতি সামলানোর বদলে জটিল হয়ে ওঠে। সরে দাঁড়ান ডোভাল। ডোভালের ভাবনা (ডোভাল ডকট্রিন) হল এই রকম পরিস্থিতিতে নীতি নির্ধারণ শুধু সামরিক নেতৃত্বের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।

আইবি থেকে অবসর নেওয়া পরে ২০০৯ সালে বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন তৈরি করেন ডোভাল। এমনিতে নয়ডার বাড়িতে বইয়ের পাহাড়ের মধ্যে বাস করেন ডোভাল। প্রবল ধূমপায়ী। বিশেষ লোকজন পছন্দ করেন না। তবে কোনও বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পেলে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মন দিয়ে কথা শুনবেন। অনেকের মতে, ঠান্ডা মাথার জন্যই ডোভালকে বেছে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।

অনেকের মতে মোদি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই ডোভালের পরামর্শ নিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক থেকে অন্তর্দেশীয়— ডোভালের মত মোদির নীতি নির্ধারণে বেশ গুরুত্ব পায়। তা ছাড়া ডোভালের কড়া ধাঁচের নীতির সঙ্গে মোদির ভাবনা বেশ খাপও খায়। যা নিয়ে ভারতের মন্ত্রী পরিষদের অন্য সদস্যদের আপত্তির কথা কানাঘুষোয় শোনা যায়।

ডোভালের মত মেনে কাশ্মীর আন্দোলন কড়া হাতে দমন করা নিয়েও ভারতের মন্ত্রী পরিষদে মতভেদ রয়েছে। এরপরেও ডোভাল অবিচল। জম্মু-কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে সার্জিক্যাল আক্রমণের পরিকল্পনার অন্যতম কাণ্ডারী ডোভাল। তবে ডোভালই যে ভারতের এ যাবৎকালের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নিরাপত্তা উপদেষ্টা তা নিয়ে প্রায় কারও দ্বিমত নেই।

এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে