মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২০, ০১:৪৮:০০

সম্রাট আওরঙ্গজেব, দুবলার চর ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গুরুত্ব

সম্রাট আওরঙ্গজেব, দুবলার চর ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গুরুত্ব

আহমেদ শরীফ : ১৬৮০-এর দশকে ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল মুঘল শা'সক আওর'ঙ্গজেবের অধীনে। ইংরেজরা বাণিজ্য করতে এসে অন্য ইউরোপীয় দেশগুলির চাইতে বেশি সুবিধা চাইলে আওরঙ্গজেব সেটা মেনে নেননি। এ সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর ছিলেন জোসাইয়া চাইল্ড, যার ঔ'দ্ধত্যের কারণে ব্রিটিশরা আওরঙ্গজেবের সাথে যু'দ্ধে জড়িয়ে পড়ে। 

এই যু'দ্ধ ইতিহাসে ''চাইল্ড'স ওয়ার'' বলে পরিচিত। তারা ভারত থেকে হজযাত্রায় যাওয়া এক জাহাজ লুট করে এবং যাত্রীদের খু'ন-ধ'র্ষ'ণ করে। ব্রিটিশরা বাংলাকে তথা পুরো ভারতবর্ষকে নৌ অ'বরো'ধে ফেলার চেষ্টা করে। তারা হুগলী নদীর ওপরে একটা দ্বীপ দ'খ'ল করে সেই নদী নিয়'ন্ত্রণ করা শুরু করে। কিন্তু ইংরেজদের এই অবরো'ধ সফল হয়নি, কারণ ভারতের প্রধান প্রদেশ বাংলা বহিঃবাণিজ্যের ওপরে নির্ভরশীল ছিল না। অ'বরো'ধ দেবার কারণে বাংলার অর্থনৈতিক ক্ষ'তি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কেউই না খেয়ে ম'রার উ'পক্র'ম হয়নি।

এই ঘটনার মাধ্যমে সমুদ্রবন্দর অ'বরো'ধ দেয়ার একটা কৌ'শল ব্রিটিশরা জানিয়ে দিয়েছিল। আর সেই অ'বরো'ধ তারা দিয়েছিল সমুদ্রবন্দরের বাইরে দ্বীপে ঘাঁ'টি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ঘাঁ'টির দরকার হয়েছিল, কারণ সমুদ্রে অনি'র্দিষ্টকাল পর্যন্ত থাকা সম্ভব নয়। রসদ নেবার জন্য সব চাইতে কাছের গন্তব্যটিও যদি অনেক দূরে হয়ে থাকে, তাহলে অ'বরো'ধ ধরে রাখা সম্ভব নয়। সেকারণেই হুগলীর সেই দ্বী'প দ'খ'ল দরকার হয়েছিল।

তিন শতক পরে : তিন শতাধিক বছর আগে ব্রিটিশদের দেখানো কৌ'শলের একটা অন্য ভার্সন আমরা দেখতে পাই ভিয়েতনাম যু'দ্ধের সময়ে, যেখানে মার্কিনরা ভিয়েতনামের মেকং নদীর বদ্বীপ এলাকাসহ ভিয়েতনামের পুরো উপকূল নিয়'ন্ত্রণ করেছিল। তারা দক্ষিণ ভিয়েতনামের তাঁবে'দার সরকারের জাহাজগু'লিকে গেরিলাদের হাত থেকে র'ক্ষা করা ছাড়াও গেরিলাদের সা'প্লাই লাইনে অ'বরো'ধ দিয়েছিল। এই অ'বরো'ধ দিতে গিয়ে আমেরিকানরা মেকং নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে কিছু ভাসমান ঘাঁটি তৈরি করা ছাড়াও ভূমিতেও বদ্বীপের কৌশলগত এলাকাগুলিতে ঘাঁ'টি বানিয়েছিল, যেগুলি থেকে গুরুত্বপূর্ণ নৌরুটগুলি নিয়'ন্ত্রণ করা যায়।

গেরি'লারা স্থলপথ এবং নদীপথে নিয়মিত এসব ঘাঁ'টি আ'ক্র'মণ করতো ঠিকই, কিন্তু ঘাঁ'টিগুলি ব'ন্ধ করে দেবার মতো শক্তি তারা কখনোই যো'গাড় করতে পারেনি। ঘাঁ'টিগুলির অনেকগুলিই খুব দু'র্গম জংলা এলাকায় ছিল, যেখানে ঘাঁ'টি র'ক্ষা করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ ধরনের ঘাঁ'টি র'ক্ষা করার আরেকটি উদাহরণ পাওয়া যায় দ্বিতীয় বি'শ্বযু'দ্ধের গুয়াদা'লক্যা'নাল-এর যু'দ্ধ থেকে। এই দ্বীপখানার নামও কেউ জানতো না এক সময়। 

কিন্তু যে মুহূর্তে মার্কিন ম্যারিন সেনারা এই দ্বীপে নেমে জাপানিদের নির্মিতব্য ঘাঁ'টিটি দ'খ'ল করে নেয়, তখন থেকেই এটা ইতিহাসের অংশ। জংলা এই দ্বীপের ঘাঁ'টিটি মার্কিনরা ব্যবহার করে বিমান এবং নৌঘাঁটি হিসেবে, যা কিনা প্রশান্ত মহাসাগরে যু'দ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। জাপানিরা বহুবার চেষ্টা করেছিল দ্বীপে অবতরণ করে ঘাঁ'টিটি দ'খল করে নিতে; কিন্তু জঙ্গলের বাস্তবতা এবং মার্কিনিদের প্র'তিরো'ধের কারণে জাপানিরা অবশেষে ঘাঁ'টি দ'খ'ল করার এই চিন্তাটি বাদ দিয়েছিল।

পরবর্তীতে আমেরিকানরা এই ঘাঁ'টিকে ব্যবহার করে সোলোমন দ্বীপপুঞ্জের বেশিরভাগ দ্বী'প দ'খ'ল করেছিল। গুয়া'দাল'ক্যা'নাল প্রমাণ করে যে, গুরুত্বপূর্ণ নৌপথের ওপরে যদি এমন একটা সামরিক ঘাঁ'টি তৈরি করা যায়, যেটা দু'র্গ'মতার কারণে র'ক্ষা করা সহজ, তাহলে সেই ঘাঁটিটি কৌশলগত দিক থেকে যু'দ্ধের মোড় ঘোরাতে স'ক্ষ'ম।

দ্বীপ পুন'র্দ'খল কি এতটাই ক'ঠি'ন: একটা দ্বীপের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, সেটা দ'খ'ল করতে হলে নদী বা সমুদ্রপথে আ'ক্র'মণ ছাড়া গ'তি নেই। আর যদি দ্বীপটি জ'ঙ্গ'ল বা পাহাড়-বে'ষ্টিত হয়, তবে সেটা দ'খ'ল করাটা আরও বেশি ক'ঠিন। ব্রিটিশরা এই একই কারণে জিব্রা'লটার দ'খলে রাখতে পেরেছে এতকাল। স্থলভাগের দিকে পাহাড়-বে'ষ্টিত থাকায় এর নৌঘাঁ'টিটি সমুদ্রপথে আ'ক্র'মণ করে দ'খ'ল করা ছাড়া গতি নেই। আমেরিকানরাও কিউবার গুয়ান্তানামো বেতে একটা ঘাঁটি রেখে দিয়েছে একইভাবে। উঁচু পাহাড়-বে'ষ্টিত এই ছোট্ট ঘাঁ'টিটি কিউবানরা দ'খ'ল করে নিতে চেষ্টাও করেনি তেমন একটা।

সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশরা যখন হুগলীর দ্বীপে বাণিজ্য জাহাজ দ'খ'ল করার অপে'ক্ষায় চাতক পাখির মতো বসে ছিল, তখন সুন্দরবনের রো'গ-বা'লাই আর সুপে'য় পানির অ'ভা'ব তাদের পেয়ে বসে। বাংলার সুবাদার শায়ে'স্তা খান মৃ'তপ্রায় ব্রিটিশদের ওই দ্বীপ থেকে উ'দ্ধা'র না করলে তারা নি'শ্চি'হ্ন হয়ে যেত। পরবর্তীতে যু'দ্ধ ব'ন্ধ করতে গিয়ে ব্রিটিশ অফিশিয়ালরা (কর্মকর্তা) আও'র'ঙ্গজেবের দরবারে গিয়ে না'কে খ'ত দিয়েছিল! 

কিন্তু মনে রাখতে হবে যে হুগলী নদীর সমুদ্র বাণিজ্য তখন বাংলার জন্য বাঁচা-ম'রার ব্যাপার ছিল না। তাই ব্রিটিশদের কাছ থেকে ওই দ্বীপ পু'নর্দ'খল করাটাও বাঁচা-ম'রার ল'ড়া'ই ছিল না। যদি উল্টো'টা হতো, তাহলে কিন্তু শায়ে'স্তা খানের জন্য সুন্দরবনের ভিতরে অ'ভিযা'ন চালিয়ে ওই দ্বীপ পু'নর্দ'খল করাটা বেশ ক'ঠি'ন হতো। এবার এই দ্বীপের ব্যাপারটা আমরা বাংলাদেশের বদ্বীপের ক্ষে'ত্রে চিন্তা করলে কী দেখি?

দুবলার চর এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপ : পসুর নদীর ভেতরে বাংলাদেশের মংলা সমুদ্রবন্দর। আর এই নদী যেখানে সমুদ্রে মিশেছে, সেখানে রয়েছে কিছু জংলা দ্বীপ, যা কিনা এই নদীর মুখ, তথা এই সমুদ্রবন্দরের নিয়'ন্ত্রণমূলক অবস্থানে রয়েছে। দুবলার চর এবং হিরণ পয়ে'ন্ট এই চ্যানেলের নিয়'ন্ত্রক। কোনো ব'হিঃশ'ত্রু যদি কখনো মংলা বন্দরকে অ'বরো'ধ দেবার চিন্তা করে, তবে তারা এই দ্বীপগুলিকে নি'য়'ন্ত্রণের চিন্তা করবে। 

একটা অ'বরো'ধের প্রধান দিক হলো টিকে থাকা। আর সেটা সম্ভব করতেই নদীমুখে একটি দ্বীপ অপ'রিহার্য। শুধু সমুদ্রের ওপরে নির্ভর করে অ'বরো'ধ চালিয়ে নেয়াটা যে কারো জন্যই ক'ঠিন। আর কেউ যদি ঝ'টি'কা আ'ক্র'মণের মাধ্যমে এই দীপগুলি বা আশপাশের কোনো একটি জব'রদ'খল করে নেয়, তাহলে সেটা পু'নর্দ'খল করাটাও প্র'চ'ণ্ড ক'ঠি'ন হবে। তবে সঠিকভাবে ধরে রাখার ব্যবস্থা করলে সেটা আবার ব'হিঃ'শ'ত্রুর পক্ষে দ'খ'ল করে নেয়াটা বেশ ক'ঠি'ন হবে।

একই রকমের উদাহরণ হচ্ছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। এই দ্বীপ চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ রু'টগু'লিকে নিয়'ন্ত্রণ করতে স'ক্ষ'ম। আবার মূল ভূখ'ণ্ড থেকে আলাদা থাকার কারণে একবার বে'দ'খল হয়ে গেলে পুন'র্দ'খল করাটা ভী'ষ'ণ ক'ঠি'ন হবে। কেউ এই দ্বী'প দ'খলে নিলে একই সাথে টেকনাফের দক্ষিণ প্রান্তে শাহপরীর দ্বীপের কিছু পাহাড়ী এলাকাও দ'খলে নিয়ে রাখতে চাইবে। কারণ এই উঁচু এলাকা থেকে এখানকার সমুদ্রপথ এবং টেকনাফের রাস্তাগুলি অ'বলো'কন করাটা সহজ। 

দুবলার চর এবং সেন্ট মার্টিনের মতো দ্বীপগুলিতে স্পেশাল ফো'র্স, আ'র্টিলা'রি, দ্রু'তগা'মী শ'ক্তিশালী প্যা'ট্রো'ল বো'ট এবং আ'র্ম'ড হেলিক'প্টার মো'তায়েন করে কোনো ব'হিঃশ'ত্রু বাংলাদেশের প্রধান দুই বন্দরকে অ'বরো'ধ দিতে স'ক্ষ'ম হতে পারে। এ কারণেই এই দ্বীপগুলিকে কা'লক্ষেপ'ণ না করে সুর'ক্ষার ব্যবস্থা করাটা জাতীয় নিরা'পত্তার সাথে অ'ঙ্গা'ঙ্গিভাবে জড়িত।

সপ্তদশ শতকের মতো পরি'স্থিতি এখন নেই যে সমুদ্র অ'বরো'ধে এদেশের কোনো ক্ষ'তি হবে না। সমুদ্রপথে আমদানির ওপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল এই দেশকে অ'বরো'ধ দেবার পদ্ধতিটাই কোনো আ'গ্রা'সী শক্তির জন্য ইকো'নমিক্যা'ল হবে। আর বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় বিদেশি কোনো শ'ক্তি এই দেশে কোনোভাবেই তাদের আ'গ্রা'সী তৎপরতা চালাবে না– এ রকম প'দলে'হন'কারী চিন্তা এখন ধো'পে টেকে না।

দুবলার চর এবং সেন্ট মার্টিনের মতো দ্বীপগুলিকে সুর'ক্ষা দিতে গেলে অনেক ধরনের বা'ধা আসবে। কিন্তু যারা বা'ধা দেবেন, তারা কখনোই এই দ্বী'পগু'লির কৌ'শলগত দিক চি'ন্তা করবেন না, অথবা চিন্তা করার পরও বলবেন যে, বিদেশি শ'ক্তিদের তো'ষণ করে চলার মাঝেই এই দেশের ''নিরা'পত্তা'' নিহিত। নিজেদেরকে দু'র্ব'ল ভেবে অন্যের স্বার্থের কাছে সঁপে দিতেই তারা স্বাছন্দ্য বোধ করেন। 

এই দ্বীপগুলির সুর'ক্ষা দিতে চাইলেই এরা বিদেশি পরাভব-এর অংশ হয়ে নানা প্রকারে বা'ধার সৃষ্টি করবেন। ওপরে কৌ'শলগত যতগুলি দ্বীপের উদাহরণ দিয়েছি, তার কোনোটিতেই শ'ক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি জাতীয় নিরা'পত্তার বাইরে কোনো কিছুকে প্রাধান্য দেয়নি; আমাদেরও দেওয়া উচিত হবে না।

লেখক: ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে