বৃহস্পতিবার, ০৪ জুন, ২০২০, ১২:০৫:১৮

ন্যাশনাল ব্যাংকের টাকা উদ্ধারের গল্প গোয়েন্দা কাহিনীকেও হার মানায়

ন্যাশনাল ব্যাংকের টাকা উদ্ধারের গল্প গোয়েন্দা কাহিনীকেও হার মানায়

নিউজ ডেস্ক: রাজধানীর পুরান ঢাকার ইসলামপুরে ন্যাশনাল ব্যাংকের একটি গাড়ি থেকে ৮০ লাখ টাকা উ'ধাও হয়ে যায়। গাড়িতে ছিলেন চারজন। ব্যাংকের এক কর্মকর্তা, দুইজন সিকি'উরিটি গা'র্ড আর ড্রাইভার। দিনে দুপুরে চারজন মানুষের সামনে থেকে ৮০ লাখ টাকা ভর্তি বস্তা উ'ধাও হয়ে যায়।

কিন্তু গাড়িতে থাকা কেউ কিছুই জানেন না। এ এক অবি'শ্বাস্য ঘ'টনা। সরল চোখে, এটাকে ওই চারজনের কারসা'জি হিসেবে ধ'রে নেওয়া খুবই স্বাভাবিক। ন্যাশনাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গাড়িতে থাকা ওই চারজনকে আসামি করে ডিএমপির কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা করে। তদ'ন্তে নামে থানা পুলিশ। আর ঘ'টনার পরপরই ছায়া তদ'ন্তে নামে ডিএমপির ডিবি দক্ষিণের কোতোয়ালী জোনাল টিম।

গাড়িতে থাকা ওই চারজনের সাথে কথা বলে পুলিশ এটা বুঝতে পারে, টাকাটা গাড়ি থেকে অন্য কেউ স'রিয়েছে। কিন্তু কে সে? কীভাবে করলো? কখন করলো? সাথে কারা ছিল? অন্য কারও ই'ন্ধন আছে কি-না, এসব প্রশ্নের উত্তর জানা যে খুবই দরকার।

বাংলাদেশ পুলিশের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে জানানো হয়, শুরুতেই ঘ'টনাস্থল ধ'রে এগুতে থাকে পুলিশ। টাকা ভর্তি গাড়িটি যেখানে রাখা ছিল তার আশপাশের ভবনে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। শুরু হয় চুলচে'রা বিশ্লে'ষণ। অনেক ফু'টেজ বিশ্লে'ষণের পর একটিতে দেখা যায়, থামানো গাড়ি থেকে এক ব্যক্তি বস্তা নিয়ে রিকশাযোগে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু ওই ব্যক্তির মুখটা অস্প'ষ্ট।

ওই রিকশাটিকে অ'নুসরণ করে সড়কের অন্যান্য ভবনের ফু'টেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। এভাবে প্রায় শতাধিক ফু'টেজ বিশ্লে'ষণে ওই ব্যক্তির মুখের একটি স্প'ষ্ট ছবি পাওয়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কে এই ব্যক্তি? কী তার পরিচয়? পুলিশের কাছে থাকা অপ'রাধীদের ছবির সাথে ওই ব্যক্তির চেহারা মেলাতে শুরু করে পুলিশ। কয়েক হাজার ছবি মেলানোর পর দেখা যায়, টাকার ওই বস্তাটি নিয়ে যাওয়া ব্যক্তির নাম হান্নান।

এবার হান্নানের অবস্থান শ'না'ক্তে পুলিশের তদ'ন্তে যু'ক্ত করা হয় প্রযুক্তির মিশেল। প্রায় ২০ হাজার মোবাইল নম্বর বিশ্লেষণ করার পর হান্নানের একটি মোবাইল নম্বর পায় পুলিশ। তবে নম্বরটি বন্ধ।

পরিস্থিতি বিবেচনায় ভিন্ন কৌ'শল নেয় পুলিশ। সিদ্ধা'ন্ত হয় এমন কাউকে টা'র্গেট করার যিনি হান্নানের অবস্থান জানাতে পারবেন। বিভিন্ন সূ'ত্র থেকে পুলিশ জানতে পারে, হান্নানের চতুর্থ স্ত্রী পারভীনের আলমগীর নামে এক ভাই আছেন। আলমগীরকে জিজ্ঞা'সাবাদ করার সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। কিন্তু মুশ'কিলটা হলো, আলমগীরকে জিজ্ঞাসাবাদের খবর হান্নান জেনে গেলে পুরো পরিশ্রম বৃথা হওয়ার ঝুঁ'কি রয়েছে। এছাড়াও আলমগীর যদি হান্নানের বিষয়ে সত্যি কিছু না জানে, তাহলে পুলিশ তাকে হ'য়রা'নি করেছে -এমন অভি'যোগও উঠতে পারে।

‘প্রতিটি তদ'ন্তে পুলিশকে কিছু না কিছু ঝুঁ'কি নিতেই হয়। এবার তার ব্যতি'ক্রম হয়নি। সম্ভাব্য ঝুঁ'কি মাথায় নিয়েই হান্নানের শ্যালক আলমগীরকে জিজ্ঞা'সাবাদ করে পুলিশ। সে পুলিশের কাছে জানায়, ওই ৮০ লাখ টাকার বিষয়ে তার বোন পারভীন জানেন। পারভীন বর্তমানে ঢাকাতে নেই। সে শরীয়তপুরে আছেন। এমন সংবাদ পেয়ে পুলিশের একটি দল ছু'টে যায় শরীয়তপুর। কিন্তু বাবার বাড়িতে পারভীনকে পাওয়া গেল না। চাচার বাসায় অভি'যান চা'লিয়েও তাকে পাওয়া গেল না। পরবর্তীতে মামার বাড়ি থেকে পারভীনকে গ্রে'ফতার করে পুলিশ।

পুলিশের জিজ্ঞা'সাবাদে পারভীন জানায়, ন্যাশনাল ব্যাংকের ২০ লাখ টাকা তারা ইতোমধ্যেই খরচ করে ফে'লেছেন। বাকি টাকা তার ঢাকার বাসায় আছে। হান্নান বর্তমানে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে আছেন। এদিকে, পারভীনকে নিয়ে পুলিশের দলটি টাকা উ'দ্ধারের জন্য ঢাকার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়।

অন্যদিকে, হান্নানকে ধ'রতে ডিবির আরেকটি দল কিশোরগঞ্জে যায়। শরীয়তপুর থেকে আসা ডিবির দলটি পারভীনকে নিয়ে তার ধোলাইখালের বাসায় অভি'যান চালায়। সেখানে তার বাসার খাটের নিচ থেকে ৬০ লাখ টাকা উ'দ্ধার করে পুলিশ।

এদিকে, কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে হান্নানকে গ্রেফ'তার করে পুলিশ। হান্নান পুলিশের জিজ্ঞা'সাবাদের ৮০ লাখ টাকার নিয়ে যাওয়া ঘ'টনার বিস্তারিত ব'র্ণনা দেয়। হান্নানের ভা'ষ্যমতে, ব্যাংকের টাকার ওই গাড়িটিকে অনেক সময় ধ'রেই ফ'লো করতে থাকে তারা। গাড়িটি ইসলামপুরে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্রাঞ্চের সামনে থা'মিয়ে ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা ও একজন সিকিউ'রিটি গা'র্ড ভেতরে চলে যান।

তখন গাড়িতে ড্রাইভার ও আরও একজন সিকি'উরিটি গার্ড ছিলেন। টাকার বস্তাটি গাড়ির ভেতরে রাখা ছিল। তার সাথে থাকা মোস্তফা, বাবুল মিয়া ও আরও দুই-তিনজন মিলে ড্রাইভার ও সিকি'উরিটি গার্ডের সাথে কথা বলে ভাব জ'মিয়ে ফেলেন। এরপর গাড়ির চালককে কৌ'শলে ব্যাংকের ভেতরে পাঠান। ড্রাইভার গাড়ি রে'খে ভেতরে গেলে তার সহযোগিরা বিভিন্ন কথা বলে সিকি'উরিটি গার্ডকে অন্যমন'স্ক রাখেন। তখন সুযোগ বুঝে গাড়ির দরজা খু'লে টাকার বস্তাটি নিয়ে রিকশাযোগে হান্নান তার বাসায় চলে যান। পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে দলের অন্য সদস্যরাও সেখান থেকে স'রে পড়েন।

হান্নানও পুলিশের কাছে দাবি করেন, ৮০ লাখ টাকার মধ্যে ২০ লাখ ইতোমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে। তার কিছু টাকা দলের সদস্যদের মধ্যে টাকা ভাগবা'টো'য়ারা করেছেন। ঋণ শোধ করেছেন। তার নামে মাম'লাগুলো পরিচালনা করতে খরচ করেছেন এবং মাজারে মানত পূর্ণ করে টাকা দিয়েছেন। তবে, পুলিশ হান্নানের ত'থ্যগুলো খ'তিয়ে দেখছে।

জিজ্ঞা'সাবাদে হান্নান আরও জানান, তার বাসায় অ'স্ত্র আছে। এই ত'থ্যের ভিত্তিতে হান্নানের বাসায় তাকে নিয়ে অভি'যান চা'লিয়ে একটি আ'গ্নেয়া'স্ত্র উ'দ্ধার করা হয়। এছাড়াও তার দেওয়া ত'থ্যের ভি'ত্তিতে দলের সদস্য মোস্তফাকে গ্রেফ'তার করে পুলিশ। এ সময় মোস্তফার বাসায় অভি'যান চালিয়ে আরও একটি আ'গ্নেয়া'স্ত্র ও গু'লি উ'দ্ধার করে পুলিশ।

পরবর্তীতে তাদের দেওয়া ত'থ্যে দলের অপর এক সদস্য বাবুল মিয়াকে গ্রেফ'তার করে পুলিশ। এ ঘ'টনার সাথে যুক্ত বাকি আসামিদের গ্রেফ'তারে পুলিশের অভি'যান অ'ব্যাহ'ত আছে এবং এই দলটির কাছে আরও অ'স্ত্র আছে কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

এভাবেই, টা'না ২১ দিন অক্লা'ন্ত পরিশ্রমে দিন-রাত উ'জাড় করে ঘ'টনার পেছনে লেগে থেকে ন্যাশনাল ব্যাংকের চুরি হওয়া টাকার রহ'স্য উ'দঘা'টন করেছে পুলিশ।

এর আগে, গত ১০ মে রাজধানীর পুরান ঢাকায় বিভিন্ন শাখা থেকে উত্তোলন করা ন্যাশনাল ব্যাংকের ৮০ লাখ টাকার একটি বস্তা গাড়ি থেকে খো'য়া যায়। দিনে দুপুরে ঘ'টে যাওয়া ওই চা'ঞ্চল্য'কর ঘ'টনায় কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা করে ন্যাশনাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

সোমবার (১ জুন) দিবাগত রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অভি'যুক্ত ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মো. হান্নান ওরফে ব্রিফকেস হান্নান ওরফে রবিন ওরফে রফিকুল ইসলাম, মো. মোস্তফা, মো. বাবুল মিয়া ও মোছা. পারভীন। তাদের হে'ফা'জত থেকে উ'দ্ধার করা হয় ৬০ লাখ টাকা ও দুটি বিদেশি পি'স্ত'ল।

মঙ্গলবার (২ জুন ২০২০) সকালে ডিবি কার্যালয়ে গোয়ে'ন্দা পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম প্রেস ব্রি'ফিং'য়ে বলেন, গত ১০ মে রাজধানীর পুরান ঢাকায় বিভিন্ন শাখা থেকে উত্তো'লন করা ন্যাশনাল ব্যাংকের ৮০ লাখ টাকার একটি বস্তা গাড়ি থেকে খো'য়া যায়।

দায়ের করা ওই মামলাটি কোতয়ালী থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়ে'ন্দা পুলিশের কয়েকটি টিম ছায়া তদ'ন্ত শুরু করে। তদ'ন্তের এক পর্যায়ে বিভিন্ন ত'থ্য-উপা'ত্ত বিশ্লে'ষণ করে সোমবার দিবাগত রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেফ'তার করা হয়।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে