বুধবার, ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৪:১৯:৪১

সাত পুরুষকে হত্যা করে স্ত্রীদের ধর্মান্তরকরণ!

সাত পুরুষকে হত্যা করে স্ত্রীদের ধর্মান্তরকরণ!

নিয়ামুল কবীর সজল, ময়মনসিংহ থেকে : ক্যাম্পে প্রতিদিন শিকার হচ্ছে মা-মাটি-মানুষ। এরপর হত্যা-ধর্ষণ-ধর্মান্তরকরণ। প্রাণভেদী চিত্কারগুলো বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে একটু পর পর। আর এভাবেই রাতদিন সমান তালে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল নিগুয়ারী ক্যাম্প। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত নিগুয়ারী ইউনিয়ন। এখানে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় বসে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। সম্ভ্রম হারিয়েছেন বহু মা-বোন। এর মধ্যে নির্মম শিকার হয় বর্মণ পরিবার। তাদের সাত পুরুষ সদস্যকে একসঙ্গে ধরে এনে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর ওই বাড়ির সাত গৃহবধূকে ধরে এনে প্রথমে সম্ভ্রমহানি, এরপর ধর্মান্তরিত করে ছেড়ে দেওয়া হয়। বসতভিটায় টিকতে না পেরে তারা হন দেশান্তরী। তবে ঘটনাক্রমে পরিবারের দুই ছেলে বেঁচে যান, যাদের একজন তখনকার কিশোর রবীন্দ্র চন্দ্র সরকার। বর্তমানে তার বয়স ৫৭। অন্যজন খগেন চন্দ্র বর্মণ। ওই সময় তার বয়স ছিল পাঁচ বছর। রবীন্দ্র চন্দ্র সরকার ছিলেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। পরিবারের বিধবা হয়ে যাওয়া নারীরা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বামীর ভিটা ত্যাগ করে দেশ ছেড়েছিলেন। ওই সময় পাঁচ বছরের শিশু খগেন এখন আর বেঁচে নেই। বর্মণ বাড়ির আশপাশের প্রত্যক্ষদর্শীও ছিল হাতে গোনা কয়েকজন। সেই প্রবীণ লোকগুলোও এখন আর নেই। ফলে গফরগাঁও নিগুয়ারীর গণহত্যার বিস্তারিত তথ্য আজ হারাতে বসেছে। মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্র চন্দ্র ১৯৭৫ সালের পর রাজাকারদের কারণে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের কাওরাইদ ইউনিয়নের নান্দিয়াসাংগুন গ্রামে বসবাস করছেন। আর্থিক অনটন ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ায় বিস্তারিত কিছুই জানাতে পারছেন না। সম্প্রতি নিগুয়ারী ইউনিয়নের চামর্থা গ্রামের বর্মণ বাড়িতে গিয়ে কথা হয় এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ বাসিন্দাদের সঙ্গে। এ সময় সেখানে রবীন্দ্র চন্দ্র নিজেও উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্র চন্দ্র জানান, ১৯৭১ সালে তিনি নবম শ্রেণিতে পড়তেন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি চলে যান যুদ্ধে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে তিনি এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাড়িতে এসে পরিবারের এমন করুণ পরিণতি জানতে পারেন। রবীন্দ্র চন্দ্র বলেন, এলাকায় তারা ছিলেন সচ্ছল পরিবার। কারো সঙ্গে কোনো শত্রুতা ছিল না। যুদ্ধে যাওয়ার কালে বাড়িতে তিনি রেখে গিয়েছিলেন বাবা রামগোপাল চন্দ্র, নিজের দুই ভাই মাখন চন্দ্র বর্মণ ও ননী চন্দ্র বর্মণ, কাকা রামচরণ বর্মণ, কাকাতো ভাই সন্তোষ বর্মণ, ভুটন চন্দ্র বর্মণ ও অনিলকে। তার পাঁচ ভাইই বিবাহিত ছিলেন। যতটুকু মনে আছে, সম্ভবত সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবরের প্রথম দিকে এ ঘটনা ঘটে। নৌকায় করে রাজাকার ও হানাদাররা বাড়ির সব পুরুষ ও নারীদের নিয়ে যায় ক্যাম্পে। ক্যাম্পটি ছিল গ্রাম থেকে প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে নিগুয়ারীর ত্রিমোহনীর সাইদুর রহমান মেমোরিয়াল হাই স্কুল মাঠে। ওই ক্যাম্পেই পরিবারের বয়স্ক সাত পুরুষ সদস্যকে হত্যা করা হয়। আর মহিলাদের ধর্ষণ করে, ধর্মান্তরিত করে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় কারা এ ঘটনায় জড়িত ছিল—এমন এক প্রশ্নের জবাবে রবীন্দ্র চন্দ্র বলেন, ‘আমি যতটুকু শুনেছি আমাদের বাড়ির পাশের ছমেদ আলীর ছেলে জিল্লুর রহমান, আক্কেল আলী, জজ মিয়া এবং সাদুয়ার আবুল ফালাহ মো. ফয়জুল্লাহসহ বেশ কয়েকজন এ ঘটনায় জড়িত ছিল। এর মধ্যে জিল্লুর রহমান এখনো জীবিত এবং এলাকায় বহাল তবিয়তেই আছেন। আর সাদুয়ার আবুল ফালাহ মো. ফয়জুল্লাহ এখন পলাতক। তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় অর্ধশতাধিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।’ নিগুয়ারী ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার কেরামত আলী (৮০) বলেন, মুক্তিযুদ্ধে এ পরিবারটির এমন করুণ কাহিনী তারা যুদ্ধ শেষ করেই এলাকায় এসে শুনেছেন। সেই বাড়িতে গিয়েছেন। কিন্তু পরিবারটির বেঁচে যাওয়া সদস্যদের কোনো সান্ধান তাঁরা দিতে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্র যুদ্ধ করেছেন গফরগাঁওয়ের কাওরাইদ, ত্রিমোহিনী, আশুগঞ্জ এসব এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সঙ্গী ছিলেন এলাকার আরেক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন খান জসীম (৬৩)। তিনি বলেন, যুদ্ধের সময়েই তারা রবীন্দ্রের বাড়ির করুণ কাহিনী জানতেন। কিন্তু তাঁরা তা রবীন্দ্রকে জানাননি। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলের বাড়িও গফরগাঁওয়ের নিগুয়ারীতে। মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল বলেন, ‘বর্মণবাড়ির এ ঘটনা এখনো এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তবে এ ঘটনা জাতীয়ভাবে প্রকাশ ও প্রচারের উদ্যোগ কেউ নেয়নি।’ বর্মণ পরিবারের বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্র চন্দ্র সরকার এখন বসবাস করেন গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের কাওরাইদ ইউনিয়নের নান্দিয়াসাংগুন গ্রামে। স্থানীয় এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করেন। নিগুয়ারীর চামর্থা গ্রামের প্রতিবেশী রাজাকার ও প্রভাবশালীদের হুমকিতে তিনি এলাকা ছেড়ে দেন সেই ১৯৭৭ সালেই। প্রায় ২২ একর জমি, পুকুর, বাড়ি—সব কিছু ছেড়ে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে তিনি বাধ্য হন এলাকা ছাড়তে। জাল দলিল করে, হুমকি দিয়ে তাকে এলাকাছাড়া করে বাড়ির আশপাশেরই লোকজন। এলাকার ঘাতকদের দম্ভ এখনো তাকে পীড়া দেয়। এখনো রবীন্দ্রের আশা, তাঁর পরিবার সদস্যদের ঘাতকদের বিচার হবে। -কালেরকণ্ঠ ০৯ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে