শনিবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০২:২৪:৩৭

কঠোর আওয়ামী লীগ নমনীয় বিএনপি

কঠোর আওয়ামী লীগ নমনীয় বিএনপি

আবদুল্লাহ আল মামুন ও নজরুল ইসলাম : পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে বেশ সংকটে আছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সংকট তীব্র। কারণ বিদ্রোহীর সংখ্যা শাসক দলেই বেশি। পরিস্থিতি সামাল দিতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিদ্রোহীদের সঙ্গে প্রথমে আলাপ-আলোচনা করে তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করবে। স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা এ কাজটি করবেন। ব্যর্থ হলে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবেন। তাতেও কাজ না হলে বহিষ্কার করা হবে। অন্যদিকে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে বেশ নমনীয় মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। কারণ বর্তমানে দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী মামলা-হামলায় জর্জরিত। এ অবস্থায় কাউকে বহিষ্কার করে নতুন করে দলের ভেতর কোন্দল সৃষ্টি করতে চাইছে না হাইকমান্ড। তবে একক প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি প্রয়োজনে খালেদা জিয়া নিজেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে কথা বলবেন। এতে সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে বিদ্রোহী প্রাথীদের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হয়েছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করুন। যে কোনোভাবেই দলের একক প্রার্থিতা নিশ্চিত করুন।’ বৃহস্পতিবার রাতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার হাতে শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীর তালিকা তুলে দেন। এই নির্দেশের পর শুক্রবার বিকালে ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈঠক করেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। বৈঠকে সাংগঠনিক সম্পাদকদের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। নির্দেশের পর ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনকে ফরিদপুর এবং সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিজবাহউদ্দিন সিরাজকে সিলেটে পাঠানো হয়। বাকি পাঁচ সাংগঠনিক সম্পাদকও গতকাল থেকেই কাজ শুরু করেছেন। তবে সংগঠনটির একটি সূত্র জানিয়েছে, বিদ্রোহী প্রার্থীদের সবাইকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। কারণ পৌর মেয়র পদে দলীয় মনোনয়নে স্বজনপ্রীতি ও অর্থ বাণিজ্যে উপেক্ষিত হয়েছে তৃণমূলের সাধারণ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মতামত। মূলত এ কারণেই সারা দেশে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সর্বোচ্চ শাস্তির কথা মাথায় রেখেই মেয়র পদে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ দল জনপ্রিয়তা, ত্যাগ, সাংগঠনিক দক্ষতার মূল্যায়ন করেনি। তাই চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত অমান্য করতে তারা বাধ্য হয়েছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, এবার দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে। কেউ শৃংখলা ভঙ্গ করে প্রার্থী হলে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি বহিষ্কার করা হবে। একই কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। শুক্রবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, দলীয় শৃংখলা ভঙ্গ করলে গঠনতন্ত্রের ৪৬ ধারা বলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অবশ্য তিনি আশা করেন আগামী ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে অধিকাংশ বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৬ ধারায় (প্রাতিষ্ঠানিক নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল) বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদ সংগঠনের নির্বাচনী গোলযোগ নিষ্পত্তির জন্য একজন আহ্বায়কসহ ৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করিতে পারিবে এবং এই ট্রাইব্যুনালের উপর এতদ্সংক্রান্ত যে কোনো ক্ষমতা ন্যস্ত করিতে পারিবে। এই ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কার্যনির্বাহী সংসদের নিকট আপিল করা চলিবে। কার্যনির্বাহী সংসদের সিদ্ধান্তই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত বলিয়া গণ্য হইবে।’ জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছাত্রলীগের সাবেক উপজেলা সভাপতি কারিবুল হক রাজিন বলেন, নেতাকর্মী নিয়েই দল। যেহেতু শতকরা ৯৯ ভাগ নেতাকর্মী এবং ভোটার তার পক্ষে সেহেতু সরে দাঁড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না। দল (আওয়ামী লীগ) চাইলে তাকে সমর্থন দিয়ে বর্তমান মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিতে পারে। কারিবুল হক রাজিন শুধু শিবগঞ্জ নয়, এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতা। গতবছর জামায়াত-শিবির তার হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তিনি পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই সময় রাজিনকে দেখতে যান প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আঘাতের কারণে পচন ধরায় রাজিনের একটি পা কেটে ফেলেন চিকিৎসকরা। শিবগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের মধ্যেও কখনও তিনি এলাকা ছাড়েননি। গত পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সামান্য ভোটে তিনি পরাজিত হন জামায়াত-শিবিরের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত এ শিবগঞ্জে। এ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মঈন খান। তিনি দলটির একজন নিষ্ক্রিয় কর্মী। মঈন খান দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের বিস্ময়ের শেষ নেই। কারণ কখনই তিনি দলের সক্রিয় নন। বগুড়ার ধুনট পৌরসভার বর্তমান মেয়র এজিএম বাদশাহ। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। বাদশাহ এবার মনোনয়ন পাননি। তার বদলে এ পৌরসভায় মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য শরিফুল ইসলাম খানকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে মেয়র পদে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বাদশা। তার বদলে শরিফুল ইসলাম খান কেন মনোনয়ন পেলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে এজিএম বাদশাহ যুগান্তরকে বলেন, বগুড়া জেলা অওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান মজনু ‘ম্যানেজ’ হয়ে কমিটির অন্য সদস্যদের মতামত না নিয়ে কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠিয়েছেন। এ কারণে তিনি মনোনয়ন পাননি। দল থেকে পদত্যাগ করায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন না বলেও জানান বাদশা। একই ধরনের অভিযোগ চুয়াডাঙ্গার জীবননগর পৌরসভায় মনোনয়নের ক্ষেত্রেও হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয় নেতাকর্মীদের। এ পৌরসভায় মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য শাসক দলের মনোনয়ন পেয়েছেন যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার মুন্সী আহসান কবিরের আপন ছোট ভাই মুন্সী নাছিরউদ্দীন। জীবননগর পৌরসভায় তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তৃণমূল নেতাকর্মী ও স্থানীয় এমপির মতামত না নিয়েই। দলীয় মনোনয়নে ক্ষুব্ধ হয়ে এখানে থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। গতবার দলের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলে মাত্র ২৬ ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। জানতে চাইলে সরকারদলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য আলী আজগার টগর শুক্রবার বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতামত উপেক্ষা করে এ মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি চরম অপমানিত বোধ করছে। তিনি বলেন, যারা আওয়ামী লীগ করে ৫শ’ কোটি টাকা দিলেও সেই পরিবারের কেউ স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে দাঁড়াবে না। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া মুন্সী নাছিরউদ্দিনের আপন ভাই মুন্সী আহসান কবির সে কাজটিই করেছেন। তিনি মুজাহিদের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন। আলী আজগার টগর জানান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জাতীয় সংসদের হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন স্বজনপ্রীতি করে কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠিয়েছেন। বিএনপি : বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী (স্বতন্ত্র) হয়েছেন তাদের সঙ্গে প্রথমে বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা আলোচনা করে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করবেন। তাতে যদি কাজ না হয়, প্রয়োজনে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাদের সঙ্গে টেলিফোনে বা ঢাকায় ডেকে এনে কথা বলে সমাধান করবেন। এ ক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী দলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বিদ্রোহীরা পাবেন- এমন প্রতিশ্র“তি তাদের দেয়া হবে। তবে সবকিছুই করা হবে ৫ ও ৬ ডিসেম্বর রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর। কোথাও যদি দলীয় প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়, সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থীকে দলের সমর্থন দেয়া হবে। বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার কারণে আপাতত কোনো নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে না বলেও নিশ্চিত করেছে দলীয় সূত্র। জানা গেছে, যেহেতু জামায়াতের কোনো নির্ধারিত প্রতীক নেই তাই ওই সংগঠনের যেসব নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাদের প্রার্থিতা রিটার্র্নিং অফিসার কর্তৃক চূড়ান্ত হওয়ার পরে জামায়াতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবে জোটের প্রধান শরিক বিএনপি। এ জন্য জামায়াতকে আরও দু-একদিন অপেক্ষা করতে হবে। জানা গেছে, ইতিমধ্যে বিএনপি নিজস্ব উদ্যোগে জামায়াতের ব্যাপারে খোঁজ নেয়া শুরু করেছে। ভোট সুষ্ঠু হলে যেসব পৌরসভায় জামায়াতের প্রার্থীর জয়ের নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে, শুধু সেখানেই বিএনপি ছাড় দেবে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ৪০টি পৌরসভায় বিএনপির ৫২ জন বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর বেশিরভাগই বিএনপির জনসমর্থন অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে ২৭টি পৌরসভায় জামায়াতে ইসলামীও স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও দলের যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, আমরা বিদ্রোহীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন নই। তারা আমাদের দলের নিবেদিত কর্মী। এ দলের জন্য তাদেরও বহু ত্যাগ রয়েছে। তারা মনের দুঃখে বিদ্রোহী হয়েছেন। আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করব। আশা করি, দলের চেয়ারপারসনের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে তারা তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেবেন। তিনি বলেন, জামায়াতকে কয়টি পৌরসভায় ছাড় দেয়া হবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন ২০ দলীয় জোটের প্রধান খালেদা জিয়া। -যুগান্তর ০৫ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে