রবিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৫:৪৩:০৪

এক শাড়িতে মুড়ে স্বামী ও দেবরকে মাটিচাপা!

এক শাড়িতে মুড়ে স্বামী ও দেবরকে মাটিচাপা!

আব্দুল খালেক ফারুক, কুড়িগ্রাম : ভূখণ্ডে নেমেছে যমদূত। প্রতিদিন পাকিস্তানি বুলেটের শিকার হচ্ছে তরতাজা জীবন। যারা কোনোমতে বেঁচে ছিলেন, তাঁরা টানছেন স্বজনের লাশ। বিভীষিকাময় ওই সময় কারো ভাগ্যে কবর জুটেছে, কেউ হয়েছেন শকুন-কুকুরের খাবার। সেদিন ছিল ১৩ নভেম্বর। রমজান মাস। আগের রাতের সেহরিতে স্বামীসহ তিন দেবরের পাতে খাবার তুলে দিয়েছিলেন গৃহবধূ হালিমা। তখনো কেউ জানতে পারেননি ওই সেহরি ছিল তাদের শেষ খাবার। ভোর হলে হাজির হয় যমদূতের মতো পাকিস্তানি বাহিনী। তারা গুলি আর বেয়নেটের খোঁচায় চার ভাইকে হত্যা করে। পরে এক শাড়িতে মুড়ে স্বামীসহ তিন দেবরকে মাটিচাপা দেন হালিমা। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামে ওই পরিবারে ছিল পাঁচ ভাই। এর মধ্যে চার ভাই শহীদ হন। প্রাণে বেঁচে যান একজন। শহীদরা হলেন তছলিম উদ্দিন, তহফেল আলী, মোজাম্মেল হক মাস্টার ও তবারক আলী। শুধু এ পরিবার নয়, হাতিয়া ইউনিয়নে ৬৯৭ জনকে গুলি করে গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বর্তমানে হাতিয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাড় কেটে বসতি গড়ে বাস করেন ওই দিনের লড়াকু নারী হালিমা বেগম। এখন তার বয়স ৭০ বছর। তার পাঁচ সন্তান রয়েছে; কিন্তু কেউ কাছে থাকেন না। এখন চেয়েচিন্তে জীবন যাপন করেন। ওই দিনের কথা জানতে চাইলে হালিমা বলেন, ‘তখন ছিল রমজান মাস। সেহরি খাওয়ার কিছু পরেই শুরু হয় গুলি। সবাই বুঝে যায় পাকিস্তানি বাহিনী আসছে। আমার স্বামী তছলিম তার ছোট ভাই আব্দুল হককে বলেন বাড়ির নারী ও শিশুদের নিয়ে নদী পার হয়ে চরে চলে যেতে। আমি পাঁচ সন্তানকে নিয়ে বামনী নদী পার হয়ে ব্রহ্মপুত্রের চরে চলে যাই। নদী পার হওয়ার সময় গুলির শব্দ শুনি। প্রাণ বাঁচাতে ধানক্ষেতে সন্তানদের নিয়ে লুকাই। তখন মাথার ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুটছে। পরে জানতে পারি আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে চার ভাইকে ধরে এনেছে। বামনী নদীর পাড়ে দাগারকুঠি নামক স্থানে তাঁদের দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়েছে।’ হালিমা বলেন, ‘খবর পেয়ে নদীর পাড়ে আসি। দেখি অনেক লাশ পড়ে আছে। পানির নিচে খুঁজে বের করি স্বামী ও দুই দেবরের লাশ। পরে রাতে লাশ নিয়ে একটা ঘরে রাখি। আবার গুলির শব্দ। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় দাফন-কাফনের মতো পরিবেশ ছিল না। তাই নিজের শাড়ি কাপড় দিয়ে মুড়ে তিনজনের লাশ দাফন করি।’ হালিমা আরো জানান, যুদ্ধের সময় বাড়িঘর, আসবাব সব কিছুই ধ্বংস হয়। কিছুদিন পরে ভেঙে যায় বাড়ির ভিটাও। পরে গ্রামের মজিদ মুন্সি নামের একজনকে ধরে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে হাতিয়া বাঁধে আশ্রয় নেন সন্তানদের নিয়ে। অন্যের জমিতে কাজ করে আর আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় ছেলেমেয়েদের বড় করেন তিনি। তবে লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে চট্টগ্রামে গার্মেন্টে কাজ করেন। বাঁধের ধারে তাই তার একাকী জীবন। এখনো নদীতে রয়েছে জমি। হালিমা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘স্বামী মরি গেইছে। অনেক কষ্ট গেইছে। আর কয়দিন বাঁচমো। একটা জাহান এটেই শ্যাষ হইবে।’ হাতিয়া ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মিজানুর রহমান জানান, হাতিয়া গণহত্যার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও শহীদ পরিবারের সহায়তায় এখনো কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় অনেক পরিবার দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে। নদী ভাঙার কারণে অনেক পরিবার বাঁধে আশ্রয় নিয়ে আছে।-কালেরকণ্ঠ ০৬ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে