মঙ্গলবার, ০৩ এপ্রিল, ২০১৮, ১০:৩৮:৫৫

ঘরে ঘরে গ্যাস বোমা! তাই সাবধান হোন : সানি ছানোয়ার

ঘরে ঘরে গ্যাস বোমা! তাই সাবধান হোন : সানি ছানোয়ার

সানি ছানোয়ার: আপনি হয়তো জানেনই না যে, আপনার প্রিয় বাসাটি একটি বড় 'গ্যাস চেম্বার বা বোমায়' পরিণত হয়ে আছে। এই বোমাটি একটি ইলেক্ট্রিক স্পার্কিং কিংবা যুতসই থার্মাল সোর্স (আগুন) পেলেই বিস্ফোরিত হয়ে কেড়ে নিতে পারে আপনার পুরো পরিবার।

অবাক হচ্ছেন? না, অবাক হবেন না। কারণ, এ দেশের বর্তমান ত্রুটিপূর্ণ নগর ব্যবস্থার অসংখ্য বাসা-বাড়ির ক্ষেত্রেই এই কথাটি প্রযোজ্য। ইদানীং কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনা থেকে বিষয়টি হয়তো অনেকের নজরে এসেছে।

কিন্তু, আমরা (বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, সিটিটিসি, ডিএমপি) দীর্ঘ ১০ বছর যাবত এই ঢাকা শহরেই প্রায় অর্ধশত বাসা, দোকান এবং অফিস কক্ষে এই ধরনের বিস্ফোরণ ঘটতে দেখেছি। এসব ঘটনায় মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়ে নিহত এবং আহত মানুষের সংখ্যা এই শহরের সন্ত্রাসী বোমা হামলায় হতাহতদের মোট সংখ্যার থেকেও অনেক বেশি।

#গত কয়েকদিন আগে পল্লবীতে একটি বাসার পানির আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভ ট্যাঙ্কে একটি বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে। এতে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয় একই পরিবারের পাঁচজন সদস্য। ইতিমধ্যে এই পাঁচজনের মধ্যে একজন নারী ও ০১ জন শিশু মারা গেছে।

রাত ২টার সময় মোমবাতির আগুনে পানির মোটর নষ্ট হয়েছে কি না তা দেখতে গেলে পানির রিজার্ভারে (ট্যাঙ্কে) জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরিত হয়। দিয়াশলাই দিয়ে মোমবাতি জ্বালাতে যাওয়া মাত্রই গ্যাস প্রজ্বলিত (Ignited) হয়ে এই বিস্ফোরণ ঘটায়।

# উপরের ঘটনার আগের রাতে ভালুকা মাস্টার বাড়ি এলাকায় একটি বিল্ডিং-এর তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে ভয়াবহ একটি বিস্ফোরণ ঘটে। এতে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়ে নিহত হয় একজন মেধাবী ছাত্র এবং হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে একই ফ্ল্যাটের আরও তিনজন ছাত্র। বাসায় বিস্ফোরক (Explosives)-এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধ্বংসের আলামত থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, বিস্ফোরণটি গ্যাস থেকেই হয়েছে।

# ২০০৯ সালে গুলশানের একটি বাসায় এরূপ একটি বিস্ফোরণের ফলে বিল্ডিংয়ের  একটি দেয়াল প্রায় ১০/১২ফুট দূরে গিয়ে একটি গাড়ির উপর পড়ে। টয়লেটে গিয়ে সিগারেট ধরাতেই এই ঘটনাটি ঘটে। এতে সেই ধূমপায়ী মারাত্মকভাবে দগ্ধ হওয়ার পর অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেয়ার পথে মারা যায়।

# ২০১১ সালের দিকে কোতোয়ালি এলাকায় একটি সেলুনে এরূপ একটি বিস্ফোরণ ঘটে

# ২০১১ সালে এলিফ্যান্ট রোডের একটি শোরুমে

# ২০১২ সালে মিরপুরের একটি বাসায়

# ২০১৩ সালে ভূতেরগলির একটি বাসায়

# ২০১৪ সালে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অফিসে

# ২০১৫ সালে হাজারীবাগে একটি টয়লেটে বসে সিগারেট ধরাতে গেলে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। অনুসন্ধান করে দেখা যায় যায় যে, বাসার টয়লেটের লাইনের একটি ছিদ্র গ্যাসলাইনের একটি ছিদ্রের সাথে কাকতালীয়ভাবে একটি জায়গায় মিশে গেছে। সেই ছিদ্র দিয়ে গ্যাস প্রবেশ করায় দু'তলার ওই টয়লেটটি একটি 'গ্যাস চেম্বার'-এ পরিণত হয়। ব্যস, যা হবার তাই ঘটে যায়।

# ২০১৮ সালে ভালুকা এবং পল্লবী ছাড়াও কুমিল্লায় একটি ঘটনা ঘটেছে। এভাবে গত ১০ বছরে প্রায় একশ'টি ঘটনা বা বিস্ফোরণ ঘটেছে।

গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের ত্রুটিপূর্ণ চুলা বা সরবরাহ লাইনের ত্রুটির কারণে গ্যাস লিকেজ হয়ে ঘরের আনাচেকানাচে তা জমে থাকে। জমে থাকা এই গ্যাস কোন আগুন কিংবা ইলেক্ট্রিক শর্ট সার্কিটের সংস্পর্শে আসা মাত্র প্রজ্বলিত (Ignited) হয়ে প্রচুর তাপ, চাপ ও শব্দের উৎপত্তি করে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। এভাবেই কিছু বুঝে উঠার আগে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে অগণিত শহুরে মানুষের প্রাণ।

এ যাবত ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাই সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ পেলেও ত্রুটিবিচ্যুতি নির্ণয় করে পুরোপুরি সচেতন করা সম্ভব হয়নি। সেই সাথে কোন সমন্নিত উদ্যোগও চোখে পড়েনি। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো তুলে ধরায় কিছু কিছু মানুষ জানলেও তা মোট নগরবাসীর তুলনায় অপ্রতুল।

ফলে অনেকের অগোচরেই একেকটি বাসা একটি ‘বৃহৎ গ্যাস বোমা'য় পরিণত হয়ে রয়ে যাচ্ছে। এতে মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে আমাদের আধুনিক, তবে ত্রুটিপূর্ণ নগর সভ্যতার অসংখ্য বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শুধুমাত্র একটু সচেতন হলেই সবাই সপরিবার সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ।

আমি কাউকে আতঙ্কিত করছি না। আবার একেবারে নিরাপদ আছেন তাও বলছি না। বরং সচেতন হতে পরামর্শ দিচ্ছি। আর করণীয় সম্পর্কে একটু ধারণা দিচ্ছি:

১. ত্রুটিমুক্ত গ্যাসের চুলা এবং মানসম্মত গ্যাস পাইপ ব্যবহার করে তা নিয়মিতভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

২. বাসার আর্কিটেকচারাল ডিজাইন প্রস্তুত করার সময় নিশ্চিত রাখতে হবে যেন পুরো বাসার আনাচ কানাচে বাতাস আবিরাম যাতায়াত (Cinstant Flow-CF) করতে পারে।

৩. বাসা দীর্ঘ সময় ধরে বদ্ধ থাকলে দরজা জানালা খুলে এয়ার ফ্লো নিশ্চিত করে বিদ্যুতের সুইচ চাপতে হবে, কিংবা চুলায় আগুন জ্বালাতে হবে।

৪. রান্নাঘরে সর্বোচ্চ পরিমাণ ভেন্টিলেশন সিস্টেম নিশ্চিত করতে হবে।

৫. বাসার ভেতর কোনো গ্যাস সিলিন্ডার রাখা যাবে না। পাইপের মাধ্যমে দূর থেকে চুলায় গ্যাস সংযোগ নিতে হবে।

৬. বাসার ইলেক্ট্রিক ওয়ারিংয়ে ভালোমানের তার ব্যবহার করতে হবে। তারের মধ্যে কোনো প্রকার জোড়াতালি থাকা যাবে না। ত্রুটিমুক্ত সুইচ ব্যবহার করতে হবে।

৭. বাসায় ত্রুটিপূর্ণ কোনো ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস না রাখাই ভালো। কেননা, ইলেক্ট্রিক এবং থার্মাল - এই দুটা ইগনিশন সোর্সই যেকোনো ত্রুটিপূর্ণ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস থেকে সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি ক্ষোদ ডিভাইসটিও বিস্ফোরিত হতে পারে। ২০১০ সালে রামপুরায় একটি মাইক্রোওয়েভ ওভেন বিস্ফোরিত হয়ে ব্যবহারকারী দগ্ধ হয়ে মারা যায়।

৮. বাসার ভেতর আবদ্ধ জায়গায় মোমবাতি জ্বালানো এবং ধূমপান করা থেকে বিরত থাকাই উত্তম।

৯. বাসার ভেতর জমে থাকা গ্যাসের অস্তিত্ব নিশ্চিত করার জন্য স্বল্পমূল্যের এক ধরনের 'গ্যাস ডিটেকশন ডিভাইস' পাওয়া যায়। সেগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে।

আপনারা সবাই সপরিবারে সুস্থ্য থাকুন এবং অন্যদের সুস্থতাও নিশ্চিত করুন।

লেখক : বিপিএম, পিপিএম (বার), অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। স্পেশাল অ্যাকশন ডিভিশন, কাউন্টার টেরোরিজিম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ডিএমপি, ঢাকা।

এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে