বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:৩৪:৪৭

অগ্নিপরীক্ষায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি

অগ্নিপরীক্ষায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি

শেখ মামুনূর রশীদ : পৌরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে অগ্নিপরীক্ষায় নামছে দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। প্রথমবারের মতো দলীয় মনোনয়ন এবং প্রতীকে মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন দুই দলের মাঠপর্যায়ে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের পরিমাপক হিসেবে কাজ করবে। মূলত এ কারণেই প্রধান দুটি দল এ নির্বাচনকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। অনুকূল ফল ঘরে তুলতে ভোটযুদ্ধের কর্মকৌশল সাজাচ্ছে উভয় দলের হাইকমান্ড। বসে নেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শরিকরাও। প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ বাম প্রগতিশীল ঘরানার দলগুলোও নেমেছে নির্বাচনী যুদ্ধে। অবাধে ভোট দেয়ার পরিবেশ তৈরির জন্য নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা সাত দফা সুপারিশ করেন। নির্বাচন বিশেষজ্ঞসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে বড় দুই দলের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া গেছে। তাদের মতে, জাতীয় নির্বাচনের আদলে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া পৌরসভা নির্বাচন দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির জন্যই অগ্নিপরীক্ষা। এই নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে বিএনপির জনপ্রিয়তা যাচাই হবে। একইভাবে আওয়ামী লীগকে জনগণ চায় কিনা তাও প্রমাণ হবে ভোটের হিসাবেই। সেই ভোট গ্রহণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে কিনা তা নিয়েও শংকা আছে বড় একটি অংশের মধ্যে। কেন্দ্র দখল বা ব্যালট বাক্স ছিনতাই হলে কোনো দলেরই প্রকৃত জনপ্রিয়তা বোঝা যাবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ। এজন্যই তারা বলছেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা না করা নিয়ে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকেও। জাতীয় পার্টিসহ দুই জোটের শরিক ছোট এবং মাঝারি ধরনের দলগুলোও পিছিয়ে থাকবে না। জোটের বাইরে থাকা বাম প্রগতিশীল ঘরানার দলগুলোর জনপ্রিয়তাও যাচাই হবে এই সুযোগে। নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত কেউ খুব সহজেই পার পাবে না বলে তারা মনে করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, এটি বড় নির্বাচন। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে সভা করেই সে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। তিনি বলেন, সবার জন্য নির্দেশ হচ্ছে আইনসম্মতভাবেই কাজ করতে হবে। পৌর নির্বাচনে আগের চেয়ে আরও দ্রুত অ্যাকশন নেব। ব্যালট চুরি, ছিনতাইয়ের কোনো রকম তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নেয়া হবে। রাজনৈতিক দলগুলো এ নির্বাচনকে বড় করে দেখছে। যে কারণে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিএনপি বৈঠকে বসেছে। আজ আওয়ামী লীগের বৈঠক। এসব সভায় নির্বাচন এবং প্রার্থী মনোনয়নের বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। পৌরসভা নির্বাচন ঘিরে দলগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। শেষ পর্যন্ত যাতে এ আমেজ অব্যাহত থাকে এজন্য অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বুধবার বলেন, নির্বাচন এলে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কাজ করবে। কিন্তু মূল কাজ নির্বাচন কমিশনের। যে কোনো মূল্যে নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু করার প্রত্যয় তাদের মধ্যে থাকতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য তাদের শক্ত অবস্থান নিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই কম্প্রোমাইজ করা যাবে না। তা না পারলে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে সাত দফা প্রস্তাব দিয়েছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমতল ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে শতভাগ নিরপেক্ষ আচরণ ও ভূমিকা পালন করতে হবে। মাঠপর্যায়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট যে কোনো ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহসিকতার সঙ্গে তা মোকাবেলা করতে হবে। সমস্যা সমাধানে কঠোর অবস্থান গ্রহণ এবং কোনো কেন্দ্রে অনিয়ম বা জোর জবরদস্তি দেখা গেলে তাৎক্ষণিকভাবে ওই কেন্দ্রে নির্বাচন স্থগিত করতে হবে। সরকার, প্রশাসনসহ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। দল ও প্রার্থীর দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। কালো টাকা, সন্ত্রাস এবং পেশিশক্তির প্রভাব থেকে নির্বাচনকে মুক্ত রাখতে নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধান বাস্তবায়নে শতভাগ সদিচ্ছা দেখাতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। আগামী ৩০ ডিসেম্বর দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় ভোটগ্রহণের দিন নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ৩ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ৫ ও ৬ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৩ ডিসেম্বর ধার্য করা হয়েছে। মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ পৌরসভা নির্বাচনের এ তফসিল ঘোষণা করেন। সর্বশেষ ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ২৬৯টি পৌরসভার তফসিল ঘোষণা করেছিল কমিশন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী এবার ২৩৪টি পৌরসভায় ২৩৪টি মেয়র, ৭৩৮টি সংরক্ষিত (মহিলা) কাউন্সিলর এবং ২ হাজার ৯৫২টি সাধারণ কাউন্সিলর পদে নির্বাচন হবে। এতে পুরুষ ভোটার ৩৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৬ জন এবং নারী ভোটার ৩৫ লাখ ৭৬ হাজার ৪০ জন। ভোট গ্রহণ করবেন মোট ৬১ হাজার ১৪৩ জন কর্মকর্তা। নির্বাচনী এলাকার মোট ৩ হাজার ৫৮২টি কেন্দ্রে ভোট নেয়া হবে। এরই মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণায় সদর্পে মাঠে নেমেছে শাসক দল আওয়ামী লীগ। মাঠে আছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিকরাও। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও মাঠে আছে বিএনপি প্রার্থীরা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিকরাও নেমে গেছে ভোটযুদ্ধে। উচ্চ আদালতে নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় মেয়র পদে দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না জামায়াত। তবে বিএনপি জোটের অন্যতম প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরাও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুই প্রধান দল ও জোটের বাইরে এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে নেমেছে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দলের চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এরই মধ্যে খসড়া প্রার্থী তালিকাও চূড়ান্ত করেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও সিপিবি, বাসদ, গণফোরাম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বাম প্রগতিশীল ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোও পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই দলগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীরাও আছেন ভোটযুদ্ধে। পৌরসভা নির্বাচন দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ নির্বাচন কমিশনের জন্যও বড় ধরনের পরীক্ষা বলে মনে করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বুধবার যুগান্তরকে বলেন, পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে শুরু হয়েছে ভোটের হাওয়া। মাঠপর্যায়ে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির জন্য এই নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, সুষ্ঠুভাবে পৌরসভা নির্বাচন করা ইসির জন্যও বড় বিষয়। অতীতে সিটি কর্পোরেশন এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে গিয়ে তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। পৌরসভা নির্বাচনও যদি ব্যর্থ হয়, তবে এর শতভাগ দায় ইসি’র ওপরই বর্তাবে। তাই জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি নির্বিঘ্ন এবং নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সাহসী ভূমিকা পালন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ বুধবার বলেন, দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এবারের নির্বাচনের চেহারা ভিন্ন হবে। দুই বড় দল থেকে মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হবে। সে অনুযায়ী তাদের অনুকূলে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করতে হবে। মাঠপর্যায়ে দলের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য এ নির্বাচন হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই উভয় দল নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই গ্রহণ করবে। জানা গেছে, মাঠপর্যায়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এই লড়াইয়ে জয়ী হতে এবং জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে প্রাথমিকভাবে প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়টিকেই বড় করে দেখছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নানা কারণে বিপর্যস্ত বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকেই এখনও গ্রেফতার আতংকে ভুগছেন। দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গ্রেফতারের ভয়ে অনেক নিরীহ যোগ্য প্রার্থী মাঠে নামার সাহস পাচ্ছেন না। তাদের বদ্ধমূল ধারণা ভোটের আগে সরকারি দলের প্রার্থীর পরাজয় নিশ্চিত এ ধরনের আভাস পাওয়ার পরই বিএনপির মেয়র প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হবে। পৌরসভা নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আসম হান্নান শাহ। তিনি বলেছেন, ‘সরকার তাড়াহুড়া করে পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। এতে করে আমরা একটা গন্ধ পাচ্ছি। মনে হচ্ছে অতীতের মতো তারা (সরকার) পৌরসভাগুলোও দলীয়করণ করবে। আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং নিরপেক্ষ হবে কিনা তা নিয়ে আমরা শংকায় আছি।’ বিএনপির এই নেতার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বুধবার বলেন, ‘বিএনপির নেতারা সব নির্বাচনের আগেই এ ধরনের অভিযোগ করেন। তারা সব সময় নেতিবাচক কথাবার্তায় অভ্যস্ত। এসব বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চান।’ তিনি আরও বলেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে নির্বাচনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত বিএনপি অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপন করে। কেবলমাত্র তাদের প্রার্থী জয়ী হলেই বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’-যুগান্তর ২৬ নভেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে