সহিংসতা উগ্রবাদে উদ্বিগ্ন বিদেশিরা
মেহেদী হাসান : ২০১৫ সালের বেশির ভাগ সময়ই বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল বিদেশিরা। বছরের প্রথম তিন মাস ছিল বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচির সময় নির্বিচার সহিংসতা ঘিরে উদ্বেগ, সেপ্টেম্বরের শেষদিক থেকে শুরু হয়েছে উগ্রবাদী ও জঙ্গি হামলার শঙ্কা। তা ছাড়া বছরব্যাপী মুক্তমনা লেখক, ব্লগারদের ওপর দুর্বৃত্তদের ধারাবাহিক হামলা ঘিরে উদ্বেগ তো ছিলই।
বছরের প্রথম তিন মাস সাধারণ নাগরিকদের মতো এ দেশে অবস্থানরত বিদেশিদের কাছেও ছিল আতঙ্কের। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচার পেট্রলবোমা হামলায় তারাও বিস্মিত হয়েছিল। টানা অবরোধের কারণে ঢাকায় বিদেশি মিশনগুলোর রাষ্ট্রদূত ও অন্য কর্মকর্তাদের রাজধানীর বাইরে তো বটেই, রাজধানীর ভেতরও কর্মসূচি সীমিত করতে হয়। এরই মধ্যে ঢাকার কয়েকটি দূতাবাসের মোবাইল টেলিফোন যোগাযোগসেবা
যেমন ব্যাহত হয়েছে, তেমনি দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে দূতাবাসের গাড়ি, হাতবোমা পড়েছে একজন রাষ্ট্রদূতের বাসার শয়নকক্ষের পাশে। ১৪ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূতদের জন্য সরকার আয়োজিত পূর্বনির্ধারিত কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ের আগের সন্ধ্যায় (১৩ জানুয়ারি) ঢাকার গুলশানে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এক বিএনপি নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রসচিব রিয়াজ রহমানের ওপর হামলা হয়।
সেই রাতেই একাধিক দেশ হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়। এরপর কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে ইইউ দূতরা বৈঠকে রিয়াজ রহমানের ওপর হামলাসহ সাধারণ জনগণের ওপর হামলার নিন্দা জানান। তারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সংকুচিত হওয়া নিয়েও উদ্বেগ জানান। তারা আরো বলেন, শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় নেওয়া উদ্যোগ যাতে মতপ্রকাশ, কর্মসূচি পালন ও সমবেত হওয়ার অধিকারকে ক্ষুণ্ন না করে। গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে সহিংসতা বাদ দিয়ে সব অংশীদারকে প্রকৃত সংলাপে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও তারা তুলে ধরেন।
এর আগের সপ্তাহে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতা অমিত শাহ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সমর্থন দেওয়া ভারতের ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে বিএনপি নেত্রীর যোগাযোগ স্থাপনকে বড় অগ্রগতি হিসেবেই দেখানো হচ্ছিল কূটনৈতিক মহলের কাছে।
কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ওই ফোন করার খবরের সত্যতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। এরও আগে জানুয়ারি মাসের শুরুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ছয়জন কংগ্রেস সদস্যের একটি বিবৃতি গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বিভিন্ন মাধ্যমে পাঠানো হলেও পরে জানা যায় স্বাক্ষর জালিয়াতি করে এমনটি করা হয়েছে। বিদেশিদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে রাজনৈতিক স্বার্থে তা প্রচারের বিষয়টিও কূটনীতিক মহলে বিস্ময় সৃষ্টি করে।
কূটনৈতিক ব্রিফিংগুলোতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী’ দল হিসেবে আখ্যায়িত করে অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন। বিদেশি দূতরা সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সরকার ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তাঁরা বলেন, সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
রাষ্ট্রদূতরা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি হিসেবে রাখা হয়েছে কি না জানতে চান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেই কেবল বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। ব্রিফিংয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা চেয়ে দলের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়েছিল।
এরই মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ডকে চিঠি পাঠান। তারেকের বিরুদ্ধে লন্ডনে বসে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মদদ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর একাধিক বিদেশি দূত বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে গিয়ে শোক বইয়ে স্বাক্ষর করেন।
এদিকে সরকারের এক কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে ঢাকায় একটি আরব দেশের রাষ্ট্রদূত জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে সরকারকে প্রস্তাব দেন। সহিংসতার বিরুদ্ধে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগের প্রতি আরব দূতরা তাঁদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
দেশে অব্যাহত সহিংসতার সময় ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের মাযহার খানের বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়ন এবং জাল নোট চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার তাকে প্রত্যাহার করে নিয়ে যায়। মার্চে উত্তর কোরিয়ার দূতাবাসের এক কূটনীতিক ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২৭ কেজি সোনাসহ ধরা পড়ার পর বাংলাদেশ তাকে বহিষ্কারের আগেই তিনি ঢাকা ছেড়ে যান। এ জন্য উত্তর কোরিয়া দূতাবাস সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। বছরের শেষ দিকে ফারিনা আরশাদ নামের আরেক পাকিস্তানি কূটনীতিকের বিরুদ্ধে জঙ্গি যোগসাজশের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর পাকিস্তান তাঁকেও ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
বছরের প্রথম দিকে বিএনপির টানা অবরোধ কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহন শ্রমিকসহ বিভিন্ন সংগঠন গুলশানে মিছিল-সমাবেশ করার চেষ্টা করে। এ পর্যায়ে কূটনৈতিক জোনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, মিছিল-সমাবেশ নিয়েও কূটনীতিকরা উদ্বেগ জানান। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশের উপমিশনের প্রধান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে হুমকি দেন, পরদিন অর্থাৎ ১৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কূটনৈতিক এলাকায় বিক্ষোভ, মিছিল ও সমাবেশ বন্ধ না হলে বাংলাদেশ থেকে দূতাবাসের উল্লেখযোগ্য হারে কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। এরপর সরকার কূটনৈতিক জোনে সভা-সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ করে।
সংঘাত ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই সংলাপে বসার অনুরোধ জানিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিঠি পাঠান। প্রয়োজনে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো সহযোগিতা করতে প্রস্তুত বলেও জানানো হয় সেখানে। কিন্তু সরকার মনে করেছে, সমস্যা সন্ত্রাস, রাজনৈতিক নয়। তাই বাইরের কারো মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির আমন্ত্রণে ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কেরি ও বান কি মুনের সঙ্গে বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। উত্তেজনা প্রশমনে উদ্যোগ নিতে ঢাকায় কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা মিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিঠি পাঠান।
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরাকে কেন্দ্র করে গোলযোগের আশঙ্কায় ঢাকায় কয়েকটি দূতাবাস তাদের কার্যক্রম সীমিত করেছিল। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে খালেদা জিয়া আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়ে বাসায় ফিরে গেলে রাজনৈতিক উত্তেজনা অনেকটা প্রশমিত হয়। এরই মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে দেখেন কূটনীতিকরা। কিন্তু সেই নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এবং বিএনপির বর্জনের ঘোষণা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে পশ্চিমা দেশগুলো। নির্বাচনী সহিংসতা নিয়েও বেশ কিছু উদ্বেগ জানায়। বছরের শেষ সপ্তাহে পৌরসভা নির্বাচনের দিকে তাদের দৃষ্টি রয়েছে।
সেপ্টেম্বরে ইরান, ফ্রান্স ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ঢাকা সফর করেন। এসবের মধ্যেও সেপ্টেম্বরে নিরাপত্তাঝুঁকির কারণ দেখিয়ে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফর বাতিল করে। এরপর দেশটির একটি নিরাপত্তা দল বাংলাদেশ সফরের সময় ঢাকায় ইতালির একজন নাগরিক দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন। এর কয়েক দিনের মাথায় রংপুরে একজন জাপানি নাগরিক নাগরিক দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আইএসের উত্থান ঠেকাতে বাংলাদেশকে সহযোগিতার আগ্রহ দেখায়। কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে সরকার বিদেশিদের নিরাপত্তায় ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানায়।
গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে নিরাপত্তাঝুঁকির কথা বলে আসছে। তবে ওই দেশগুলোর সঙ্গে অন্য অঞ্চলের দেশগুলোর অবস্থানগত পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট। নিরাপত্তা নিয়ে পশ্চিমা দূতদের ‘বাড়াবাড়ি’কে সন্দেহের চোখে দেখেছেন অন্য অঞ্চলের দূতরাও। তবে অভিজিৎ রায়সহ বেশ কয়েকজন ব্লগার হত্যা, উগ্রবাদীদের উত্থান, হামলার পর আইএসের মতো উগ্রবাদীদের দায় শিকার, হামলার হুমকিতে পশ্চিমা দেশগুলো উদ্বেগ জানিয়ে আসছে।
নভেম্বরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেদারল্যান্ডস সফর করলেও প্যারিস হামলার পর নাজুক নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর ফ্রান্স ও মাল্টা সফর বাতিল করেন।
যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে পাকিস্তানের অনধিকার চর্চাকে ঘিরে টানাপড়েন এ বছর ছিল স্পষ্ট। অতীতের মতো এ বছরও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকরের একেকটি ঘটনায় পাকিস্তান ‘বিরক্ত’ হয়েছে। গত এপ্রিল মাসে জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির পর পাকিস্তান বাংলাদেশকে সামনের দিকে তাকানোর আহ্বান জানায়।
নভেম্বর মাসে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের পর পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া জানালে বাংলাদেশ পাকিস্তানি হাইকমিশনারকে তলব করে প্রতিবাদ জানায়। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান সরকারও বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে কার্যত একাত্তরের গণহত্যাকেই অস্বীকার করে।
মিয়ানমার সীমান্তে ওই দেশটির বাহিনীর দ্বারা বিজিবি আক্রান্ত হয়েছে। মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। যুক্তরাষ্ট্রের সংসদের নিম্নকক্ষের একটি কমিটিতে ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কমিটিতে বাংলাদেশ পরিস্থিতির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মুক্তমত প্রকাশ ও ব্লগারদের নিরাপত্তাহীনতার মতো বিষয় সেখানে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
এদিকে রাশিয়ার সঙ্গে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্পের কাজ পেয়েছে ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠান।-কালেরকণ্ঠ
২৯ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস