বুধবার, ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৪:৩৩:১৯

পুরনো জটিলতায় নতুন বেতন স্কেল!

পুরনো জটিলতায় নতুন বেতন স্কেল!

আশরাফুল হক রাজীব ও আবুল কাশেম : নতুন বেতন কাঠামোর সব কিছুই ঠিকঠাক, শুধু আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং বাকি। এর পরই জারি হবে অষ্টম পে-স্কেলের গেজেট। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ২০ লাখেরও বেশি চাকুরে অধীর অপেক্ষায়। আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে ভেটিং না হওয়ার কারণ জানতে গিয়ে বোঝা গেল, এই জটিলতা সহজে মিটবার নয়। কারণ আগের দফা ভেটিংয়ের সময় আইন মন্ত্রণালয় যে সাত দফা আপত্তি জানিয়েছিল, তার একটিরও সুরাহা করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। আর যেভাবে গেজেটের খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, হুবহু সেভাবেই ছাড়পত্র চাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর জন্য প্রভাবশালী কয়েকজন সচিব চাপও দিচ্ছেন। কিন্তু অনড় আইন মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও। গতকাল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সিলেট সার্কিট হাউসে স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, পে স্কেল কার্যকরের আদেশ আইন মন্ত্রণালয়ে অপেক্ষমাণ। আজকালের মধ্যে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে আসবে। এর পরই আদেশ জারি হবে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন পে স্কেল কার্যকরের আদেশ জারি হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত অক্টোবরে এক দফা নতুন বেতন কাঠামো পাঠানো হয় ভেটিংয়ের জন্য। ওই সময় লেজিসলেটিভ বিভাগ থেকে সাতটি বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়। আইনমন্ত্রী বিষয়গুলো নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেন। ওই সব আপত্তি দূর এবং নতুন কিছু প্রস্তাব সংযোজন-বিয়োজনের উদ্দেশ্যে অর্থমন্ত্রী তখন ফাইলটি ফেরত নেন। কিন্তু আগের আপত্তিগুলোর সুরাহা না করেই গত ২২ নভেম্বর পে স্কেল ভেটিংয়ের জন্য আবার আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ অবস্থায় তাতে ছাড়পত্র দিতে রাজি নন লেজিসলেটিভ বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে গেছেন। তাদের যুক্তির সঙ্গে একমত মন্ত্রীও। লেজিসলেটিভ সচিব মো. শহিদুল হক পে স্কেলের ফাইল হাতে হাতে অনুমোদন করার জন্য আইনমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছেন। তবে তাতে সায় দেননি মন্ত্রী। সূত্র জানিয়েছে, আইনমন্ত্রী সচিবকে বলেছেন, লেজিসলেটিভ বিভাগ যেসব আপত্তি জানিয়েছে, সেগুলোর সুষ্ঠু সমাধান ছাড়া তিনি ভেটিংয়ের ফাইলে স্বাক্ষর করতে পারেন না। এরপর মন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছেন। সেখানে তাদের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে, তা জানা না গেলেও গতকাল পর্যন্ত ফাইলে স্বাক্ষর করেননি আইনমন্ত্রী। আইন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানান, লেজিসলেটিভ বিভাগের কাজ হচ্ছে নতুন করে সরকারি বিধিবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি সংবিধান, প্রচলিত আইন, বিধি ও আদালতের কোনো রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা নিয়ে গবেষণা করা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা প্রস্তাবিত বেতন স্কেলের প্রতিটি শব্দ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছি। যেসব বিষয় সমস্যা সৃষ্টি করবে, সেগুলো তুলে ধরেছি। এখন এসব বিষয় যদি আমলেই না নেওয়া হবে, তাহলে এই ভেটিং কেন?’ প্রথম শ্রেণির ক্যাডার কর্মকর্তারা অষ্টম গ্রেডে এবং ননক্যাডার কর্মকর্তাদের নবম গ্রেডে নিয়োগ, ২০১৫ সালে সবার ইনক্রিমেন্ট বাতিল করে ২০১৬ সালের ১ জুলাই ইনক্রিমেন্ট দেওয়া, আইন ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের শুধু প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের (অনধিক ৫০ জন) ৩০ শতাংশ হারে লেজিসলেটিভ/বিশেষ ভাতার বদলে একই বিভাগের বিশেষায়িত টেকনিক্যাল কাজের সহায়ক হিসেবে নিয়োজিত স্বল্পসংখ্যককে (অনধিক ২০০ জন) একই হারে ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাবে আপত্তি রয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের। এ ছাড়া গত ১ জুলাই থেকে পে স্কেল কার্যকর করা সত্ত্বেও ওই দিন থেকে গেজেট জারি হওয়া পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাওয়া টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড সুবিধা বহাল রাখা, ১০ বছর ও ১৬ বছর পর স্বয়ংক্রিয় পদোন্নতি চালু করলেও আইন মন্ত্রণালয় বলছে, যথার্থ সময়ে বিভিন্ন কারণে কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি না দেওয়া গেলেও সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে উপসচিব বা পরিচালক বা সমমানের পদের বেতন স্কেল দেওয়ার মাধ্যমে তাদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কমিয়ে আনা যায়। বিষয়টি বিবেচনা করে ‘অন্যবিধভাবে’ কোনো বিধান নতুন কাঠামোর গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা নতুন বেতন স্কেলে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে জটিলতার সৃষ্টি করবে বলে মনে করছে আইন মন্ত্রণালয়। পে স্কেলে আইনপরিপন্থী বিধান সংযোজন না করার অনুরোধ জানিয়ে অর্থসচিব মাহবুব হোসেনের সঙ্গে গত রবিবার দেখা করেছে প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক অ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিমের নেতৃত্বে এই কমিটি পে স্কেলে সিলেকশন ও টাইম স্কেল বহাল রাখা, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত না করা এবং ক্যাডার-ননক্যাডার বৈষম্য সৃষ্টির উদ্যোগ বন্ধের দাবি জানিয়েছে। ওই বৈঠকে অংশ নেন বিসিএস সমন্বয় কমিটির মহাসচিব ফিরোজ খান, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. ইকবাল আর্সলান, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের মহাসচিব মোবারক আলী, ইঞ্জিনিয়ারস ইনস্টিটিউশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুস সবুর এবং প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য স ম গোলাম কিবরিয়া। বৈঠক শেষে স ম গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘অর্থসচিবকে বলেছি, বেতন স্কেলে ১ জুলাই থেকে সরকারি কর্মচারীদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির (ইনক্রিমেন্ট) হিসাব গণনার রীতি চালু হচ্ছে। এ কারণে এক বছরের জন্য সবার বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা হচ্ছে। প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির বক্তব্য হচ্ছে, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি কর্মচারীদের অধিকার। এই অধিকার স্থগিত রাখা আইনপরিপন্থী। সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা বিধিমালা ১৯৮৫ অনুযায়ী একজন কর্মচারীর শাস্তি হিসেবে বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা হয়। আমরা অর্থসচিবকে বলেছি, বেতন বৃদ্ধি স্থগিত না রেখে বর্ধিত ইনক্রিমেন্ট যোগ করা হলে ১ জুলাই থেকে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির হিসাবের সমাধান সম্ভব।’ রকৃচি অর্থসচিবকে জানায়, প্রস্তাবিত বেতন স্কেলে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য অষ্টম গ্রেড এবং ননক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য নবম গ্রেড নির্ধারণ করা হচ্ছে। ফলে নতুন করে ক্যাডার-ননক্যাডার বৈষম্য সৃষ্টি হবে। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বহাল রাখার দাবি জানিয়ে তারা বলেছেন, তা না হলে আন্তক্যাডার বৈষম্য আরো বাড়বে। সরকারের বিশেষ পদ হিসেবে চিহ্নিত উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ে নির্ধারিত পদের চেয়ে অতিরিক্ত পদে পদোন্নতি দেওয়ায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তা পাচ্ছেন। কিন্তু অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা যথাসময়ে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তারা সুপার নিউমারারি পদের সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে বেতন স্কেলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের সুবিধা বহাল না রাখা হলে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। নতুন পে স্কেলকে ‘বৈষম্যমূলক’ উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ সচিবালয় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার্স ও পার্সোনাল অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যান্টিনে এক জরুরি সভায় সংগঠনগুলোর নেতারা বলেন, অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ক্যাডার সার্ভিসের ৪ বছর পরবর্তী সিলেকশন গ্রেড এবং ৫ ও ১০ বছর পরবর্তী টাইম স্কেল বাতিল করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৩, ৪, ৫ ও ১০ বছরে তাদের আপগ্রেডেশনের সুবিধা, কারো বিশেষ ভাতার সুবিধা, কারো পিআরএল, কারো চুক্তিভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। অথচ ননক্যাডারসহ দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৪ বছর পরবর্তী সিলেকশন গ্রেড এবং ৮ ও ১২ বছর পরবর্তী দুটি টাইম স্কেল বাতিল করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১০ ও ১৬ বছরে দুটি আপগ্রেডেশনের সুবিধা প্রস্তাবিত পে স্কেলকে বিতর্কিত ও শ্রেণিবৈষম্যমূলক দলিলে পরিণত করেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভূইয়া (মিলন) বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষা করে সাধারণ কর্মচারীদের সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল নিয়ে প্রতারণা করে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীর স্বার্থ সুরক্ষা করা হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িতদের সাধারণ কর্মচারীরা কোনোভাবেই ক্ষমা করবে না। এ ছাড়া দুই লাখ কর্মচারীর পেনশন রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। সোমবার সংগঠনটির মহাসচিব মো. নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ১৯৭২ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত রাজস্ব কাঠামোতে নিয়মিত করা পদধারীদের উন্নয়ন ও রাজস্ব উভয় ভিত্তিতে প্রাপ্ত সুবিধা কর্তন করা হলে দুই লাখেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী পেনশন হারাবেন। - সূত্র : কালেরকণ্ঠ ০৯ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে