শুক্রবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৬:২৪:২৮

‘লড়াই শেষ হয়নি আরও লড়তে হবে’

‘লড়াই শেষ হয়নি আরও লড়তে হবে’

যতীন সরকার : আজকে বিজয়ের ৪৪ বছর পরে আমাদের যেসব কথা শুনতে হচ্ছে পরাজিতদের মুখে- তেমনটিকে আমি একেবারেই অস্বাভাবিক বলতে পারি না। পাকিস্তান সরকার আজকে যে কথা বলছে সে কথা না বলে আর কী কথাই বা বলতে পারত! পরাজিত যারা তারা পরাজয়কে স্বীকার করে নিতে পারে না। এ বং তাদের মধ্যে যে অসহনীয় পরাজয়ের গ্লানির যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে এই ২০১৫ সালে এসে, এমনটি যে হতে হবে, এটা তারা ভাবতে পারেনি। কারণ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ তোলায় যে সূচনা ঘটিয়েছিল এবং যেভাবে তাদের সহযোগীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার পর্যন্ত করে তুলেছিল তাতে তাদের মধ্যে যে একটা সন্তুষ্টির ভাব দেখা দিয়েছিল- হ্যাঁ, আমরা আমাদের পরাজয়ের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছি! যে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটিয়েছে বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা মনে করত সেই পাকিস্তান আবার নতুন করে পুনর্জীবিত হয় বাংলাদেশেই ১৯৭৫-এর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর। ১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশের পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিচালিত হওয়ার ফলেই পাকিস্তানিদের মনে এই আত্মসন্তুষ্টির জন্ম ঘটে। তাদের সেই আত্মসন্তুষ্টিই যখন ২০১৫ সালে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার শেষে বাংলাদেশে তাদের পরিচালিত গণহত্যার সহযোগীদের ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার মধ্যে দিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে গেল তখন তাদের মুখে এমন কথাই অত্যন্ত স্বাভাবিক। বিশেষ করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে যাদের তারা পাকিস্তানেরই বিশ্বস্ত সাঙ্গপাঙ্গ। অবশিষ্ট আরও যেসব যুদ্ধাপরাধী আছেন তাদের কৃতকর্মের জন্যও শাস্তি পেতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের যন্ত্রণা বেড়ে গেছে, বেড়ে গেছে বলেই তারা আজ এসব মিথ্যাচার করছে। এ ব্যাপারে আমাদেরও আত্মসমালোচনায় যেতে হবে। ৪৪ বছর কেন লাগল এদের অপরাধের বিচার করতে? সেটা আমাদের ভাবতে হবে। এর বিশেষ কারণ হচ্ছে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে সম্পূর্ণ বিজয় অর্জিত হয়ে গেছে, চিরকালের জন্য। কিন্তু আমরা ভুলে গিয়েছিলাম এই সতর্কবাণী, ‘সদা সতর্কতার মূল্যেই স্বাধীনতা তথা বিজয়কে রক্ষা করতে হয়।’ বিজয়ের অব্যবহিত পরই এমন আত্মসন্তুষ্টি আমাদের পেয়ে বসেছিল যে, আমাদের এই বিজয় আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কিন্তু পরাজিতরা যে নিজেদের পরাজিত মনে করেনি, তারা যে আমাদের এই আত্মসন্তুষ্টির অবসরে নিজেদের সংহত করে নিয়েছে এবং নিতে যে পারে সে কথা পর্যন্ত আমরা মনে রাখিনি। মনে রাখিনি বলেই তাদের হিংস ছোবলে আমাদের বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। আমাদের সেই আত্মসন্তুষ্টির খেসারত দিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে দীর্ঘ ৪৪ বছর লাগল। ২০১৫ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশ আবার জেগে উঠেছে। আমরা যে কথা বলি, অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে সমাপ্ত করতে হবে- তারই একটি প্রক্রিয়া আজ শুরু হয়েছে। বর্বর পাকিস্তানিদের সহযোগী-দোসরা যে ক’জন দালালকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার শেষে ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রদান ও কার্যকর করা হয়েছে- মনে রাখতে হবে এটি প্রতীকী ব্যাপার মাত্র। যদি প্রকৃত প্রস্তাবে এদের সব উৎসকে- অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা উৎপাটন করতে না পারি, যদি আমরা এমন একটা সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারি যে আন্দোলন সর্বতোভাবে সব মানুষকে জাগরিত করে তুলবে পাকিস্তানি ভাবধারা ও পাকিস্তানি দর্শনের বিরুদ্ধে তাহলে ঘুরেফিরে আবারও আমাদের বিপর্যয়ের শিকার হতে হবে- একথাগুলো আমাদের স্মরণ রাখতে হবে। কাজেই এই বিজয়ের মাসে আমরা যেমন বিজয়ের উল্লাসে উল্লসিত হতে পারি, তেমনই পাশাপাশি আমরা যে আবার পরাজয়ের পঙ্কে নিমজ্জিত হতে পারি সেই আশংকাটাই মনের মধ্যে জাগ্রত রাখতে হবে। ‘সদা সতর্কতার মূল্যেই যে স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হয়’ সেই কথাটি যেন আমরা ভুলে না যাই। একথা সদা স্মরণ রেখেই আমরা যেন আমাদের অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে সমাপ্ত করতে পারি সেই দায়িত্ব নিয়েই এসেছে ২০১৫ সালের বিজয়ের এই ডিসেম্বর মাসটি। অনুলিখন : শুচি সৈয়দ -যুগান্তর লেখক : অধ্যাপক, লেখক ও প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ। ০৪ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে