আওয়ামী লীগের ফ্যাক্টর ৫০ বিদ্রোহী প্রার্থী!
হাবীব রহমান : বহিষ্কার আর ভয়ভীতি মাথায় নিয়েও ভোটের মাঠে থাকা আওয়ামী লীগের ৫০ বিদ্রোহী প্রার্থীই পৌর নির্বাচনের মূল ফ্যাক্টর। ৩০ পৌরসভায় বিদ্রোহীর কারণে বেশ বেকায়দায় আছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা। এ কারণে গত কয়েক দিনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ওপর চড়াও হতেও দেখা গেছে দলীয় প্রার্থীদের।
সব চাপ, অত্যাচার ও বহিষ্কারের মুখেও নিজস্ব জনপ্রিয়তায় ভর করে যারা জয়ের আশায় বুক বাঁধছেন, তারাই আওয়ামী লীগের গলার কাঁটা। মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় ত্রুটি ও বিদ্রোহী দমনে স্বজনপ্রিয়তার কারণেই এখনো মাঠে এত সংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন বলে মনে করছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একটি সূত্র।
বাগেরহাট পৌরসভায় স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মিনা হাসিবুল হাসান শিপন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার সঙ্গে থাকায় উপজেলা সাধারণ সম্পাদক সরদার মাসুদুর রহমানকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাকে পাঠানো হয়েছে কারাগারে।
পৌর ছাত্রলীগ তার পক্ষে কাজ করায় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি দেয়া হয়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে থাকায় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতিকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সোমবার আগুন দেয়া হয়েছে বিদ্রোহী প্রার্থী শিপনের ব্যবহৃত মাইক্রোবাসে। এত চাপ সত্ত্বেও ভোটযুদ্ধে রয়েছেন মিনা হাসিবুল হাসান শিপন। সুষ্ঠু ভোট হলে তিনি জয়ী হবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
বিদ্রোহী দমনেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি দ্বিমুখী আচরণ করেছে প্রার্থীদের সঙ্গে। বাগেরহাটের প্রার্থীর ওপর এমন কঠোরতা দেখালেও নোয়াখালীর হাতিয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থীকে বহিষ্কার করা হয়নি। উল্টো চিত্র হাতিয়া পৌরসভায়। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইফ উদ্দিনের পক্ষে পৌর ও থানা আওয়ামী লীগের সবাই কাজ করছে। তাদের কাউকেই বহিষ্কার করা হয়নি।
জানা যায়, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল আনম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরীর আশীর্বাদও বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে। জেলার নেতারা মুখে নৌকার কথা বললেও তারা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষেই কাজ করছেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে হাতিয়া আসনের এমপি আয়েশা ফেরদৌস ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট করছেন। উভয় প্রার্থীদের সমর্থকদের মাঝে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ ও গোলাগুলিও হয়েছে। এখানেও ফ্যাক্টর বিদ্রোহী প্রার্থীর জগ মার্কা।
কুষ্টিয়ার ৫ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন ৪ জন। এর মধ্যে মিরপুর পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আতাহার আলী দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন। তিন প্রার্থী এখন পর্যন্ত মাঠে রয়েছেন।
শুক্রবার রাতে পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কুমারখালীতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকরা বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা চালায়। এতে পাঁচজন আহত হন। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী শামসুজ্জামান অরুণের সমর্থক ও বিদ্রোহী প্রার্থী জাকারিয়া খান জেমসের সমর্থকদের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে।
খোকসা পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে ২ জন। দলীয় প্রার্থী খোকসা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক তারিকুল ইসলাম তারিক, বিদ্রোহী প্রার্থী খোকসা উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আল মাসুম মোর্শেদ শান্ত, খোকসা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আলাউদ্দিন পিল্টু।
হামলা-ভয়ভীতি উপেক্ষা করে বরিশাল বিভাগের ১৭ পৌরসভার মধ্যে বরগুনা জেলার দুটি পৌরসভায় আওয়ামী লীগ দলীয় ৩ বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। এর মধ্যে বহিষ্কৃত দু’প্রার্থী হচ্ছেন সদর ও বেতাগী পৌরসভার বর্তমান মেয়র। তাদের দাবি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন। সদর পৌরসভায় আওয়ামী দলীয় প্রার্থী হচ্ছেন কামরুল আহসান মহারাজ।
তার সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন পৌর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক বর্তমান মেয়র শাহাদাত হোসেন এবং জেলা আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত অ্যাডভোকেট শাহজাহান নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। বিদ্রোহী প্রার্থীরা জানান, প্রতীক পাওয়ার পর থেকে মহারাজের কর্মী-সমর্থকরা তাদের প্রচারণা চালানো কর্মীদের ওপর একাধিকবার হামলা চালিয়েছে। এরপরও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারা নির্বাচিত হবেন।
একই অবস্থা বেতাগী পৌরসভায়। সেখানে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন এবিএম গোলাম কবির। তার সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও বর্তমান মেয়র আলতাফ হোসেন। মেয়র আলতাফের দাবি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন।
দলীয় প্রার্থীদের অব্যাহত হামলা, প্রচার কাজে বাধা এবং হুমকি-ধমকির মধ্যেও যশোরের ৩টি পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে। যশোর সদরে বিদ্রোহী হয়েছেন পৌরসভার সাবেক মেয়র এসএম কামরুজ্জামান চুন্নু, চৌগাছায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক এসএম সাইফুর রহমান বাবুল এবং নওয়াপাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হোসেন। তবে এসব বিদ্রোহী প্রার্থী দলীয় প্রার্থীর প্রবল চাপে আছেন। ভোটের হিসাবে ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন তারাও।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সভাপতি ভিপি আবদুর রহিম এ পৌরসভায় ভোটের হিসাবে ফ্যাক্টর হয়ে উঠবেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জন্য।
টাঙ্গাইলের কালিহাতী পৌরসভায় শেষ সময় পর্যন্ত রয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। দলীয় মনোনীত প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনছার আলী বিকম এর পাশাপাশি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হুমায়ুন খালিদও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
জেলার ভূঞাপুর পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পাশাপাশি আরো দু’জন বিদ্রোহী প্রার্থী সক্রিয় রয়েছেন। দলীয় প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও বর্তমান মেয়র মাসুদুল হক মাসুদসহ দলটি থেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আজহারুল ইসলাম ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তারিকুল ইসলাম চঞ্চলও নির্বাচনে লড়ছেন। জেলার ধনবাড়ী পৌরসভায় আওয়ামী লীগ মনোনীত খন্দকার মঞ্জুরুল ইসলাম তপনের সঙ্গে বিদ্রোহী হয়েছেন জহিরুল হক বকুল।
ময়মনসিংহে ৫ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের ৬ জন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। জেলার ত্রিশালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিন সরকারের ছেলে যুবলীগ নেতা জুয়েল সরকারদলীয় প্রার্থী। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান মেয়র আনিসুজ্জামান। গত কয়েকদিন অব্যাহতভাবে আনিসের কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করেছে জুয়েলের লোকজন- এমন অভিযোগ বিদ্রোহী প্রার্থী আনিসের। এরপরও তিনি রয়েছেন ভোটযুদ্ধে।
ফুলপুরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন যুবলীগ সভাপতি শশধর সেন। এখানেও বর্তমান মেয়র মো. শাহজাহান বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন। একই অবস্থা গৌরীপুরেও। এ পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভোটের মাঠে লড়াই করছেন বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক মেয়র শফিকুল ইসলাম হবি। দলীয় প্রার্থীর লোকজনের হুমকির মধ্যে তিনি এখনো নির্বাচনে আছেন বলে জানিয়েছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনি বিজয়ী হবেন বলেও দাবি করেন হবি।
ঈশ্বরগঞ্জে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মাঠে রয়েছেন দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান সুমনের আস্থাভাজন এম এ সাত্তার ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন রিপন। এখানেও বিদ্রোহী প্রার্থীই মূল ফ্যাক্টর।
দুই পৌরসভায় সরে গেলেন বিদ্রোহী প্রার্থী: এদিকে চাঁদপুরের কচুয়া ও জয়পুরহাটের কালাই পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
পৌরসভা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ইকবাল আজিজ শাহীন। সোমবার রাতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নাজমুল আলম স্বপনকে সমর্থন জানিয়ে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।
একই দিন জয়পুরহাটের কালাই পৌরসভার মেয়র পদপ্রার্থী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সাজ্জাদুল রহমান সোহেল তার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণার পর দলীয় প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হালিমুল আলম জনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
৩০ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস