বৃহস্পতিবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০২:২৯:৫৩

১৩ প্রতিবন্ধী নিয়ে এক পরিবারের জীবন সংগ্রাম

১৩ প্রতিবন্ধী নিয়ে এক পরিবারের জীবন সংগ্রাম

তৌহিদী হাসান, কুষ্টিয়া: সকাল সাতটা। উইপোকায় খাওয়া পাটসোলার বেড়া। একপাশে কবাটের মুখে জবুথবু হয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছেন ৭০ পেরোনো আইয়ুব আলী। পায়ের শব্দ শুনে পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় জেনে একটু তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হতাশ গলায় বললেন, ‘ও, সাংবাদিক, কয়দিন আগেও আইছিল। ১৫ বছর ধইরি আসছে। কিন্তুক কোনো কাম হচ্ছি নে।’ আইয়ুব আলীর পরিবারে এখন ১৩ জন প্রতিবন্ধী। আগে ছিলেন ১৫ জন। দুজন মারা গেছেন। তাঁদের কেউ শারীরিক, কেউ মানসিক বা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। আইয়ুব আলীর পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, ১১ জনের মধ্যে মাত্র একজনের প্রতিবন্ধীর সহায়তা কার্ড আছে। আইয়ুব আলীর মেজো বউমা বুলবুলি খাতুনের তিন ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী। সাংবাদিক এসেছেন শুনেই বলে উঠলেন, ‘হে নে তো ১৫ বছর ধরিই আসছে, আমাগের কিছুই হচ্ছিনে। যদি কার্ড করি দেন, তাইলে ছবি তুলেন। আমরা বিরক্ত।’ তিনি জানান, ছোট ননদ রুবির ছেলে রফিকুলের প্রতিবন্ধী কার্ড রয়েছে। আর কারও কার্ড নেই। সরকারি সহায়তা তো দূরের কথা, গ্রামের জনপ্রতিনিধির কাছ থেকেও সহায়তা পান না। নিজেরাই ছোটখাটো কাজ করে সংসার কোনোমতে চালিয়ে নেন তাঁরা। বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে করতে পরিবারটি এখন ক্লান্ত।আয়ুব আলীর পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যই শারীরিক প্রতিবন্ধী। বুলবুলি খাতুনের তিন ছেলে। সবাই শারীরিক প্রতিবন্ধী। কিন্তু কেউ বসে নেই। ছোট ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী লাল্টু সেলুনে কাজ করেন। মিলন দোকানে বসে মুঠোফোনে টাকা দেন। আরেক ছেলে মিরাজুল বাড়িতেই থাকেন। বড় ভাশুর মৃত জলিলের ছেলে জব্বার কোনোমতে হাঁটতে পারেন। সামর্থ্য থাকলেও তাঁকে কেউ কাজে নেয় না। তাই জব্বার গ্রামে গ্রামে ভ্যান ঠেলে জলপাই ও আমড়ার আচার বিক্রি করেন। পেছনের কথা জানতে চাইলে আইয়ুব আলী বলেন, তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের কয়া উত্তরপাড়া গ্রামে। সে অনেক দিন আগের কথা। ঠিক কত বছর আগে মনে নেই। পাশের গ্রামের কাজলী খাতুন নামের এক শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পরে জানলেন স্ত্রী প্রতিবন্ধী। তাঁর গর্ভেই একে একে জন্ম নেয় প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়ে। জন্ম নেয় চার ছেলে ও তিন মেয়ে। তাঁদের মধ্যে চার ছেলে ও এক মেয়ে প্রতিবন্ধী। তাঁদের ছেলে-মেয়েরাও প্রতিবন্ধী। বসে আছেন আয়ুব আলী। আশপাশে তাঁর বউমা ও নাতি-নাতনিরা। ছবি: তৌহিদী হাসানবড় ছেলে জলিল প্রতিবন্ধী ছিলেন। তিন বছর আগে মারা গেছেন। জলিলের দুই ছেলে জব্বার ও আনারুল শারীরিক প্রতিবন্ধী। মেজো ছেলে খলিল। তাঁর তিন ছেলে লাল্টু, মিলন ও মিরাজুল শারীরিক প্রতিবন্ধী। সেজো ছেলে মহিরও প্রতিবন্ধী। তাঁর দুই মেয়ে মরজিনা ও সুমি বাকপ্রতিবন্ধী। ছোট ছেলে সোহেল প্রতিবন্ধী। তিনি ঢাকায় ভিক্ষা করেন। আইয়ুব আলীর তিন মেয়ের মধ্যে রুবি প্রতিবন্ধী। তাঁর বিয়ে হয়েছে। তাঁর এক ছেলে রফিকুল প্রতিবন্ধী। রফিকুলের দুই ছেলেও প্রতিবন্ধী। আইয়ুব আলীর সেজো বউমা হাসিনা খাতুন বলেন, ‘প্রতিবন্ধী স্বামীর হাতে পড়িছিলাম। সন্তান সেও প্রতিবন্ধী হয়চে, কিন্তুক আমারে সেই কষ্ট গেল না। মাঝেমধ্যে ছবি তুইলি নি যায়, ভিডিও নি যায়, সরকারিভাবে আশা দিই থই, কিছু পাই না। আজকে একটা দিন বাসি মুখে চইলি যায়।’ আইয়ুব আলী বলেন, এক হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে তিনি বয়স্কভাতার কার্ড পেয়েছেন। এ ব্যাপারে কয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিয়াউল ইসলাম বলেন, একটা পরিবারের বেশির ভাগই সদস্য প্রতিবন্ধী। তাঁদের সহায়তায় সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।আয়ুব আলীর পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যই প্রতিবন্ধী। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফেডারেশন কুষ্টিয়ার সভাপতি প্রকৌশলী সাইফুল আলম মারুফ বলেন, কয়া গ্রামের ওই পরিবারকে ব্যক্তিগতভাবে কিছু সাহায্য করা হয়। কিন্তু সরকারিভাবে কার্ড দিলে তারা উপকৃত হতো, বাঁচতে পারত। কুষ্টিয়া সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক হাসিনা মমতাজ বলেন, নীতিমালায় আছে একই পরিবারে একাধিক ব্যক্তি ভাতা পাবে না। ওই পরিবারকে বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। একজনকে বয়স্কভাতা দেওয়া হতো, তিনি মারা গেছেন। তাঁর স্ত্রীকে ভাতা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা ওই কার্যক্রমে আসতে চাননি।-প্রথম আলো ৩ ডিসেম্বর, ২০১৫/এমটি নিউজ২৪/জুবায়ের/রাসেল

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে