শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:৪৫:৫২

চরম প্রতিকূলতায় দিশেহারা জামায়াত

চরম প্রতিকূলতায় দিশেহারা জামায়াত

শেখ মামুনূর রশীদ : চরম প্রতিকূলতার আবর্তে দিশেহারা হয়ে পড়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামী। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের গ্লানি তাদের বড় বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। জ্বালাও-পোড়াও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের অধিকাংশ নেতাকর্মী হয় জেলে, না হয় আÍগোপনে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যুদ্ধাপরাধের ইস্যুতে সাম্প্রতিক সময়ে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা সামাজিকভাবে বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। কিছু রিজার্ভ ভোট থাকলেও এখন তাদের জনসমর্থনসহ সবকিছুতেই ধস নামতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহে দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর দলটির রাজনৈতিক ক্ষতির পাল্লা আরও ভারি হতে বসেছে। আর এই যখন অবস্থা, তখন আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী দলটির দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। তাই দলীয় প্রতীকে পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না দলটি। তবুও তারা খড়কুটু আঁকড়ে ধরার মতো টিকে থাকতে এখন বড়ই মরিয়া। এজন্য জোটগত নির্বাচনে জামায়াত বেশি আগ্রহী। আর এই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে দলটি তাকিয়ে আছে তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপির দিকে। তবে এখনও বিএনপির কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। শেষ ভরসা জোটের বৈঠক। তবে নানা কারণে বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে নতুন করে ঝামেলায় পড়তে চায় না। শুধু ভোটের হিস্যা চায়, কিন্তু পৌর নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে সিট ভাগাভাগি করতে চায় না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনের মতো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনেও অংশ নিতে চায় জামায়াত। এ লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৪৩টি পৌরসভায় মেয়র প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে তারা। কিন্তু এবার জামায়াতকে ছাড় দিতে নারাজ বিএনপি। দলটির (বিএনপি) একাধিক শীর্ষ নেতার মতে, ২০১১ সালের পরিস্থিতি আর এখনকার ২০১৫ সালের পরিস্থিতি এক নয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনও নেই। তারা দলগতভাবে এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচনও করতে পারছে না। তাছাড়া আগের সেই শক্তি এবং সামর্থ্যও নেই দলটির। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে দেশের বেশির ভাগ মানুষ জামায়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। নতুন প্রজন্মের ভোটারদের বিরাট অংশ জামায়াতকে ভোটও দেবে না। সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে অনেকটাই দেউলিয়া এখন জামায়াত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ। এই অভিযোগে বিচার এবং বিচার শেষে তিন শীর্ষ নেতার ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের ফলে বেকায়দায় আছে দলটি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের আরও একাধিক শীর্ষ নেতার বিচার চলছে। অনেক আগে থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ এবং দাতা সংস্থা জামায়াতের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশের বেশির ভাগ মানুষও দলটির বিপক্ষে। এমনকি বিএনপির একটি বড় অংশ এখন জামায়াতমুক্ত বিএনপি দেখতে চায়। বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রভাবশালী বেশির ভাগ দেশের অবস্থানও জামায়াতের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বৃহস্পতিবার বলেন, অনেকাংশেই একলা হয়ে যাওয়া জামায়াত রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে এবং নিজেদের প্রতিকূল অবস্থা থেকে রক্ষা করতে বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের জামায়াতবিরোধী মনোভাব এবং জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার জন্য দেশী-বিদেশী চাপের বিষয়টি মাথায় রেখে বিএনপি তাদের এই পুরনো মিত্রের সঙ্গে সখ্য রক্ষায় অনেকটাই পিছটান দিয়েছে। ওই নেতা দাবি করেন, জামায়াত স্বাভাবিকভাবে পৌরসভা নির্বাচন জোটগতভাবে করতে চাইবে। তবে এই নির্বাচনে তাদের ভালো কিছু করে দেখানোর ক্ষমতা আর নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির আরেক শীর্ষ নেতা বলেন, দুর্বলের সঙ্গে কেউ সচরাচর হাত মেলায় না। বাস্তবতা হচ্ছে, জামায়াত এখন রাজনৈতিক দল হিসেবে খুবই দুর্বল, ভঙ্গুর এবং বিপর্যস্ত। বিষয়টি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মাথায় অবশ্যই আছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় জামায়াতের প্রার্থীরা নির্বাচন করতে চাইলেও পারবেন কিনা তাও ভেবে দেখা হচ্ছে। কেননা যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে মাঠ পর্যায়ে জনমত এখন জামায়াতের শতভাগ বিপক্ষে। সাধারণ মানুষও তাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। তাই জামায়াত-শিবিরের চিহ্নিত কোনো নেতাকর্মী পৌরসভা নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর সাহস দেখাবেন কিনা- তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের কেউ কেউ বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে চাইবেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ক্ষতির কথা চিন্তা করে বিএনপি তাতে সায় দেবে না। জামায়াত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাস্তব অবস্থা, বিএনপির সিদ্ধান্ত, সাধারণ মানুষের নেতিবাচক মনোভাবসহ এ রকম নানামুখী প্রতিকূলতার মধ্যেও আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা ভাবছে জামায়াত। তাদের লক্ষ্য বিএনপির সঙ্গে থেকে জোটবদ্ধ নির্বাচন করা। তাদের কোনো কোনো নেতা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত তারা প্রার্থী হতে না পারলেও তাদের রিজার্ভ ভোট দিয়ে বিএনপিকে শক্তিশালী করতে তারা ভুল করবেন না। কেননা বিএনপি জিতলে প্রকারান্তরে তাদেরই জয় হবে। বিএনপি ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত তাদের পক্ষে কোমর সোজা করে আর দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। এদিকে এ বিষয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য মশিউল আলম বৃহস্পতিবার বলেন, পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে। নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত হলে জোটের সবাই এই নির্বাচনে অংশ নেবে। জামায়াতও নেবে। কারণ জামায়াত জোটেরই অন্যতম একটি শরিক দল। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই। দলীয় প্রতীকে না পারলে অন্য যে কোনো প্রক্রিয়ায় দলের প্রার্থীরা ভোটের লড়াইয়ে থাকবেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের আরেক নেতা যুগান্তরকে বলেন, প্রতিকূল অবস্থা মেনে নিয়েই জামায়াত মাঠে আছে এবং থাকবে। সূত্র জানায়, বিএনপির সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচন করা সম্ভব না হলে জামায়াতের প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে এ নির্বাচনে অংশ নেবে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও শুরু করেছে তারা। তবে নানামুখী প্রতিকূলতার কারণে এই প্রস্তুতিতেও যে গতি নেই তা স্বীকার করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের একজন শীর্ষ নেতা। এ বিষয়ে তিনি যুগান্তরকে বলেন, দুই বিকল্প সামনে রেখে পৌরসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ না থাকায় বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক কিংবা দলের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেবেন। আর এক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তারা বিএনপির সিদ্ধান্ত জানার চেষ্টা করবে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রাথমিকভাবে ৪৩ পৌরসভায় সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী বাছাই করেছে জামায়াত। যেসব পৌরসভায় জয়ের সম্ভাবনা আছে সেখানে জোটের মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী দেয়া হবে। নির্বাচনে জামায়াতের নজর রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের পৌরসভাগুলোতে। গতবারও এসব পৌরসভায় তারা ভালো ফল করেছিল। এদিকে পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব দল ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে জামায়াতের প্রার্থীদের মোকাবেলা করার আহবান জানিয়েছেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবীর। বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ আহবান জানিয়ে বলেছেন, অতীতে রাজনৈতিক স্বার্থে জামায়াতকে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কম-বেশি জামায়াতকে ব্যবহার করেছে। আমরা আহবান জানাব, আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে যাতে তারা রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে জামায়াতকে প্রতিহত করে। তারা কেউই যাতে জামায়াতকে কোনো ধরনের ছাড় না দেয়। শাহরিয়ার কবীর বলেন, যদিও এবারের বাস্তবতা ভিন্ন। সাধারণ মানুষই জামায়াতকে মোকাবেলায় এগিয়ে আসবে। প্রসঙ্গত, আগামী ৩০ ডিসেম্বর দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় একযোগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবার প্রথম পৌরসভার মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে নির্বাচন হবে। কাউন্সিলর প্রার্থীরা আগের মতোই নির্দলীয়ভাবে লড়বেন। নিবন্ধন না থাকায় জামায়াতের মেয়র প্রার্থীদের দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই। ধর্মাশ্রয়ী দল হওয়ায় ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্ট। পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করে। বর্তমানে এ আপিল সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে। আপিলের ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত দলগতভাবে এবং দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে না দলটি। -যুগান্তর ২৭ নভেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে