মোদির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ রবিশঙ্করের শরণাপন্ন বিএনপি!
রঞ্জন বসু, দিল্লি থেকে : ‘আর্ট অব লিভিং ফাউন্ডেশন’ নামে বিশ্বময় ছড়ানো এক প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ তিনি, সারা দুনিয়ায় তার অনুগামীর সংখ্যা কোটি পেরিয়েছে। শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর নামে পরিচিত এই বিখ্যাত আধ্যাত্মিক গুরুর নতুন পরিচয়, তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং নেপাল সঙ্কট মোকাবিলা থেকে শুরু করে আলফার জঙ্গী নেতাদের আলোচনার টেবিলে টেনে আনা, সবেতেই তিনি ইদানীং প্রধানমন্ত্রীর হয়ে গোপনে মধ্যস্থতা করছেন।
বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি-ও প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে সরাসরি একটা সেতু তৈরি করতে সম্প্রতি রবিশঙ্করের শরণাপন্ন হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুমতি নিয়েই দলের দুজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ভারতে এসে সম্প্রতি রবিশঙ্করের সঙ্গে দেখা করেছেন।
কিন্তু ভারতে একজন আধ্যাত্মিক গুরুর সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক নেতারা কেন দেখা করতে চাইবেন?
এর উত্তর হল, ‘শ্রী শ্রী’ (এ নামেই তাকে ভক্তরা ডাকেন) নিছক একজন সাধারণ ধর্মীয় গুরুদেব শুধু নন। তিনি নিরন্তর কাজ করেন বিশ্বশান্তির জন্য, তার ফাউন্ডেশন সারা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে শান্তির দিশা দেখায়। এমনকী তার ফাউন্ডেশনের শাখা আছে পাকিস্তানের করাচি ও ইসলামাবাদে। যেমন আছে বাংলাদেশের ঢাকাতেও। তিনি বারে বারে ছুটে গেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে, মধ্যস্থতা করেছেন কলম্বিয়া সরকারের সঙ্গে সেখানকার ফার্ক গেরিলাদের আলোচনাতে। আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ বা আমেরিকার বহু রাষ্ট্রপ্রধান নিজেদের দেশের সমস্যায় তার পরামর্শ নিয়েছেন বহুবার।
এমন একজন প্রভাবশালী গুরুকে নরেন্দ্র মোদি যে কাজে লাগাতে চাইবেন সেটাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে শ্রী শ্রী প্রকাশ্যে কখনওই মোদির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাইরে প্রকাশ করেননি, নিজের প্রতিষ্ঠানেও সচেতনভাবে কোনও রাজনৈতিক রং লাগতে দেননি কখনও। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি এটাও বলে থাকেন, তিনি কোনও ব্যক্তি বা দলের হয়ে নয়– কাজ করতে চান ভারতের হয়ে। আর নরেন্দ্র মোদিও এ ব্যাপারে তার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখেছেন।
ঠিক সে কারণেই দিনকয়েক আগে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী তথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী কমল থাপা ভারতে এসে দিল্লিতে না থেমে সোজা ছুটে গিয়েছিলেন ব্যাঙ্গালুরুতে শ্রী শ্রী-র সঙ্গে দেখা করতে। নেপাল তখন সীমান্তে লাগাতার অবরোধের জেরে ফুঁসছে। জ্বালানি তেল থেকে খাবারদাবার সবেরই আকাল। আর ভারতঘেঁষা এলাকায় মদহেশিরা নতুন সংবিধানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন।
সঙ্কট নিরসনের চাবিকাঠি থাকতে পারে রবিশঙ্করের কাছে, এটা আঁচ করেই কমল থাপা সোজা ছুটে গিয়েছিলেন তার কাছে। শ্রী শ্রী-র সঙ্গে তিনি গোপন আলোচনা সেরে দেশে ফেরার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই নেপালের পার্লামেন্ট তাদের সংবিধানে সংশোধন করল। ভারতও স্বাগত জানাল সেই উদ্যোগকে। নেপালে টানা তিন মাস ধরে চলা সঙ্কটের শেষে যে আশার আলো দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে রবিশঙ্করের বড় ভূমিকা আছে বলেই অনেকে মনে করছেন।
শুধু নেপাল নয়, আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আলফা-তে সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন যে অংশটা এখনও শান্তি আলোচনায় যোগ দেয়নি, তাদেরকেও বুঝিয়ে সুঝিয়ে বৈঠকে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন রবিশঙ্কর। এই উদ্যোগটাও সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে এটা ফাঁস করে দিয়েছেন পরেশ বড়ুয়া নিজেই।
মিয়ানমারের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা পরেশ আসামের বাছাই করা জনাকয়েক সম্পাদককে ফোন করে জানিয়েছেন, তিনি রবিশঙ্করের বার্তা পেয়েছেন। কিন্তু আসামের সার্বভৌমত্বের দাবি ছেড়ে তার পক্ষে শান্তি-বৈঠকে সামিল হওয়া সম্ভব নয় সেটাও তিনি পরিষ্কার করে দিয়েছেন। শ্রী শ্রী অবশ্য এত সহজে হাল ছাড়ছেন না বলেই জানা গেছে, তিনি পরেশকে রাজি করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ফলে এহেন শ্রী শ্রী রবিশঙ্করের সঙ্গে বিএনপি কেন যোগাযোগ স্থাপন করতে চাইবে তা বোঝা কষ্টকর নয়। জানা যাচ্ছে, বিজেপির এক প্রভাবশালী নেতাই বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলে এই ‘রবিশঙ্কর রুট’টা নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ভারতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটা সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইলেও সে কাজে এখনও খুব সফল হয়েছে তা বলা যাবে না। ফলে বিজেপিতে শুভাকাঙ্ক্ষী নেতার পরামর্শ মেনেই তারা রবিশঙ্করের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন।
খালেদা জিয়ার সম্মতিতে এরপর দলের দুজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ভারতে এসে শ্রী শ্রী-র সঙ্গে লম্বা বৈঠক করে গেছেন বলেও জানা যাচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং কেন ভারতের বিএনপি-র সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা রাখা দরকার, সে ব্যাপারে তারা শ্রী শ্রী-কে ‘ব্রিফ’ করেছেন বলে জানা যায়।
এই ‘অ্যাসাইনমেন্ট’টা অবশ্য শ্রী শ্রী নিজে থেকে নেননি। এটা তার কাছে নিজে থেকে এসেছে। ফলে এখন রবিশঙ্কর রুটে ভারতে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সাত নম্বর রেসকোর্স রোড থেকে ঢাকার নয়াপল্টনে কোনও নতুন যোগাযোগ চালু হয় কি না, সেটাই হবে দেখার বিষয়! -বাংলা ট্রিবিউন
৩০ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস