শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:১২:৩৮

কঠিন চ্যালেঞ্জে আওয়ামী লীগ

কঠিন চ্যালেঞ্জে আওয়ামী লীগ

উৎপল রায় : পৌর নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে আওয়ামী লীগ। দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৃণমূল নেতাদের প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠাতে বললেও পৌরসভাগুলোতে স্থানীয় এমপি এবং মন্ত্রীদের প্রভাববলয়ের প্রার্থীরাই মনোনয়ন পাবেন বলে স্থানীয় নেতারা আশঙ্কা করছেন। এ কারণে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেকে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এতে দল মনোনীত প্রার্থীদের জয়ও চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে। গতকাল কেন্দ্রে নিদের্শনা তৃণমূলে পাঠানোর পর এমন আলোচনা শুরু হয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলা, পৌর/শহর, উপজেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে পরামর্শ ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে একক প্রার্থী বাছাই করবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সাংগঠনিক জেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের নেতারা আশঙ্কা করছেন, তাদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করবেন। এমনকি তাদের ইচ্ছা ও পছন্দের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই হবে। গতকাল কয়েকটি সাংগঠনিক জেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য মিলেছে। তৃণমূলের নেতাদের ধারণা কেন্দ্র থেকে জেলা, পৌর, উপজেলার সভাপতি সাধারণ সম্পাদকদের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাইয়ের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত স্থানীয় এমপি ও মন্ত্রীর ইচ্ছাই পূর্ণ হবে। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদেরই প্রাধান্য থাকবে। ফলে অনেক পৌরসভায় যোগ্য প্রার্থী যেমন বাদ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে তেমনি মনোনীত প্রার্থীকে জয়ী করতেও বেগ পেতে হবে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের জেলা নেতারা। সারা দেশের সাতটি বিভাগের আওয়ামী লীগের বেশকিছু সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বললে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেন তারা। তবে, এ বিষয়ে বক্তব্যের প্রেক্ষিতে দলের রোষানলে পড়তে পারেন-এমন আশঙ্কায় নেতাদের অনেকেই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। এদিকে প্রার্থী বাছাইয়ে মন্ত্রী এমপিদের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান জেলা, পৌরসভা, উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের কিছুটা প্রভাব থাকলেও আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন উপলক্ষে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ কোন ক্ষমতা, নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব দেয়া হয়নি। তাই প্রার্থী বাছাইয়ে তারা কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন না বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। তারা বলছেন, যেহেতু কেন্দ্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে সবকিছু মনিটর করা হবে তাই অনেকেই অনেক কিছু করতে চাইলেও খুব বেশি লাভ হবে না। বৃহত্তর বরিশাল বিভাগের একটি জেলার সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানবজমিনকে বলেন, সত্যি কথা বলতে কি পৌর, জেলা ও উপজেলা কমিটির সভাপতি সাধারণ সম্পাদকদের প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেয়া হলেও এ বিষয়ে স্থানীয় এমপি ও মন্ত্রীরাও তাদের মতামত ও সিদ্ধান্তকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেবেন। নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য তারা যে প্রার্থীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তারাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবেন। তাদের নামই কেন্দ্রে পাঠানো হবে। আর দলীয় আনুগত্যের কারণে এর বাইরে আমাদের যাওয়ারও কোন সুযোগ নেই। একই বিভাগের উপকূলীয় একটি জেলার সভাপতি বলেন, আমাদের সংসদীয় এলাকায় প্রত্যেকটিতে স্থানীয় মন্ত্রী, এমপিদের মতামতের ভিত্তিতেই প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া একপ্রকার চূড়ান্তই হয়ে আছে। অনেক আগে থেকেই তা করা হয়েছে। এখন যেটি হবে সেটি নিয়মরক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। হয়তো এতে কারও কারও মনোবেদনা থাকতে পারে। কিন্তু তারপরও আমরা দু-একদিনের মধ্যে জরুরি সভায় বসবো। আমাদের মতামত দেবো। শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রব মুন্সী বলেন, কেন্দ্রের নির্দেশনা পেয়েছি। প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ে স্থানীয় এমপিদের প্রভাবতো কিছুটা থাকবেই। কারণ এমপিরাতো আর রাজনীতিবিদদের নিয়ে রাজনীতি করতে চান না। তারা অরাজনীতিবিদদের নিয়ে রাজনীতি করতে চান। তবে, আমার মনে হয় না দলের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃত্ব এ বিষয়টি সহজভাবে মেনে নেবেন। যতদূর জানি, দলের সভানেত্রী এক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক রয়েছেন। তাই আমরাও আশা করছি তৃণমূলের মতামতের প্রার্থীকেই নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন দেয়া হবে। এ বিষয়ে ঢাকা বিভাগের একটি জেলার একজন সভাপতি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই হবে-এমন বিষয়টি আইওয়াশ ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের এলাকার স্থানীয় এমপি কেন্দ্রীয় কমিটির একজন প্রভাবশালী সাংগঠনিক সম্পাদক। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেকদিন থেকেই তিনি তার নিজস্ব লোককে প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। কিন্তু যে প্রার্থী তিনি চূড়ান্ত করতে চাইছেন সেই প্রার্থী একেবারেই নবীন। অথচ এই পৌরসভায় আমি নিজেও একজন প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলাম। জেলার সভাপতি হিসেবে এক দশক পার করেছি। কিন্তু এমপির কারণে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছি না। এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পৌর নির্বাচনে অংশ নেবেন কি-না? এমন প্রশ্নের জবাবে ওই জেলা কমিটির সভাপতি বলেন, কেন্দ্র থেকে যে নির্দেশনা আসবে সেটিই আমাদের মেনে নিতে হবে। গাইবান্ধা জেলার একটি পৌরসভার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি (যিনি নিজেও একজন প্রার্থী) মানবজমিনকে বলেন, স্থানীয় এমপির এ ধরনের একটি প্রক্রিয়া চলছে বলে জানতে পেরেছি। তিনি জনসমর্থনহীন একজনকে প্রার্থী হিসেবে বাছাইয়ের জন্য জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। ফেনী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আইনুল কবির শামীম মানবজমিনকে বলেন, কেন্দ্র থেকে যেভাবে গাইডলাইন দেয়া হয়েছে সেভাবেই প্রার্থী বাছাই হওয়া উচিত। কিন্তু ফেনীর রাজনীতি একটু ভিন্ন। কেন্দ্র থেকে যদিও তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাইয়ের কথা বলা হয়েছে তারপরও মনে হয় স্থানীয় এমপিদের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেই সবকিছু হবে। একই জেলার একটি পৌরসভার একজন সভাপতি নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, এখানকার রাজনীতিতে নিয়মনীতি বলে কিছুই নেই। কেন্দ্র থেকে যদিও দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে এমপিদের মতামতের ভিত্তিতেই সবকিছু হবে। এর বাইরে যাবার সুযোগ নেই। ফেনীসহ সব পৌরসভাতেই একই অবস্থা। আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা আলাপকালে বলেন, তৃণমূল যদি তাদের পছন্দমতো একক প্রার্থী বাছাই করে কেন্দ্রে তার নাম পাঠিয়ে দিতে পারে তাহলেতো কোন কথা নেই। আর যদি তা করা সম্ভব না হয় তাহলে একাধিক প্রার্থী কেন্দ্রে পাঠালে কেন্দ্রই প্রার্থী বাছাই করবে। এক্ষেত্রে তৃণমূলের মতামতকেই প্রাধান্য দেয়া হবে। পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় এমপি মন্ত্রীরা প্রভাব বিস্তার করবে কি-না? এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নূহ-উল-আলম লেনিন মানবজমিনকে বলেন, স্থানীয়ভাবে এমপি, মন্ত্রীদের প্রভাব কিছুটা থাকেই। তবে সেটা অপপ্রভাব নয়। তিনি বলেন, বিষয়টি এমনতো নয় যে, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এমপি মন্ত্রীরা নেতৃত্বে দেবেন অথবা কেন্দ্র থেকে এমপি মন্ত্রীদের বিশেষ কোন ক্ষমতা বা কতৃত্ব দেয়া হয়েছে। তাই, আমার মনে হয় না এ ধরনের কোন সুযোগ তারা নিতে পারবে। লেনিন বলেন, এমপিদের কাজকর্ম জেলা, পৌর, উপজেলা কমিটির নেতাদের মাধ্যমেই করতে হয়। এর বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ তাদের নেই। আর এখানে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়াটি হবে ২/৩টি কমিটির মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে তাদের প্রভাব খাটানোর সুযোগ নেই। এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের এই শীর্ষ নেতা বলেন, তৃণমূল থেকে প্রার্থীর নাম ও বৃত্তান্ত আসার পর আমরা তা সূক্ষ্মভাবে যাছাই বাছাই করে তবেই তা নির্বাচন কমিশনের হস্তান্তর করবো। আমরা চাইনা কোন একটা ত্রুটি বিচ্যুতির কারণে কোন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাক। তাই চাইলেই তৃণমূলে যে কাউকে বাছাই করা সম্ভব হবে না। তবে, তৃণমূলে প্রার্থী বাছাইয়ে মন্ত্রী এমপিদের নিয়ন্ত্রণে কোন দিকনির্দেশনা দেয়া হবে না বলে জানান তিনি। ২৮ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে