মঙ্গলবার, ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০১:৫৬:৫৭

জোটে আছে, ভোটে নেই

জোটে আছে, ভোটে নেই

আবদুল্লাহ আল মামুন ও হাবিবুর রহমান খান : সংখ্যার দিক দিয়ে ২০ দল বড় হলেও ক্ষমতায় আছে ১৪ দল। সরকার সমর্থক জোটে অস্তিত্ব আছে ১২ দলের। চলতি পৌর নির্বাচনে ১২ দলের মধ্যে ৬টিরই নেই মেয়র প্রার্থী। এ ৬টি দলের কেউ শরিকদের প্রার্থীর পক্ষে মাঠেও নেই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটেও একই অবস্থা। এ জোটের ১৬ দলের কোনো প্রার্থী নেই পৌর নির্বাচনে। দলগুলোর নেতাকর্মীদের কেউ শরিকদের হয়ে মাঠেও নামেননি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুই জোটের শরিকরা অধিকাংশ সময় মূল দল থেকে সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত থাকে। ঘরোয়া অনুষ্ঠানে জোরালো বক্তব্য দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তাদের কার্যক্রম। অথচ সম্মিলিতভাবে মাঠের লড়াইয়ে তাদের প্রায় কখনোই সমান তালে অংশ নিতে দেখা যায় না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় থেকে শুধু জোটে দলের সংখ্যা বাড়িয়েছে। দলগুলো তাদের কোনো কাজে আসছে কিনা সেদিকটি খুব বেশি বিবেচনায় নেয়নি। যে কারণে বড় কোনো সংকট বা পরিস্থিতি মোকাবেলার সময় শরিকদের মধ্যে অনেককেই কাছে পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ আছে। তবে সুবিধা আদায়ের সময় এ ধরনের দলগুলো পিছিয়ে নেই বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা। দেশে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে পৌরসভার মেয়র নির্বাচন হচ্ছে। এতে ১৪ দলীয় জোটের ৬টি দল মেয়র প্রার্থী দিয়েছে। সবগুলো পৌরসভায় আওয়ামী লীগ, জাসদ ২৬, ওয়ার্কার্স পার্টি ৯, জেপি ৬, ন্যাপ ও তরিকত ফেডারেশন একটি করে প্রার্থী দিয়েছে। ২০ দলীয় জোটের চারটি দল প্রার্থী দিয়েছে মেয়র পদে। ২৩৩টিতে বিএনপি, এলডিপি ও জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) একটি করে প্রার্থী দিয়েছে। বিএনপির অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামী স্বতন্ত্রভাবে মেয়র প্রার্থী দিয়েছে। তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে কয়েকটি পৌরসভায় সমঝোতার সম্ভাবনা আছে। ১৪ দল : মহাজোট সরকারের শাসনামলে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প মন্ত্রণালয় বাগিয়ে নিয়ে ৫ বছর মন্ত্রীত্ব চালিয়ে গেলেও ভোটের মাঠে নেই দিলীপ বড়ুয়ার সাম্যবাদী দল। তিনি টেকনোক্রেট কোটায় মন্ত্রী ছিলেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও তিনি অংশ নেননি। মন্ত্রিত্ব লাভের সুবাধে প্রথমবারের মতো মহাজোট আমলে জাতীয় সংসদে যাওয়ার সৌভাগ্য হয় এ বাম নেতার। আর সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় বর্তমানে সংসদের বাইরেই রয়েছেন দিলীপ বড়ুয়া। সাম্যবাদী দল নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হওয়ায় এ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ নেয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সাংগঠনিক ভিত্তি ও জনসমর্থন না থাকায় বরাবরের মতোই ভোটের বাইরেই রয়ে গেল সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার দল। জানতে চাইলে সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, আমরা এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি না। তবে ‘নেক্সফেজে’ দলীয় প্রার্থী দেব। প্রার্থী না দিলেও এ নির্বাচনে আপনাদের ভূমিকা কী হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবস্থা ভেদে আমরা ১৪ দলের শরিকদের পক্ষে কাজ করব। এদিকে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনভুক্ত ১৪ দলের অপর শরিক গণতন্ত্রী পার্টিও পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। প্রয়াত নেতা নুরুল ইসলাম ১৪ দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল এ নেতার। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে রহস্যজনকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে প্রয়াত ওই নেতার স্ত্রী কবি রুবী রহমানকে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য মনোনীত করে। পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দলটির (গণতন্ত্রী পার্টি) পক্ষ থেকে নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবি জানানো হয়েছিল। তারা এ নির্বাচনে কোনো প্রার্থী দেয়নি। জানতে চাইলে গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন রোববার বলেন, তাড়াহুড়োর কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হয়নি। তিনি বলেন, আমরা সময় পেছানোর জন্য বলেছিলাম। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তো আর সময় বাড়াল না। এই নির্বাচনে গণতন্ত্রী পার্টির ভূমিকা কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং সৎ প্রার্থীদের সমর্থন দেব। জোটে আছেন, ভোটে নেই কেন? প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা ১৪ দল গঠন করেছি রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য। ২৩ দফার ভিত্তিতে ১৪ দল গঠিত হয়েছিল। হালুয়া-রুটি ভাগাভাগির জন্য নয়। আর এ সরকার ১৪ দল সমর্থিত সরকার, কোনোভাবেই ১৪ দলের সরকার নয়। অনেক মৌলিক প্রশ্নে এ সরকারের সঙ্গে আমাদের দ্বিমত রয়েছে। তা সত্ত্বেও এ সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার হওয়ায় একে নিজের বলেই মনে করেন বলে জানান। গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাসদের একাংশ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র এবং গণআজাদী লীগের রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই। তাই এ চারটি রাজনৈতিক দলের দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। তবে তারা চাইলে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু দলগুলোর সে সাংগঠনিক ভিত্তি ও জনসমর্থন নেই বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে বাসদের আহ্বায়ক রেজাউর রশিদ খান বলেন, আমরা ১৬ আসনে প্রার্থী ঠিক করেছিলাম। কিন্তু পরে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। নির্বাচন না করার কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ সংস্কৃতিতে নির্বাচন না করাটাই ভালো। কারণ এত টাকা-পয়সা খরচ করে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে গিয়ে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যাবে- এটা আমরা চাই না। তাই নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। জানা গেছে, শুরুতে জোটগতভাবে নির্বাচনের আগ্রহ ছিল শরিকদের। এজন্য তারা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া ছিল না। এ নিয়ে শরিকরা কিছুটা ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে। ২০ দল : সংখ্যার দিক থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট সব চেয়ে বড়। কিন্তু আসন্ন পৌর নির্বাচনে ভোটের মাঠে নেই বৃহত্তর এ জোটের বেশিরভাগ শরিক। বিএনপি এবং জামায়াত ছাড়া অন্য শরিকরা নির্বাচনের মাঠে নামবেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। দুঃসময়ে রাজপথে না নামলেও বিএনপির ওপর ভর করে বিভিন্ন সময় শরিকরা নানা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে তৎপর ছিল। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সামনে যারা কথা বলতে ভয় পান, তাদের অনেকে খালেদা জিয়ার পাশের চেয়ারে বসার সুযোগ পাচ্ছেন। মাঠে-ময়দানে একচুল ভূমিকা না থাকলেও বক্তৃতা-বিবৃতিতে তাদের জুড়ি মেলা ভার। বক্তৃতা-বিবৃতি ছাড়া তাদের অন্য কিছু করারও নেই। কারণ, রাজপথে ভূমিকা পালন করার মতো সাংগঠনিক ভিতই নেই এসব দলের। তাদের দলীয় কার্যক্রম অনেকটা প্রেস ক্লাবকেন্দ্রিক। জোটের বেশিরভাগের দলের মহানগর-জেলা ও উপজেলায় দলীয় কার্যালয় এবং কমিটি নেই। ২০ দলের শরিকদের মধ্যে দুই-চারজন ছাড়া বেশিরভাগ নেতাই জাতীয়ভাবে পরিচিত নন। শুধু জোট-মহাজোটের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ মেলাতে গিয়ে কোনো কিছু বিবেচনা না করে নামসর্বস্ব কিছু রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বাড়ানো হয় জোটের পরিধি। জোটের অর্ধেকের মতো দলের নিবন্ধন নেই। এসব দলের মধ্যে রয়েছে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, মুসলিম লীগ, লেবার পার্টি, ডেমোক্রেটিক লীগ, ইসলামিক পার্টি, পিপলস লীগ, সাম্যবাদী দল। আর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন না থাকায় দলীয় প্রতীকে এসব দল নির্বাচন করার সুযোগ পাচ্ছে না। আসন্ন পৌর নির্বাচনে শরিকরা মাঠে নামবেন না- এমনটা জেনেও জোটের বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাদের উদ্দেশে বলেন, ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে আপনারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন বলে আশা করি। ওই বৈঠকে জোট নেতারা প্রতিশ্র“তিও দেন। কিন্ত এখন পর্যন্ত তাদের নির্বাচনী মাঠে দেখা যায়নি। জানা গেছে, ২০ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে এলডিপি ও জাতীয় পার্টিকে (জাফর) একটি করে পৌরসভায় ছাড় দেয়া হয়। জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রার্থী যাচাই-বাছাই শেষে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। জামায়াত নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রকাশ্যে ভোটের মাঠে থাকতে পারবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। ইতিমধ্যে দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারে চলছে সাঁড়াশি অভিযান। জোটের শরিক এলডিপিকে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ পৌরসভায় ছাড় দেয়া হয়। দলটির প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল অলি আহমেদের নিজ নির্বাচনী এলাকা হওয়ায় ওই প্রার্থীর পক্ষে তিনি নির্বাচনী মাঠে নামবেন। তবে দেশের অন্যান্য পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে এলডিপি নেতাকর্মীদের মাঠে নামার সম্ভাবনা খুবই কম। জোটের আরেক শরিক জাতীয় পার্টিকে (কাজী জাফর) কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভাটি ছেড়ে দেয় বিএনপি। দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য আহসান হাবিব লিংকনের নির্বাচনী এলাকা হওয়ায় তিনি ওই প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামবেন। তবে জোটের প্রার্থীর পক্ষে জাতীয় পার্টি আদৌও মাঠে নামার সম্ভাবনা কম। সূত্র জানায়, মেয়র পদে যেসব শরিককে ছাড় দেয়া হচ্ছে শুধু তারাই তাদের প্রার্থীর পক্ষে সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রচারে নামতে পারেন। কিন্তু অন্যান্য এলাকায় ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে নামার সম্ভাবনা কম। আর জোটের যেসব শরিকদের কোনো পৌরসভায় ছাড় দেয়া হয়নি তারা আদৌও মাঠে নামবেন কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। জানতে চাইলে জোটের শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী যতটুকু প্রচার চালানো যায় জোট প্রার্থীর পক্ষে সবটুকুই করা হবে। দলের তৃণমূল নেতাদের এমন নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। সত্যি কথা বলতে তো দ্বিধা নেই, সারা দেশে আমাদের দলের সাংগঠনিক ভিত নেই। যেখানে যেখানে আছে তারা কাজ করছে। তিনি বলেন, তার নির্বাচনী এলাকা হাটহাজারী পৌরসভায় নির্বাচন হচ্ছে না। তাই রাজধানীর আশপাশের কোথাও জোট প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নামব। দলীয়ভাবে আমরা কোনো প্রার্থী দিইনি। ১১ জন মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু আমরা মনে করছি, কল্যাণ পার্টির চেয়ে বিএনপির প্রার্থী শক্তিশালী। তাই তাদের সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমরা চাই, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া না করে জোটের প্রার্থী জিতে যাক। জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান বলেন, আমাদের দল থেকে মেয়র পদে কোনো প্রার্থী দেয়া হয়নি। আমাদের লক্ষ্য জোটের প্রার্থীর জয়। সেই জয়ের জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সবই করা হবে। ইতিমধ্যে জোটের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে সারা দেশের নেতাকর্মীদের নির্র্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা কাজও শুরু করেছেন। তিনি বলেন, প্রতীক বরাদ্দ হওয়ার পর তিনিও মাঠে নামবেন। উত্তরবঙ্গের ছেলে হিসেবে ওই এলাকায়ই নামতে চাই। ০৮ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে