শনিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৯, ০৫:১৮:০৫

প্রাথমিকে বিশেষ নিয়োগ জরুরি

প্রাথমিকে বিশেষ নিয়োগ জরুরি

সাজেদা হক : যদি এক বছরের জন্য পরিকল্পনা করো তবে শস্য বপন করো, যদি দশ বছরের জন্য পরিকল্পনা করো তবে বৃক্ষ রোপন করো, আর যদি একশ’ বছরের জন্য পরিকল্পনা করো তবে সন্তানদের সুশিক্ষিত করো – এই বাণীটি চাইনিজ দার্শনিক কনফুসিয়াসের।

শিক্ষা এবং সুশিক্ষার মধ্যে পার্থক্য আমরা সকলেই জানি, মানি এবং বুঝি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আসলে আমূল পরিবর্তন দরকার। আমাদের বোধবুদ্ধির দানা আসলে প্রাথমিকে অনেকটা, তারপর মাধ্যমিকে পুরোটা বাঁধতে শুরু করে। আর এই বোধবুদ্ধির দানা কখনো ইতিবাচক, কখনো নেতিবাচক। সুতরাং প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক হলো আমাদের সমাজ ব্যবস্থার, আগামী প্রজন্ম তৈরির মূল কারখানা। তাই সেখানেই পরিচর্যাটাও বেশি জরুরি। আমরা যতই সমাজ সংস্কারের কথা বলি না কেন, গোড়ায় গলদ থাকলে তা সংশোধন করা কঠিন। আবার শুরু থেকে শুরু করতে হয়।

গাছের আগায় পানি দিলে যেমন পরিচর্যা হয় না, তেমনি সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন চাইলে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনাটা জরুরি। আর শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্তরকেই বোঝাচ্ছি। এই দুই স্তরেই শিক্ষার্থীদের মন ও মগজের বিকাশ এবং বিস্তার ঘটে। গেল দুই দশকে আমরা আমাদের প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারিনি। অনেকটা সে কারণেই সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি, আদর্শ, সম্পর্ক, সম্মান, শ্রদ্ধা – এই শব্দগুলো শিক্ষার্থীদের কর্ণগোচর হয়েছে ঠিকই, মনের গহীনে প্রবেশ করেনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল নাই’।

বিনিময়ে কিছু শব্দ যশ, খ্যাতি, অর্থ – আমাদের মন ও মগজে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে, এটাই ধর্ম, এটাই সত্য মেনে দুই দশক চলছি আমরা। যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে এই বিষয়টা বেশ স্পষ্ট হয়েছে আমাদের কাছে, যে আমরা সামাজিক দায়বদ্ধতা, মূল্যবোধকে ভুলতে বসেছি, বিনিময়ে রং মেখে সং সাজাকে সত্য মেনেছি।

দুই দশকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের এই যে ব্যবধান, তা তো আর একদিনে কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। এ জন্য আমাদেরকে আগামী দুই দশক কিংবা তারও অধিক সময়ের জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। আমরা একশ’ বছরের পরিকল্পনা করতে চাই আর সে কারণেই সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা জরুরি।প্রাথমিক শিক্ষা-বিশেষ নিয়োগ

বাংলাদেশে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার, যার মধ্যে পুরনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার এবং বিদ্যালয় বিহীন এলাকায় নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রায় ৭০০।  প্রতি বছর আমরা অপরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দেই। গতানুগতিকভাবে বাংলা, ইংরেজি, অংক, পরিবেশ আর ধর্মের শিক্ষক নিয়োগ হয়। একই ধারাপাত,  একই শিক্ষা ব্যবস্থা।

আমার প্রস্তাব এই বছর প্রাইমারিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে হবে:

১) বিষয় সংযুক্তি
২) বিশেষ নিয়োগ
৩) বেকারত্ব দূরীকরণ
৪) বিশেষ বরাদ্দ

১) বিষয় সংযুক্তি: প্রাথমিকে চতুর্থ শ্রেণিতে ‘সংস্কৃতি ও পরিবেশ’ বিষয় যুক্ত করা। এটি তৃতীয় শ্রেণি কিংবা পঞ্চম শ্রেণিতেও হতে পারে। তবে আমার প্রস্তাব হবে চতুর্থ শ্রেণি। কারণ পঞ্চমে সমাপনী পরীক্ষার একটা চাপ থাকে। আর তৃতীয় শ্রেণির বয়স একটু কম হয়ে যায়। বাকিটা সবাই মিলে আলোচনা করা যেতে পারে।

এই বিষয়টি যুক্ত করলে একজন শিক্ষার্থী গতানুগতিক শিক্ষার বাইরেও সমাজে চলমান বেশ অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে মৌলিক ধারণা লাভ করবে। ফলে সমাজের লাভ হবে দুই ভাবে। এক: তৃণমূলের প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর মধ্যে সংগীত, নৃত্যকলা, আবৃত্তি, অভিনয়, চিত্রকলা, ভাস্কর্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রোথিত হবে। এসব বিষয় নিয়ে তাদের কেউ ভুল তথ্য বা বিভ্রান্ত করতে পারবে না। শহর আর গ্রামের শিক্ষার্থীর মধ্যে মানসিক দৈন্যতার দূরত্ব কমে আসবে।

মানসিক দৈন্যতার দূরত্ব কমে আসবে বলছি এ কারণে যে, আমরা দেখি শহুরে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পড়াশুনার পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজের আওতায় নাচ-গানের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। কারণ অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের মানসিক বিকাশ চান। পুঁথিগত বিদ্যায় এই বিকাশ সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজ।  এই এক্সট্রা জ্ঞানার্জনের কারণে শহুরে শিক্ষার্থী আর গ্রামের শিক্ষার্থীর মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়েই যায়, মানসিক ও মানসিকতার পার্থক্য। বলা চলে শ্রেণিবৈষম্য শিশুদের চোখ এড়ায় না।

প্রান্তিক শিশুরা বুঝতে শেখে এসব এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিজ শেখার সামর্থ্য তাদের নেই। তাদের মনে ধনী-গরীব, উত্তম-অধম মানসিকতা, প্রভু-চাকর, দয়া-করুণার অনুভূতি তৈরি হয়।  শহুরে শিশুদের উচ্চারণ, উপস্থাপনার ধরনে থাকে এই এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজ। আত্মবিশ্বাসের মাত্রা তাদের বেড়ে যায় বহুগুণ। কারণ তারা ওইসব গ্রাম্যদের চেয়ে একটু বেশিই জানে।প্রাথমিক শিক্ষা-বিশেষ নিয়োগ

সুতরাং এই বিষয়গুলো যদি আমরা গ্রামের কোমলমতি শিশুদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পারি, তাহলে তাদের মানসিকতার বিকাশ সমভাব তৈরি করবে। আর এটা শুধু এক বছর বা এক মাসের বিষয় নয়, এটি একশ’ বছরের পরিকল্পনায় রাখতে হবে।  তাহলে সমাজে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আসতে বাধ্য।

২) বিশেষ নিয়োগ: পরিকল্পিতভাবে প্রাথমিকে ‘বিশেষ নিয়োগ’ দিতে হবে। পরিকল্পনাটা এমন: এমন একজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যিনি ক্লাস ফোর-এ ‘সংস্কৃতি ও পরিবেশ’ বিষয়ে শেখাবেন। মানে খাঁটি বাঙালিয়ানা শেখাবেন। চতুর্থ শ্রেণিতে একটি নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে। এই বিষয়ে ১০০ নম্বর বণ্টন থাকবে। পরীক্ষায় সংগীত, নৃত্যকলা, আবৃত্তি, অভিনয়, চিত্রকলা, ভাস্কর্য বিষয়ে প্রশ্ন থাকবে। সপ্তাহে ৬ দিন শিক্ষার্থীরা এক ঘন্টা এই ছয় বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা অর্জন করবে।

অর্থাৎ গানের মৌলিক সুর ও স্বর, নাচের মৌলিক মুদ্রা, অভিনয়ের হাতেখড়ি, আবৃত্তির নিয়ম, ছবি আঁকার প্রাথমিক ধারণা, ভাস্কর্য তৈরির নিয়ম এবং বাঙালির বিভিন্ন উৎসব-দিবস সম্পর্কে জানবে। ছয় দিন নির্দিষ্ট সময়ে একটি করে বিষয় নিয়ে একজন শিক্ষক মৌলিক শিক্ষা দেবেন, বাকিটা হোমওয়ার্ক দেবেন। যদি শনিবার গান শেখান, রোববার নৃত্য শেখাবেন, সোমবার শেখাবেন আবৃত্তির কলাকৌশল, মঙ্গলবার শিক্ষার্থীরা শিখবে ছবি আঁকা, বুধবার শিখবে ভাস্কর্য তৈরির নিয়ম এবং বৃহস্পতিবার বাঙালির উৎসব, সম্পর্ক ও দিবস সম্পর্কে জানবে একজন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

এখন প্রশ্ন হলো, এক শিক্ষক কীভাবে এত বিষয় পড়াবেন? এই বিষয়ে আমার পরামর্শ হলো বিশেষ এই শিক্ষককে যে কোন একটি বিষয় পারদর্শী হতেই হবে। কিংবা বলতে পারেন বাধ্যতামূলক। যেমন সংগীত, নৃত্যকলা, আবৃত্তি, অভিনয়, চিত্রকলা, ভাস্কর্য। মোট নিয়োগ হবে ৯০ হাজার, মোট সরকারি প্র্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমান। তবে নিয়োগের পর সাথে সাথে স্কুলে পোস্টিং না দিয়ে জেলা পিটিআইয়ের মাধ্যমে অন্যান্য বিষয়গুলো সম্পর্কে মৌলিক বিষয়গুলো রপ্ত করবেন। যা তারা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শেখাবেন।

৩) বেকারত্ব দূরীকরণ: চারুকলা, সংগীত, নৃত্যকলার শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দিতে হবে। বয়সসীমা উন্মুক্ত রাখা যেতে পারে।

৪) বিশেষ বরাদ্দ: যেহেতু এটি একশ’ বছরের পরিকল্পনার অংশ, বিশেষ এ পরিকল্পনায় বিশেষ বরাদ্দ রাখাটা জরুরি। শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, মাস্টার ট্রেইনার নিয়োগ, তদারকি – এসবে অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা জরুরি।প্রাথমিক শিক্ষা-বিশেষ নিয়োগ

সুনীলের কেউ কথা রাখেনি কবিতাটা সকলেরই জানা। কবিতার

‘একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো

লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা

ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি

ভিতরে রাস-উৎসব

অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কন পরা ফর্সা রমণীরা

কত রকম আমোদে হেসেছে

আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!

বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও

বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই

সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব

আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবে না!’

আমার বিশ্বাস এই যে লস্করবাড়ীর ছেলেদের লাঠি-লজেন্স আর ভিখারির মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা, রাস–উৎসব সবই আমাদের সন্তানদের হাতের নাগালে পৌঁছে দিতে হবে। আর এটা করতে পারলেই অন্ধকারের চোরাগলির মুখ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। সেই সাথে খুলে যাবে চিন্তার দুয়ার। তখন শুভ অশুভের নয়, প্রতিযোগিতা হবে যোগ্য থেকে যোগ্যতর হওয়ার।

(প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। এমটিনিউজ২৪.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে