যুদ্ধ জয়ের নতুন অধ্যায়
কামাল লোহানী : এবারের ডিসেম্বর আমাদের জীবনে নতুন তাৎপর্য নিয়ে এসেছে। বিজয়ের চুয়াল্লিশ বছরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং দণ্ডাদেশ কার্যকর হচ্ছে। বিশেষ করে, অন্যতম প্রধান দু’জন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়েছে। সারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষের মনে একটা স্বস্তি এসেছে। জাতির কলংক কিছুটা হলেও মোচন হয়েছে।
কিন্তু একই সঙ্গে এই ডিসেম্বরে আরেক ক্ষোভের কারণ দেখা দিয়েছে তা হল- যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে, আলবদরের প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানিদের বক্তব্য-বিবৃতি। ১৯৭১-এ তারা বাংলাদেশে গণহত্যা করেনি বলে যে দাবি করেছে, তাতে তাদের প্রতি করুণা করা ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই। পাকিস্তানিরা ১৯৭১-এ বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং তাদের যাবতীয় দুষ্কর্মের সহযোগী-দোসরদের ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকরের সর্বতো বিরোধিতা করে ব্যর্থ হয়ে, ফাঁসি ঠেকাতে না পেরে, আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছে। এমনকি তারা পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়ে দাবি করেছে, তারা ১৯৭১-এ কোনো গণহত্যা ঘটায়নি!
১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা নিরস্ত্র মানুষের ওপর যে গণহত্যা সংঘটিত করে, তার বিচারের জন্য আমাদের সুদীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর অতিবাহিত করতে হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের দেখতে হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের দোসরদের অমার্জনীয় ঔদ্ধত্য! ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের পর দেখতে হয়েছে তাদের পুনর্বাসনও। ৩০ লাখ শহীদ আর চার লাখ মা-বোনের আÍত্যাগে অর্জিত গৌরব আর অহংকারের লাল-সবুজ পতাকাটি পর্যন্ত আমরা দেখেছি রাজাকার-আলবদর-খুনিদের গাড়িতে শোভা পেতে! মুক্তিযুদ্ধের চুয়াল্লিশ বছর পরও পাকিস্তানিরা তাদের ’৭১-এর পরাজয়ের গ্লানি এবং বেদনা ভোলেনি। তাই তারা সুযোগ পেলেই এখনও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে নাক গলানোর চেষ্টা চালায়। তারা আমাদের দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের যে বিচার চলছে তার বিরোধিতা করছে। অপরাধীদের দণ্ড কার্যকর করার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এদের ধৃষ্টতাপূর্ণ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের উচিত তাদের এসব অপতৎপরতার সমুচিত জবাব দেয়া। জবাব হিসেবে আমি মনে করি, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত। তাদের সঙ্গে আমাদের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সেটাও বাতিল করে দেয়া উচিত এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে ১৯৫ সদস্যকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল- যাদের তারা বিচার করার প্রতিশ্র“তি দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল; আজ পর্যন্ত তারা তাদের বিচার করেনি। জেনেভা কনভেনশনের অধীনে প্রিজনার্স অব ওয়ার হিসেবে তাদের বাংলাদেশে বন্দি থাকা ও বিচার হওয়ার কথা ছিল কিন্তু পাকিস্তানিরা তাদের বিচার করবে বলে নিয়ে গেলেও বিচার করেনি। এজন্য আমি মনে করি, ওইসব যুদ্ধাপরাধীরও বিচারের দাবি করতে হবে। একই সঙ্গে তারা এ দেশ থেকে যে সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়েছিল, তার কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি এবং পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আমাদের যে ন্যায্য হিস্যা পাওনা ছিল তাও পরিশোধ করেনি আজ পর্যন্ত। এমনকি যারা এ দেশে পাকিস্তানি হিসেবে পরিচিত তাদের নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও অনীহা এবং দায় এড়িয়ে যাচ্ছে- এসব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের মামলা করা উচিত।
সব বাধা অতিক্রম করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার যে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের দণ্ডাদেশ কার্যকর করার বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে অটল থেকেছেন এজন্য তাকে আমি অভিনন্দন জানাই। এবারের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
অনুলিখন : শুচি সৈয়দ -যুগান্তর
০৮ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস