রবিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৪:০৯:৩৫

১৭ চক্রে সুন্দরীদের প্রেমের ফাঁদ!

১৭ চক্রে সুন্দরীদের প্রেমের ফাঁদ!

রুদ্র মিজান : টার্গেট করা হয় সহজ-সরল বিত্তশালী তরুণদের। তারপর ফেসবুকে কিংবা মোবাইলফোনে যোগাযোগ করে গড়ে তোলা হয় বন্ধুত্ব। দ্রুতগতিতেই বন্ধুত্ব রূপ নেয় প্রেমে। প্রলোভন দেখানো হয় বিতর্কীত সম্পর্কের। এভাবেই নিজের অজান্তে প্রতারণার ফাঁদে পা দেন অনেক তরুণ। পরবর্তীতে ফুসলিয়ে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হয়। জোরপূর্বক বিতর্কীত ভিডিও চিত্র ধারণ ও মারধর করা হয়। এভাবেই জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে এসব চক্র। রাজধানীতে প্রায় ১৭টি এরকম চক্র রয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে দাবি করা হয়েছে। এসব চক্রে সুন্দরী তরুণীদের পাশাপাশি বিপথগামী তরুণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য জড়িত রয়েছে। ইতিমধ্যে এরকম একাধিক চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ১৭ই নভেম্বর খিলগাঁওয়ের মালিবাগ থেকে প্রতারক চক্রের দুই তরুণীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৩। এ বিষয়ে র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মালিবাগের চানবেকারী গলির একটি বাসা ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে প্রতারণা করে আসছিল ওই চক্র। সর্বশেষ ওই চক্রের ফাঁদে পড়েন সোহেল নামের এক যুবক। নভেম্বরের শুরুর দিকে এক বিকালে তার মোবাইলফোনে একটি কল আসে। অপর প্রান্তে নারীকণ্ঠ। রং নম্বর জানানোর পরও মেয়েটি তা বিশ্বাস করতে চায় না। তানিয়া নামের ওই তরুণী বলে, আপনি দু’রাত ঘুম নষ্ট করেছেন। কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক নেই জেনেই আপনি ডিস্টার্ব করছেন। সুন্দরী মেয়েদের নম্বর পেলে আর হুঁশ থাকে না। আর কখনও এভাবে কল দেবেন না। আমি অচেনা কারও সঙ্গে কথা বলি না। ওকে...। এভাবেই বিরতিহীনভাবে নিজের নিঃসঙ্গতা ও সৌন্দর্যের কথা জানিয়ে দেয় ওই তরুণী। সোহেল বোঝানোর চেষ্টা করেন কখনও ওই ফোন নম্বরে কল দেননি তিনি। মেয়েটি তা বিশ্বাস করতে চায় না। এভাবে কথা বলার সময় লাইনটি কেটে যায়। এবার সোহেল কল দেন। কথা বলার এক পর্যায়ে মেয়েটি এমন ভাব করে যে, তখনই বিশ্বাস করলো সে এটি রং নম্বর। সরি বলে জানায়, অন্য কেউ কল দিয়েছিলো তাকে। দক্ষ অভিনেত্রীর মতো এভাবেই তরুণদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের সূত্রপাত করে তানিয়া। নিজেকে কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, কখনও কর্মহীন বলে পরিচয় দিতো। মূলত সংশ্লিষ্ট ছেলের সঙ্গে তাল মেলাতে যে পরিচয় দিতে হয় তাই দিতো। ফোন নম্বর সংগ্রহ করে দিতো ওই চক্রের ছেলে সদস্যরা। তার আগেই ওই ছেলে সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করতো ওই চক্র। আটকের পর র‌্যাবের কাছে তানিয়া স্বীকার করেছে এরকম অর্ধশত ছেলের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছে সে। সোহেলের সঙ্গেও এভাবেই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। পরবর্তীতে দিনের বিভিন্ন সময়ে ও রাতে তানিয়ার সঙ্গে কথা হতো তাদের। এক পর্যায়ে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করে তানিয়া। সেইসঙ্গে বিভিন্ন সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। তবে শর্ত হলো বাইরে কোথাও দেখা করবে না। এ জন্য নিজের বাসায় পরিবারের সদস্য কেউ না থাকলে ওই দিনই দেখা হবে। এভাবেই সহজ-সরল তরুণ সোহেলকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে গত ১৫ই নভেম্বর সোহেলকে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের আস্তানায়। রাস্তা থেকে ওই তরুণীই তাকে বাসায় নিয়ে যায়। বাসার একটি কক্ষে বসানো হয় তাকে। তারপরই তিন যুবক ওই ঘরে প্রবেশ করে। তরুণী তানিয়ার সঙ্গে কিসের সম্পর্ক, কেন এই বাসায় আসছে ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। কেড়ে নেয়া হয় তার সঙ্গে থাকা মোবাইলফোন ও মানিব্যাগ। হুমকি-ধমকির এক পর্যায়ে মারধর করা হয় তাকে। বেঁধে রাখা হয় মুখ, হাত ও পা। এক পর্যায়ে তার বাড়ির নম্বরে ফোন দিতে বলে চক্রের সদস্যরা। ফোনে কান্নার শব্দ শোনানো হয় তার বাবাকে। মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করা হয় তিন লাখ টাকা। মুক্তিপণ না দিলে হত্যার হুমকি দেয়া হয় তাকে। সোহেলের পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি জানান র‌্যাবকে। বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে রেকি করা হয় ওই বাড়ি। তাকে আটক করার পরদিন রাতেই অভিযান চালানো হয় ওই বাড়িতে। উদ্ধার করা হয় তাকে। গ্রেপ্তার করা হয় ওই চক্রের কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের খুদির জঙ্গল গ্রামের মামুন, একই এলাকার সুমন, কাঞ্চন, রংপুরের গঙ্গাচরার হাজীপাড়া গ্রামের রুবেল, উত্তর শাহজাহানপুরের ৫৪১ নম্বর বাড়ির শাওন আহমেদ, ঝালকাঠির রাজাপুরের তানিয়া ও কিশোরগঞ্জের তারাকান্দি থানার পাগলী শিমুলপাড়ার হাসনাকে। র‌্যাব জানায়, এই চক্রের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত সোহেল খিলগাঁও গোড়ানের হাওয়াই গলির আবদুল গলি আকন্দের পুত্র সোহেল। তার আগে ১১ই নভেম্বর জামালপুরের রহিমগঞ্জের নামাপাড়ার সুমন নামের এক যুবককে অপহরণ করে এই চক্র। এরকম অনেক যুবককে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণ করা হয়েছে। র‌্যাব-৪ এর অপারেশন অফিসার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মোহাম্মদ মুজাহিদ জানান, মোবাইলফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে চক্রগুলো। সূত্রমতে, ফেসবুকে ভুয়া তথ্য দিয়ে আইডি করে নানা এঙ্গেলে আকর্ষণীয় ছবি আপলোড করা হয়। ছেলেদের সঙ্গে চ্যাট করা হয়। এমনকি ইমো ও ভাইবারে কথা বলে আকৃষ্ট করা হয়। ভুক্তভোগী এক যুবক জানান, প্রায় মাসখানেক ফেসবুকে মম নামে এক তরুণীর সঙ্গে ফেসবুকে চ্যাট হতো তার। পরবর্তীতে ইমোতে ভিডিও কলে কথা হয়। মম জানায়, তার স্বামী আমেরিকায়। একটি মেডিকেলে কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন তিনি। সুন্দরী তরুণীকে দেখে আকৃষ্ট হন তিনি। কিন্তু ওই তরুণী তার সঙ্গে দেখা করতে চান না। এক পর্যায়ে তাকে উত্তরার আবদুল্লাহপুরে মম’র নিজের বাসায় যেতে বলে। ওই বাসায় যাওয়ার পরই ঘটে ঘটনা। লিফট দিয়ে তৃতীয় তলায় ওঠার পর মম তাকে বাসায় নিয়ে যায়। তারপর বাসায় কলিং বাজে। চার যুবক মারধর করে জোর করে বস্ত্রহীনভাবে মম নামের তরুণীর সঙ্গে ছবি তোলে। ওই ছবি প্রকাশের ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হয়। কিন্তু সামাজিক মর্যাদার ভয়ে বিষয়টি কাউকে জানাননি তিনি। এরকম একটি চক্রের সাত সদস্যকে গত ১৪ই অক্টোবর কাফরুল থেকে আটক করে র‌্যাব-৪। র‌্যাবের দাবি, মোবাইলফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে ওই চক্র। এসব চক্রের সঙ্গে এক শ্রেণীর অসাধু পুলিশ সদস্য জড়িত। গত বছরের ৩রা নভেম্বর মধ্যরাতে দুই পুলিশ সদস্যসহ প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্যকে আটক করেছিলো র‌্যাব। পুলিশ সদস্যরা হচ্ছে, ভাটারা থানার এসআই মীর সিরাজুল ইসলাম, কায়সার আহমেদ, কনস্টেবল আবদুর রহমান, সিভিল গাড়িচালক আসাদুজ্জামান ও বর্ষা নামে এক তরুণী। তাদের কাছ থেকে শাহজাহান শামছু নামে এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়। শাহজাহানকে আটক করে এই চক্রটি দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল তার পরিবারের কাছে। ঘটনায় অপহৃত শাহজাহানের ভাগ্নে আবু জাফর বাদী হয়ে একটি মামলা (নং ২) করেন। শাহজাহান সামছু ফিলিপস বাংলাদেশ লিমিটেডে চাকরি করেন। থাকেন খিলক্ষেতের খাঁপাড়ার ক-৫৮/সি নম্বর বাসায়। এসব বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, প্রতারকচক্রের অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরকম কোন তথ্য পেলেই ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। পুলিশের সক্রিয়তার কারণে প্রতারক চক্রের অপতৎপরতা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। -মানবজমিন ০৬ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে