বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৫, ০৫:২৫:০৮

উত্তরায় জাপানি নারী হত্যার নানা রহস্য

উত্তরায় জাপানি নারী হত্যার নানা রহস্য

নিউজ ডেস্ক : রাজধানীর উত্তরায় জাপানি নারী হিরোয়ি মিয়েতাকে খুন করার পর মুসলমান পরিচয়ে দাফনের ঘটনায় একের পর এক রহস্যের সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি উত্তরার সিটি হোমস নামে একটি ডরমেটরিতে থাকতেন। সিটি হোমসের তত্ত্বাবধায়ক মারুফুল ইসলাম নিজের নানি পরিচয় ব্যবহার করে মিয়েতাকে উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের খালপাড় কবরস্থানে দাফন করেন। কবর নম্বর-৬৭। দাফনের সময় নাম দেয়া হয়েছিল হালিমা খাতুন। বয়স লেখা হয়েছিল ৭৪। তার বাসার ঠিকানা, গ্রামের বাড়ির ক্ষেত্রেও ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, অবৈধভাবে প্রায় ১০ বছর ধরে বাংলাদেশে থাকা ওই নারীর মৃতদেহ নিয়ে ঝামেলা হতে পারে; এই আশংকায় তারা ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে দাফন করেছেন। তাদের দাবি ওই নারী ডায়রিয়াজনিত কারণে ২৯ অক্টোবর মারা গেছেন। তাকে হত্যা করা হয়নি। হিরোয়ি মিয়েতার মৃত্যুর বিষয়ে পুলিশের কাছ থেকেও ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে। তারা একবার বলছেন ওই নারী অসুস্থজনিত কারণে মারা গেছেন। আবার থানায় হত্যা ও লাশ গুমের অভিযোগ এনে দণ্ডবিধির ৩০২/২০১/৩৪ ধারায় মামলা হয়েছে। ওই মামলায় ৫ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাদের প্রত্যেকের চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। হিরোয়ি মিয়েতা নিহতের ঘটনায় পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা মঙ্গলবারও কথা বলতে রাজি হননি। এ বিষয়ে মঙ্গলবার ১১টায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে প্রেস ব্রিফিং আহ্বান করে সাংবাদিকদের কাছে এসএমএস পাঠানো হয়। সাংবাদিকরা উপস্থিত হওয়ার পর দুপুর ১২টায় আবার সেটা স্থগিত করা হয়। পুলিশ বলছে, আইজিপির কাছে জাপান দূতাবাস কর্মকর্তাদের বিশেষ অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ সম্মেলনটি স্থগিত করা হয়। যুক্তি হিসেবে তারা বলছে, সামনে জাপানের জাতীয় দিবস। এ সময় একটি মৃত্যুর ঘটনা তাদের দেশে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এছাড়া জাপান দূতাবাস তাদের একজন নাগরিক (হিরোয়ি মিয়েতা) নিখোঁজের বিষয়ে ১৯ নভেম্বর উত্তরা পূর্ব থানায় জিডি করেছে। তিনি মারা গেছেন কিনা সেটাও তারা নিশ্চিত নন। বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তারা সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন। সূত্র জানায়, ১৯ নভেম্বর জাপান দূতাবাসের ভাইস কনস্যুলার কুসুকি মাৎসুনা একটি জিডি করে জানান, হিরোয়ি মিয়েতা নামে তাদের একজন নাগরিককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওই জিডিতে বলা হয়, ২৬ অক্টোবর সর্বশেষ মিয়েতা তার মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি উত্তরার সিটি হোমস নামে একটি ডরমেটরিতে থাকতেন। তার জন্ম তারিখ বলা হয়েছে ১৯৫৫ সাল। ওই জিডির পর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয় পুলিশ। ২০ নভেম্বর পুলিশ সিটি হোমসের তত্ত্বাবধায়ক মারুফুল ইসলামকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে বেরিয়ে আসে অজানা রহস্য। জিজ্ঞাসাবাদে বাড়ির কেয়ারটেকার মারুফ জানায়, নিজের (মারুফ) নানি পরিচয়ে জাপানি নারীকে ২৯ অক্টোবর দাফন করা হয়েছে। দাফনের সময় হিরোয়ি মিয়েতার নাম দেয়া হয়েছে হালিমা খাতুন। বাবার নাম মৃত শাজহান আলী মৃধা। মায়ের নাম হাজেরা বেগম। বর্তমান ঠিকানা উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর সড়কের ৪১ নম্বর বাড়িতে। গ্রামের বাড়ির ঠিকানা দেয়া হয়েছে কোর্টপাড়া, থানা অভয়নগর, জেলা যশোর। দুটি ঠিকানাই ভুয়া দেয়া হয়েছে। লাশ দাফন করা হয় মারুফের তত্ত্বাবধানে। সেখামে মারুফের জাতীয় পরিচয়পত্রের একটি ফটোকপি দেয়া হয়। সেটাও ভুয়া বলে জানা গেছে। কবরস্থানের রেজিস্ট্রারে করা স্বাক্ষরের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের স্বাক্ষরে মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া লাশ দাফনের সময় উত্তরার যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে গিয়ে হালিমা বা মারুফুল নামে কারও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। উত্তরা পূর্ব থানা পুলিশ জাপানি নারী নিহতের ঘটনায় রোববার (২২ অক্টোবর) থানায় হত্যা ও লাশ গুমের অভিযোগে খুনের মামলা করে। এই মামলায় রাশেদুল হক বাপ্পী, ফকরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর হোসেন, ডা. বিমল চন্দ্র শীল ও জাকির পাটোয়ারিকে এজহারনামীয় আসামি করা হয়েছে। তারা সিটি হোমসের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ওই নারীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এছাড়া তাদের সঙ্গে গার্মেন্ট পণ্যের স্টক লটের ব্যবসা করতেন। এই মামলায় মঙ্গলবার মারুফুল, রাশেদুল, ফখরুল, জাহাঙ্গীর ও ডা. বিমলকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করেন উত্তরা থানার ওসি আবু বকর মিয়া। জাপানি নারীকে হত্যা, মিথ্যা পরিচয়ে দাফন ও লাশ গুমের বিষয়ে তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। মহানগর হাকিম স্নিগ্ধা রানী চক্রবর্তী শুনানি শেষে আসামিদের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ডিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, জাপানি নারীর বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিবেচনা করে এ বিষয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ২০০৬ সালে তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অবৈধভাবেই বাংলাদেশে থেকে যান। আসামিরা বলছে, ওই নারীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। তবে ময়নাতদন্ত করার আগ পর্যন্ত তার মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে না। তার লাশ তুলে ময়নাতদন্তের জন্য আদালতে আবেদন জানানো হয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, মিয়েতার স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও আসামিরা অপরাধী। মিয়েতার লাশ গুম ও মিথ্যা পরিচয়ে দাফনের কারণে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে। আর ময়নাতদন্তে হত্যার প্রমাণ পাওয়া গেলে যে ধারায় মামলা হয়েছে সেটা ঠিক থাকবে। সিটি হোমসে ওই নারীর কক্ষ থেকে দুটি ল্যাপটপ, কিছু কাগজপত্র ও টাকা খোয়া যাওয়ার প্রমাণও পেয়েছে পুলিশ। এছাড়া ব্যবসায়িক কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছি কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মঙ্গলবার উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের সিটি হোমসে গিয়ে দেখা গেছে, পুরনো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তা কর্মী লুৎফর জানান, তিনিসহ ডরমেটরির প্রায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে নতুন যোগ দিয়েছেন। তারা এসব বিষয়ে কিছু জানেন না। পাশের এক ভাঙারি দোকানি জানান, জাপানি নারী আগে উত্তরার অন্য একটি আবাসিক হোটেলে থাকতেন। সিটি হোমসের মালিক ফিরোজ তাকে ওই ডরমেটরিতে নিয়ে এসেছিলেন। উত্তরা থানার ওসি আবু বকর মিয়া জানান, কেন মিথ্যা পরিচয়ে জাপানি নারীর লাশ দাফন করা হয়েছে বিষয়টি জানার জন্য ৫ আসামিকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আসামিরা জানিয়েছে, অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করায় সিটি হোমসে ডায়রিয়াজনিত কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাকে হাসপাতালে নেয়ার সাহস পায়নি। অবৈধভাবে অবস্থান করার কারণে তাকে মিথ্যা পরিচয়ে দাফনের বিষয় স্বীকার করেছে তারা। - -যুগান্তর ২৫ নভেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে