রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৫:৪০:৩৮

আত্মঘাতের পথে বিএনপি

 আত্মঘাতের পথে বিএনপি

মতিয়ুল নিয়ন : গয়েশ্বর বাবুও (বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়) বোমা ফাটালেন। পারমাণবিক বোমা না হোক, যারা অন্তত এ জাতীয় বোমা চেনেন তারা বুঝতে পারছেন কত বিশাল মাপের বিস্ফোরণ। আর চারদিকে যখন আত্মঘাতী বোমা ফেটেই চলেছে তখন গয়েশ্বর বাবুই বা বাদ থাকবেন কেন? ‘ডালভাত মার্কা’ বক্তব্য দিতে দিতে দেশের অন্যতম প্রধান জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল বিএনপির এসব নেতা এখন ক্লান্ত। তাই জেঁকেবসা শীতে উষ্ণতা ছড়ানোর চেষ্টায় এমন ‘বাক্যবোমা’ বিস্ফোরণ। তবে গয়েশ্বর বাবুর আগেই তার দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়া মাঠ অনেকখানিই গরম করে রেখেছেন। মহান বিজয় দিবসের পাঁচদিন পর (২১ ডিসেম্বর) রাজধানীর এক মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপি প্রধান। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান নায়ক বঙ্গবন্ধুকে ইঙ্গিত করে সোজা সাফটা বলে দিলেন, ‘উনি (বঙ্গবন্ধু) স্বাধীনতা চাননি, চেয়েছিলেন কেবল ক্ষমতা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন উনি।’ শুধু তাই নয়, একইসঙ্গে এও বললেন, ‘আওয়ামী লীগ শুধু মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। তবে তাদের দলে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই। দেশের প্রতি তাদের কোনো মায়াও নেই।’ বিজয়ের মাসে স্বাধীনতা সংগ্রাম আর শহীদদের কথা বড় বেশি মনে পড়ে। তাই হয়তো বিজয়ের এ মাসেই গয়েশ্বর বাবুরা প্রবল পাকিস্তানপ্রেমের নস্টালজিয়ায় ভোগেন। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের স্বগোত্রীয়রাই তো সেসময় বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। অথচ সেই নিপীড়কদেরই আজ জানে প্রাণে ভালোবেসে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নির্বোধ বলে মরণোত্তর গালি দিতে শুরু করেছেন। যদিও আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে (২০১৪) এই বিজয় দিবসেই লন্ডনে বসে একই রকম বাক্যবোমা ছুঁড়ে সারাদেশ তোলপাড় করছিলেন বিএনপির ‘কর্ণধার’ প্রবাসী তারেক রহমান। যে মানুষটির নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যদিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই তিনি সরাসরি বলে বসলেন রাজাকার। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক সেনানায়ক জিয়াউর রহমান আর তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দম্পতির এই পুত্র এর আগেও বিতর্কিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের নিজস্ব ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে। মহান এ বিজয়ের মাস ঘিরে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতিষ্ঠিত সুবৃহৎ রাজনৈতিক দলের কর্ণধারদের এমন বক্তব্য দলের বড় একটা অংশকেও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ফেলেছে। সত্যিই কি এসব বক্তব্য শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য, নাকি নিখাদ দলীয় দর্শন? তাহলে কি এসব কারণেই আজ আত্মপ্রকাশ ঘটছে আসল আর নকল বিএনপির? এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাববার আছে অনেক। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম যখন নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, তখন বিএনপির মতো বৃহৎ জনপ্রিয় দলের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন এসেই যায়। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা এ দলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন মুক্তিবাহিনীর প্রথম নিয়মিত সশস্ত্র ব্রিগেড জেড ফোর্সের অধিনায়ক জিয়াউর রহমান। যিনি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নে পালন করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বঙ্গন্ধুর পক্ষে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণাও। সেই দলের কর্ণধারদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপত্তিকর কথাবার্তা দলের ভেতরেই যে সঙ্কট তৈরি করবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। পুরোনো প্রশ্ন তাই আবার নতুন করে তোলা যায়, বিএনপি আসলে কাদের নিয়ে সংগঠিত? কাদের জন্যই বা এ দলটি? হয়তো অনেকেই বলবেন, অ্যান্টি আওয়ামী লীগারদের দল বিএনপি। আবার কেউ বলবেন, ডানপন্থিদের নিয়েই তো দলের যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ওইসব প্রশ্নের পাশাপাশি আজ তাদের এটাও পরিষ্কার করতে হবে, তারা মুক্তিযুদ্ধের অনুভূতিকে সম্মানের চোখে দেখতে চায় কি না? দলের প্রতিষ্ঠাতার আদর্শ থেকে তারা সরে আসতে চায় কি না? বিগত সময়ে দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা আর সাম্প্রদায়িক অপতৎপরতায় আমাদের সামনে এসেছে নতুন এক পরিস্থিতি। ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট নির্ভর দল নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির মতো জনপ্রিয় দলের ‘আঁচলের’ নিচ থেকেই দেশজুড়ে ‘তাণ্ডব’ চালিয়েছে তারই শরীকরা। যার দায় এড়ানোর জন্য শুধু নীরবতাই পালন করে গেছে দলটি। দেশের এ পরিস্থিতিতে দলটির রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে এমনিতেই নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্পর্শকাতর বিষয়ে মুখ বন্ধ রাখার ভূমিকা নিয়ে নিয়ে দলটি ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটাতে শুরু হয় সমন্বিত আন্দোলন কর্মসূচি। কিন্তু হঠাৎ করেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে শরীক দল জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন। অপরদিকে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দাবিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশাল অংশের গণজাগরণ ঘটে। এরপরই রাজনৈতিক মাঠে ইস্যুবিহীন হয়ে পড়ে বিএনপি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে দেশজুড়ে গণজাগরণের আগুনে ঘি ঢালা আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের প্রতি সীমাহীন কৃতজ্ঞতা বিএনপিকে প্রথমে নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলে। এরপরের দৃশ্যপটে দলটির ঘাড়ে এসে পড়ে জামায়াতে ইসলাম। দলটিতে শুরু হয় নতুন মেরুকরণ প্রক্রিয়া। সমমনা ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাজপথে নামে নানা ইস্যুতে। আর তাতেই আটকে যায় বিএনপির সরকারপতন আন্দোলনের পুরো ছক। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শরীকরা সরকার পতন আন্দোলনের শক্তিকে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের ইস্যুতে কাজে লাগায়। বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে তারা মাঠে নামে। আর তাতেই বিএনপির মুখ্য রাজনৈতিক ইস্যুর ব্যানারে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের আন্দোলনের তকমা এঁটে যায়। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি হতাশা দেখা দেয় নতুন প্রজন্মের সমর্থকদের মধ্যে। আওয়ামী লীগের অতীতমুখী বক্তব্য আর কর্মকাণ্ডে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে বিএনপিকে যোগ্য মনে করেছিল অসংখ্য তরুণ। কিন্তু প্রিয় দলের ‘তুমুল মৌলবাদ তোষণে’ হতাশ হয়ে পড়ে তারা। দলীয় প্রশ্নে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর এখানেই বিএনপির রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘটে সবচেয়ে বড় টার্ন। খানিকটা পেছনে ফিরলে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় নির্বাচনের ছোট্ট একটা প্রসঙ্গ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। বিএনপির ‘থিংকট্যাংক’ ও দলীয় প্রধানের ‘আপদকালীন আশ্রয়’ খ্যাত সাংবাদিক শফিক রেহমান ওই নির্বাচনের আগে তার সম্পাদিত সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে ‘এক কোটি নতুন ভোটারের কাছে বিশেষ আবেদন জানিয়েছিলেন। যেখানে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অত্যাচারী দৃষ্টান্ত আর শেখ হাসিনার অনিয়ন্ত্রিত, শ্লেষমূলক কথাবার্তায় দেশের শান্তি বিনষ্টের বিষয় সবিস্তারে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। সেই চেষ্টায় সফল হয়েছিলেন সাংবাদিক শফিক রেহমান। তার আবেদনে সাড়া দিয়ে ভোটের অংকই পাল্টে দিয়েছিল নতুন প্রজন্মের এক কোটি ভোটার। কিন্তু আজ সেই সুখস্মৃতির মধ্যে কেউ আর দাঁড়িয়ে নেই। রাজনৈতিক গোয়ার্তুমির কারণেই গণতন্ত্র থেকে দূরে সরে যেতে হয়েছিল সবাইকে। নিষ্পেষিত হতে হয়েছে সেনাশাসনে। সেখান থেকে উদ্ধার পেয়ে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত। কিন্তু রাজনৈতিক জবরদস্তির প্রচলিত সেই ফর্মেই নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে নিঃস্ব হতে হয়েছে বিএনপিকে। এরপর হা-হুতাশেই কেটে যাচ্ছে আরো দুটি বছর। রাজনৈতিক মাঠে আর রাষ্ট্রে শাসকদলের ভূমিকা নিয়ে বরাবরই অসন্তোষ বোধ কাজ করে সত্য, কিন্তু দেশের সার্বভৌমত্ব কিংবা স্বাধীনতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকে না। কারণ এসব যে কোনো দেশের মৌলিক অনুভূতি। কিন্তু সেই বাস্তবতা বোঝার পরেও দেশের বৃহৎ জনপ্রিয় দলের প্রধান আর তার নীতিনির্ধারকরা যেসব প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন তাতে তাদের সেই রাজনৈতিক দর্শন দেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে ক্রমেই সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে। যা একটি দলের জন্য অস্তিত্বের হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। যেমন করে দেশের সবচেয়ে সুনিয়ন্ত্রিত ধর্মভিত্তিক একটি দল রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে। যেকোনো দেশের সুনিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা জরুরি। কেউই চায় না বাংলাদেশ আবারো স্বৈরাতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে ঢুকে পড়ুক। তাই ক্ষমতাসীন দলের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দ্বিতীয় দল থাকাটা জরুরি। কিন্তু কোনো দল যদি দেশের মৌলিক সার্বভৌমত্বের বিষয়টিকে উপেক্ষা করে চলতে থাকে নিজের খেয়াল খুশিতে তাহলে সবচেয়ে খারাপ দিনটাই অপেক্ষা করে তার জন্য। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের লাগামহীন কথাবার্তা কি সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে? সূত্র : বাংলামেইল ২৭ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে