‘মনে পড়লে এখনো চোখে জল এসে যায়’
নিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে মুক্তি বাহিনী আর ভারতীয় স্থল সেনারা যখন পাকিস্তানি সেনাদের প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছে, সেই সময়েই আকাশপথে একের পর এক বোমা হামলা চালায় ভারতীয় বিমানবাহিনী।
১৯৭১-এর যুদ্ধে প্রথমে পশ্চিম রণাঙ্গনে, আর শেষদিকে তিনদিন হাজার হাজার পাউন্ড বোমা ফেলতে ঢাকার আকাশে উড়ে গিয়েছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার কল্যান কুমার দত্ত।
বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন হয়ে অবসর নেয়া কল্যান কুমার দত্তর সঙ্গে কথা বলেছেন বিবিসির কলকাতা সংবাদদাতা অমিতাভ ভট্টশালী।
যুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য কল্যান কুমার দত্তকে 'বীর চক্র' উপাধি দেয় ভারত সরকার।
আমার জন্ম বার্মায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাবা দেশের বাড়িতে নিয়ে আসেন আমাদের। এখন যে মুন্সিগঞ্জ জেলা, তারই টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় আমাদের গ্রাম– অপারকাঠি। দেশভাগের সময় আমরা ভারতে চলে আসি পাকাপাকিভাবে। বিমানবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার হিসাবে যোগ দিই ১৯৫৭ সালে। আমি ছিলাম ফ্লাইট নেভিগেটর।
৬২ আর ৬৫ সালেও যুদ্ধে গিয়েছি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময়ে আমি বিমানবাহিনীর ১৬ নম্বর স্কোয়াড্রনের লিড নেভিগেটর ছিলাম, আমার র্যাঙ্ক ছিল স্কোয়াড্রন লিডার। আমাদের স্কোয়াড্রনের ঘাঁটি ছিল উত্তর প্রদেশের গোরখপুরে। আমাদের বোমারু বিমানগুলো ছিল ক্যানবেরা।
পাইলট যেমন নেভিগেটরের নির্দেশিত পথে বিমান নিয়ে যায়, তেমনই রকেট হামলা বা গুলিবর্ষণের কাজটাও পাইলটের। আর নেভিগেটরের কাজ হলো বোমা নিক্ষেপ করা। টার্গেটের কত আগে থেকে কোন অ্যাঙ্গেলে বোমাগুলো রিলিজ করতে হবে, সেটা আমাদের কাজ।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম যে, পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আমাদের নিয়মিত ব্রিফিং, প্রশিক্ষণ চলছিল।
কোথায় কোথায় সম্ভাব্য হামলা চালাতে হতে পারে, সে ব্যাপারে শিলংয়ে বায়ুসেনার পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড দপ্তরে ব্রিফিং করা হয়েছিল।
আমি যেহেতু স্কোয়াড্রনের প্রধান নেভিগেটর ছিলাম, তাই সম্ভাব্য টার্গেট– যেমন যশোর, খুলনা, ঢাকা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি জায়গায় আমাদের বোমারু বিমানগুলো কোন রাস্তায় যাবে সেটা আমিই ঠিক করেছিলাম, পাইলটদের প্রশিক্ষণও দিয়েছিলাম।
ডিসেম্বরের ৩ আর ৪ তারিখ যখন পাকিস্তান আমাদের ওপরে হামলা শুরু করল পশ্চিমাঞ্চলের বিমান ঘাঁটিগুলোর ওপরে, তখন আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে নেমে পড়লাম। প্রস্তুতি আগেই ছিল। আমাদের স্কোয়াড্রনের কিছু ক্যানবেরা বিমান গেল পূর্ব রণাঙ্গনে, আর কিছু গেল পশ্চিমে।
আমি পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক ভেতরে ঢুকে পাঁচবার বোমা হামলা চালিয়েছি। যুদ্ধের শেষদিকে আমাদের পাঠানো হলো পূর্ব দিকে।
তার আগে সেনাবাহিনী অনেকটাই লড়াই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, একরকম কোণঠাসা করে ফেলেছিল পাক বাহিনীকে।
আমাদের বলা হলো ফাইনাল এসল্ট করে পাকবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে হবে। আমাদের সেনাবাহিনী পাকিস্তানিদের কোণঠাসা করতে করতে ঢাকার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। একটা পাকিস্তানি ডিভিশনাল হেডকোয়াটার্স অবস্থান করছিল শীতলক্ষ্যা নদীর ধারে।
গোরখপুর থেকে আমাদের দমদমে নিয়ে এসে বলা হলো ওই ডিভিশনাল হেডকোয়াটার্সটা ধ্বংস করতে হবে। তারিখটা ছিল ১১ই ডিসেম্বর। দুপুর বেলায় ব্রিফিংয়ের পরে বিকেল পৌনে তিনটে নাগাদ আমরা রওনা হলাম।
আমাদের কমান্ডিং অফিসার গৌতমের সঙ্গে আমি প্রথম বিমানে।
খুব নিচ দিয়ে বিমান চালিয়ে ৩০-৩৫ মিনিটের মধ্যেই টার্গেটের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম কোনো বাধা ছাড়াই। ওদের তখন বোমারু বিমান আটকানোর মতো কিছুই ছিল না। শীতলক্ষ্যার ধারে তখন অনেক চটকল ছিল। তার মধ্যে পাক বাহিনীর ডিভিশনাল হেডকোয়াটার্স খুঁজে নিতে খুব অসুবিধা হলো না।
বেশ কিছুটা আগে ৫শ’ ফিট থেকে একলাফে সাত হাজার ফিট উঠে আমি বোমাগুলো রিলিজ করে দিলাম। আমার ফেলা বোমার ধোঁয়া দেখে পেছনের তিনটি বিমানও নির্দিষ্ট টার্গেটেই বোমা ফেলতে পারল। আমরা সেদিনের মতো ফিরে গেলাম গোরখপুরে আমাদের ঘাঁটিতে।
ঢাকায় শেষদিনের অভিযানে মি. দত্তদের বিমান বহরের একটি বিমান ভূপাতিত হয় পাকিস্তানি সেনাদের বিমাধ্বংসী গোলার আঘাতে। ওই বিমানে থাকা দুই বৈমানিকই নিহত হন। এদের একজন বিমানটির পাইলট, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বি আর ই উইলসন।
এরপর ১৩ তারিখ আবার আমাদের মিশন দেয়া হলো। এটা রাতের মিশন ছিল। তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে ধ্বংস করতে হবে। এবারও তিনটি বিমান আমাদের সঙ্গে।
আমরা এক এক মিনিটের তফাতে গুয়াহাটি থেকে উড়েছিলাম সেই রাতে। শিলং পাহাড় পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকতেই মেঘের কবলে পড়তে হলো। তাই একটু পথ পালটিয়ে ঢাকার ওপরে পৌঁছলাম।
তেজগাঁও বিমানবন্দরের ওপরে একটা চক্কর কাটল আমাদের বিমান। ততক্ষণে অন্য দুটো বিমান চলে এসেছে কাছে। আমি সময় বুঝে ফ্লেয়ার (বিমান থেকে ছাড়া প্যারাশ্যুট লাগানো প্রবল শক্তিশালী আলো– যাতে নিচের টার্গেট স্পষ্ট দেখা যায়) ছাড়লাম চারটি। সেই অনুযায়ী পরপর বোমাগুলো ফেলা হলো বিমানবন্দরের ওপরে।
এরপর শেষ মিশন ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ। জেনারেল মানেকশ ততক্ষণে পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের বলা হলো আরও চাপ বাড়াতে হবে, যাতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির সামনে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা না থাকে।
আবারো যেতে হলো গুয়াহাটি বিমানঘাঁটিতে। সেখানকার বেস কমান্ডার আমাদের কিছু ছবি দেখালেন– ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটির।
বলা হলো, ওখানে গিয়ে যা দেখবে ধ্বংস করে দেবে। বিকেল চারটা থেকে সাড়ে চারটা – এই আধ ঘণ্টার মধ্যে হামলা শেষ করতে হবে আমাদের।
যাত্রাপথ নির্দিষ্ট করার পরে আমরা ঠিক করলাম ঠিক দশ মিনিট পরপর আমরা হামলা চালাবো। সেই মতো প্রথমে আমাদের বিমান। বিকেল চারটার সময়ে পৌঁছলাম কুর্মিটোলার ওপরে। একটা বাড়ি দেখে মনে হলো ওটা সম্ভবত অপারেশনস্ কন্ট্রোল রুম।
সেটাকে টার্গেট করে বিমানের ডানায় যে দুটো এক হাজার পাউন্ডের বোমা রাখা থাকে, সে দুটো রিলিজ করে দিলাম আমি। কয়েক সেকেন্ড পরই ঘন কালো ধোঁয়া উঠতে দেখলাম। এত কালো ধোঁয়া জ্বালানি তেলে বিস্ফোরণ হলেই হওয়া সম্ভব।
আমরা যখন ঘুরে চলে আসছি আমার পেছনের দুটি বিমানকেও জানিয়ে দিলাম ধোঁয়ার কথাটা। আমরা ফিরতে থাকলাম গোরখপুরের দিকে। দু’নম্বর বিমানটা ওই ধোঁয়াকে টার্গেট করেই বোমা ফেলেছিল। কিন্তু তিন নম্বর যে বিমান গিয়েছিল, সেখান থেকে পাইলট উইলসন রেডিও মেসেজ দিল যে ও ধোঁয়ার নিচে নেমে গিয়ে বোমা ফেলতে চায় ।
সেটাই ছিল ওই বিমানের শেষ ট্র্যান্সমিশন। পাকবাহিনীর বিমান বিধ্বংসী গোলায় ক্যানবেরা বি ১– ৫৮ বিমান আর তার পাইলট, নেভিগেটর দুজনেই মারা যায়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বি আর ই উইলসন ছিল পাইলট। যুদ্ধের ঠিক আগে ওর একটা মেয়ে হয়েছিল।
আর নেভিগেটর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আর বি মেহতা অবিবাহিত ছিল, কিন্তু গোরখপুর এয়ার বেসকে মাতিয়ে রাখতো ও, এত মিশুকে ছিল।
দুজনেই আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। কি করে যে ঘটনাটা ঘটল, আমরা কিছু বুঝেই উঠতে পারলাম না। যদি যুদ্ধের গোড়ার দিকে পশ্চিম রণাঙ্গনে এটা হত, তাও মানতে পারতাম।
সেখানে আমাদের বিমানের ওপরে হামলা চালানোর মতো বিমানধ্বংসী গোলা, মিসাইল, ফাইটার এয়ারক্র্যাফ্ট– অনেক কিছু ছিল, কিন্তু যুদ্ধের একেবারে শেষ দিন, আমাদের স্কোয়াড্রনের শেষ মিশনের শেষ বিমানটা ধ্বংস হয়ে গেল, সঙ্গে মারা গেল দুজন খুব ভাল অফিসার।
এজন্যই আমরা যুদ্ধ জয়ের কোনো আনন্দ করতে পারিনি। যদিও পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করল, তাতে আমরা সন্তুষ্ট, কিন্তু আমাদের মনোবল সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গিয়েছিল। মনে পড়লে এখনো আমার চোখে জল এসে যায়। -বিবিসি
১৬ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম