বুধবার, ০২ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৯:৩৪:১৮

জেল হত্যার ২৩৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

 জেল হত্যার ২৩৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

নিউজ ডেস্ক : বহুল আলোচিত জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মামলার আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে, যাতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত দুই আসামিকে খালাস দিয়ে হাই কোর্ট আইন প্রয়োগে ভুল করেছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এজলাসে রায় ঘোষণার আড়াই বছরের বেশি সময় পর মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২৩৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করে। ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল এই রায়টি দেন সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। বেঞ্চের অন্য বিচারকরা হলেন- বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মো. ইমান আলী। রাষ্ট্র পক্ষের আপিল মঞ্জুর এবং নিম্ন আদালতের রায় বহাল, সেদিন এজলাসে বসে এক কথায় রায় ঘোষণা করেছিল আদালত। ১৯৭৫ সালে কারাগারে চার নেতা হত্যা মামলায় হাই কোর্টের রায়ে বাদ পড়লেও দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে এই রায় দেয় আপিল বিভাগ। পূর্ণাঙ্গ রায়ের মূল অংশ লেখেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনসহ চার বিচারক তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন। দুই আসামিকে খালাস দেওয়ার রায়ে হাই কোর্টের ভুল, চার নেতাকে হত্যায় আসামিদের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে একমত হলেও ‘অপারেটিং’ অংশে নিজের আলাদা মত তুলে ধরে রায়ে সংযুক্তি দেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। বিচারপতি নাজমুন আরার রায়ে বলা হয়, এই মামলায় পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে যে, ২ নভেম্বর রাতে রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গে এই দুই আসামি কারাগারে ঢুকেছিলেন। তাদের সঙ্গে আরও দুই সামরিক বাহিনীর লোক ছিল। তারা সেখানে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা আওয়ামী লীগের চার নেতাকে হত্যা করেন। “হাই কোর্ট বিভাগ এই দুই অভিযুক্তকে নির্দোষ দেখিয়ে ভুল এবং অবিচার করেছে।” ২০১৩ সালের দেওয়ার রায়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে কোনো আদেশ না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন হত্যাকাণ্ডের শিকার এম মনসুর আলীর ছেলে বর্তমানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। কিন্তু হাই কোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানিতে রাষ্ট্র পক্ষ কিংবা সংক্ষুব্ধ কোনো পক্ষের এই বিষয়টিতে কিছু না বলার কথা উঠে এসেছে পূর্ণাঙ্গ রায়ে। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ফৌজদারি ষড়যন্ত্রে বিচারিক আদালত সব অভিযুক্তকে খালাস দিয়ে দিয়েছে। বিধান অনুসারে আপিলে এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রতিকার চাওয়ার অধিকার ছিল। নিহত নেতাদের পরিবারের কেউও একটা আবেদনের মাধ্যমে সেটা চাইতে পারতেন। কিন্তু সংক্ষুব্ধ কোনো পক্ষই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বা সময়ের পরে এই ধরনের কোনো আবেদন করেননি। “এমনকি উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স ও দণ্ডিতদের আপিল শুনানির সময়েও ষড়যন্ত্রের খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো কথা বলেনি, যদিও তারা সেই মামলার শুনানিতে অংশ নিয়েছে। এমনকি আপিলের অনুমতির সময়েও তারা এই প্রশ্নটি তোলেনি।” রাষ্ট্রপক্ষ কেবল দফাদার মারফত আলী ও আবুল হাশেম মৃধাকে হত্যার অভিযোগ থেকে খালাসের বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখার জন্য আপিল করেছিল এবং তার ভিত্তিতে আপিলের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। “কিন্তু শুনানির সময়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্রথমবারের মতো ফৌজদারি ষড়যন্ত্র থেকে খালাসের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে আপিল বিভাগ অভিযুক্তদের দণ্ড দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন।” রায়ে বলা হয়, দুটি শর্তে সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার করতে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। এটা তখনই প্রয়োগ করা যায়, যখন সুপ্রিম কোর্ট তার এখতিয়ার প্রয়োগ করে। যখন তার সামনে বিবেচনাধীন বিষয় সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের জন্য এর প্রয়োগ আবশ্যক হয়ে পড়ে। ‘আপীল বিভাগের পরোয়ানা জারী ও নির্বাহ’ শিরোনামে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোনো ব্যক্তির হাজিরা কিংবা কোনো দলিলপত্র উদ্ঘাটন বা দাখিল করিবার আদেশসহ আপিল বিভাগের নিকট বিচারাধীন যে কোনো মামলা বা বিষয়ে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের জন্য যেরূপ প্রয়োজনীয় হইতে পারে, উক্ত বিভাগ সেইরূপ নির্দেশ, আদেশ, ডিক্রি বা রিট জারি করিতে পারিবে। “সুতরাং ফৌজদারি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আমাদের সামনে বিবেচনাধীন বিষয় নয়। রাষ্ট্রপক্ষ বা অন্য কোনো সংক্ষুব্ধদের সংবিধিবদ্ধ বিধান অনুসারে ওই খালাস চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ ছিল, কিন্তু তারা সেই সুযোগ গ্রহণ করেননি। সম্পূর্ণ ন্যায় বিচারের নামে আমরা অভিযুক্তের অধিকার উপেক্ষা করতে পারি না,” বলা হয়েছে রায়ে। আড়াই বছর আগে রায়ের পর আসামি পক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন (রিভিউ) করবেন তারা। তবে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি (বর্তমানে আইনমন্ত্রী) আনিসুল হক বলেছিলেন, দুই আসামি পলাতক থাকায় রিভিউ আবেদনের সুবিধা তারা পেতে পারেন না। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন এই চার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয় তার অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে। ওই ঘটনায় মামলা দায়েরের ২৩ বছর পর ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান মামলার রায় দেন। এতে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন (পলাতক), দফাদার মারফত আলী শাহ (পলাতক) ও এল ডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধাকে (পলাতক) মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে ২০০৮ সালে হাই কোর্ট মোসলেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে মারফত আলী ও হাশেম মৃধাকে খালাস দেয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন (লিভ টু আপিল) করা হয়। ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চ হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন মঞ্জুর করে। হাই কোর্ট ফাঁসির তিন আসামির মধ্যে শুধু দুজনকে খালাস দেওয়ায় রায়ের ওই অংশটির বিরুদ্ধে আপিল করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। পলাতক আসামিদের পক্ষে আপিলের কোনো আবেদন হয়নি। এই মামলায় বিচারিক আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় সেনা কর্মকর্তা খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, বজলুল হুদা, এমএইচএম বি নূর চৌধুরী, একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ, এএম রাশেদ চৌধুরী, আহমদ শরিফুল হোসেন, আবদুল মাজেদ, মো. কিসমত হোসেন, নাজমুল হোসেন আনসার, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে। ফারুক, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিনকেও খালাস দিয়েছিল হাই কোর্ট। তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যামামলায় এই চারজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। অন্যরা পলাতক। এদের মধ্যে মেজর আহমদ শরফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাশেম ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার ছাড়া বাকিরা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। তারা এখনও পলাতক রয়েছেন। নিম্ন আদালতের রায়ে খালাস পান বিএনপি নেতা প্রয়াত কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, সেনা কর্মকর্তা মো. খায়রুজ্জামান ও আজিজ পাশা। ২ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে