মঙ্গলবার, ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৪:৫৫:১২

বোঝেনি মা ও শিশুর আকুতি!

বোঝেনি মা ও শিশুর আকুতি!

এনাসরুল আনোয়ার, হাওরাঞ্চল থেকে : কটি ফুটফুটে ভূখণ্ড পেটে নিয়ে কাতরাচ্ছে দেশমাতা। একটি পরিবারের সামনে বুলেট তাক করেছে পাকিস্তানি সেনারা। বাবা চাইছেন নিজের জীবন গেলেও তার সন্তান বাঁচুক। সন্তান নিজের বুক পেতে দিয়ে আগলে রাখছে তার মাকে। কিন্তু ঘাতকের বুলেট বোঝেনি কারো আকুতি। সবার প্রাণপাত করে হেসেছে অট্টহাসি। সেদিন ছিল ৪ মে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের জেলেপল্লী নোয়াগাঁও। খুব ভোরে পাকিস্তানি সেনাদের হানা। আঁচ করতে পেরে সাত বছরের শিশুসন্তান মানিককে বুকে করে নৌকায় ওঠেন মা চঞ্চলা রানী দাস। সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যরা। পার হতে গিয়ে নৌকা যখন মাঝনদীতে, তখন একটি বুলেট এসে লাগে শিশু মানিকের শরীরে। কোনোমতে নদী পার হয়ে মা চঞ্চলা রানী দাস গুলিবিদ্ধ মানিককে নিয়ে চিকিৎসকের সন্ধান করেন। ৮-৯ কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দিয়ে পৌঁছেন হাওরের প্রত্যন্ত গ্রাম আয়নারগোপে। কিন্তু সেখানেও পাকিস্তানি সেনার ভয়ে গ্রামশূন্য হয়ে গেছে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর শিশু মানিক সাত-আট ঘণ্টা বেঁচে ছিল। এরপর মায়ের কোলেই মারা যায়। সন্তানকে ধর্মীয় মতে দাহ করতে পারেননি মা চঞ্চলা রানী। পরে মেঘনায় ভাসিয়ে দেন বুকের মানিককে। ওই দিন মানিকের সঙ্গে একই নৌকার আরো প্রায় ২২ জন শহীদ হয়েছিল। এর মধ্যে সাতজন ছিল মানিকদের পরিবারের। ওই নৌকার মাঝি মাধব দাসসহ মানিকদের গ্রামের আরো অন্তত চারজন প্রাণ হারায়। বাকিরা ছিল অন্য এলাকার। ওই দিন হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। পৌর শহরের বসন্তপুর, আলিয়াবাদ, নিতারকান্দি, চন্দ্রগ্রাম, বসাকপাড়া, পৈলনপুর, আছানপুর, শিয়ালদীরপাড় ও শোভারামপুরে হিন্দুদের বাড়িঘরে নির্বিচার লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ ও সীমাহীন অত্যাচার করেছিল তারা। নৃশংস হত্যার শিকার মানিকের মা চঞ্চলা রানী দাস গত ১২ অক্টোবর ৮৩ বছর বয়সে মারা গেছেন। জীবিত থাকাকালে প্রতিবেদকের কাছে স্বজন হারানোর এই গল্প বলেছিলেন তিনি। একাত্তরের তাণ্ডবলীলার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ধরণী কান্ত দাস। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর। তিনি পেশায় জেলে ছিলেন। তিনি জানান, মানিকদের নৌকাটি চালাচ্ছিলেন মাধব দাস (৪০)। তিনি উপজেলার সরারচরে শত্রুসেনাদের আক্রমণের খবর পেয়ে বাড়ি ছাড়েন। তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নৌকায় উঠতে গিয়ে কিছুটা দেরি হয়। তাই শত্রুসেনাদের ব্রাশফায়ার আর স্টেনগানের গুলি লক্ষ্য ভেদ করে। মানিকদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মারা পড়েন মাঝি মাধবসহ ওই গ্রামের হরিকিশোর, মহাদেব, রাজ্যেশ্বর ও যোগেশ দাস। গান-বাজনা করে দিন কাটানো সুনীল সেদিনের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি জানান, বুলেট লেগে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে পড়ে মানিকের বুক। ভাইকে কোলে নিয়ে তিনি হাওরের পথ ধরে যখন হাঁটছিলেন তখন শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মানিকের ফুটো হয়ে যাওয়া বুক বারবার তাঁর বুকে চুম্বকের মতো লেপ্টে যাচ্ছিল। এ ছাড়া নৌকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরও তাঁর কাকিমা শোভা রানীর বুকের খসে পড়া মাংসপিণ্ড লাফাতে দেখেছেন সুনীল। বীরেন্দ্র চন্দ্র দাস (৭১) সুনীলের ছোট কাকা। তিনি জানান, ওই দিন মারা পড়া ২৩ জনের মধ্যে সাতজনই তাঁর পরিবারের। ভাইপো মানিক ছাড়াও মারা যায় তার মা ভগবতী দাস (৫৫), ছোট চাচা গঙ্গাচরণ দাস (৪৫), গঙ্গাচরণের স্ত্রী মনোরমা দাস (৩৮) ও ছয় মাস বয়সী মেয়ে রিতা। মৃত্যুবরণ করে বড় ভাইয়ের স্ত্রী শোভা রানী দাস (২৫) ও তার ছয় বছরের ছেলে স্বপন। ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বৃদ্ধ বীরেন্দ্র বলেন, ‘ভিক্ষুকেরও একটা ঝোলা থাকে। পরার কাপড়টা ছাড়া সেই সময় আর কিছু ছিল না। আগরতলায় পালিয়ে গিয়ে ইটের ওপর মাথা রেখে বহু রাত পার করেছি। না খেয়ে পড়ে থেকেছি। পরে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি আলহাজ মো. জিল্লুর রহমানের কাছ থেকে ৩০ টাকা করে নিয়মিত শরণার্থী ভাতা পেতাম। তা দিয়েই কোনোমতে দিন পার করেছি।’ মানিকের আরেক ভাই কৃষ্ণধন দাস একাত্তরে ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। তিনি জানান, ভাইসহ পরিবারের সাত সদস্যকে হারিয়ে এক আত্মীয়র সূত্রে তাঁরা ভারতের আসামে পাড়ি জমান। ছোট ভাই সুনীল ওই বাড়ির গরু-বাছুর ও হাঁসের রাখালি করেন। আর তিনি কাজ নেন মুদির দোকানে। এভাবে কয়েকটি মাস কাটে আসামের কুসুমপুর, গুয়াহাটি, ঝাড়গাঁও, তিনসুখিয়ায়। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বাড়ি ফিরে দেখি বাড়ির ১১টি ঘর আগুনে পুড়ে ছাই। কৃষ্ণধন দাস জানান, ওই ঘরে জালের ফাঁকে নদীর মাছ বিক্রির কয়েক লাখ টাকা রক্ষিত ছিল। ওই টাকা পুড়ে গেছে, না কেউ লুটে নিয়ে গেছে তা জানতে পারেনি কেউ। তবে বাড়ি দখল করে ভিটায় দিব্যি মিষ্টি আলুর চাষ করছিল দখলদাররা। সুনীল দাস জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের পরিবারকে দুটি হালের বলদ, দুটি ঘরের চালার টিন, কম্বলসহ নানা অনুদান দেন। এরপর আবার স্বাধীন দেশে, মাতৃভূমিতে নতুন করে শুরু হয় তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।- কালেরকণ্ঠ ০৮ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে