নিউজ ডেস্ক : মহামা'রি করোনাভাইরাসে বিপর্য'স্ত গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশেও পড়েছে করোনার থা'বা। দেশে প্রতিদিনই করোনা কে'ড়ে নিচ্ছে প্রায় অর্ধশত মানুষের প্রাণ। শুরুতে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিয়ে নানা ধরনের অভি'যোগ থাকলেও এরই মধ্যে আ'ক্রান্তদের সুস্থ করতে গিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন অনেক চিকিৎসক। স্বাস্থ্যসেবার নানা অপ্রতুলতার মধ্যেও দিনরাত তারা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। করোনাকালে মানবসেবায় স্থাপন করছেন অনন্য দৃষ্টান্ত। এমনই একজন করোনাযোদ্ধা নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. নিজাম উদ্দিন মিজান।
হাতিয়া একটি বিচ্ছিন্ন উপজেলা। চারিদিকে মেঘনা নদী ও চর বেষ্টিত। তাই সেখানে চিকিৎসা সেবা দিতে সংশ্লিষ্টদের একটু বেশি কষ্ট করতে হয়। তার ওপর করোনার প্রা'দুর্ভাব। এর মধ্যেই দিনরাত সমান তালে কাজ করে যাচ্ছেন হাতিয়ার চিকিৎসকরা।
গত মঙ্গলবারও (২৩ জুন) তার ব্যতিক্রম ছিল না। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. নিজাম উদ্দিন মিজান সঙ্গীদের নিয়ে বিকেল থেকে শুরু করেন করোনা আক্রান্তদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওষুধ সরবরাহ, নতুন পজিটিভ আসা রোগীদের বাড়ি খুঁ'জে খুঁ'জে লকডাউনের কাজ। এভাবে তিন বাড়িতে চিকিৎসাসেবা দেয়ার পর এক বাড়িতে গিয়ে দেখতে পান রবিউল নামে একজন প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। অক্সিজেনের মাত্রা মাত্র ৩৫ শতাংশ। সঙ্গে থাকা একজনকে পাঠিয়ে দিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসার জন্য। অক্সিজেন সিলিন্ডার আসার পর অক্সিজেন দেয়া হলো রোগীকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অক্সিজেনের মাত্রা উঠে এলো ৯৬ শতাংশে ।
অক্সিজেন সরিয়ে নেয়ার পরই সমস্যা দেখা দিলো। রোগীর অক্সিজেনের মাত্রা সঙ্গে সঙ্গে নামতে লাগলো। বাইরে থেকে অক্সিজেন দিলে রোগী ভালো থাকে, সরিয়ে নিলেই দ্রুত নেমে আসতে থাকে। এই রোগীকে বাসায় রাখা মানে মৃ'ত্যু নিশ্চিত- এই ভেবে রোগীকে উপজলো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসার সি'দ্ধান্ত নেয়া হয়। হাসপাতালে নিয়ে এসে ওই রোগীকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে কেটে গেল আরও কয়েক ঘণ্টা ।
রাত তখন ১১টা। সারাদিন দুর্গম চরাঞ্চল এলাকা থেকে আসা মানুষের চিকিৎসাসেবা দিয়ে অনেকটা ক্লান্ত ডা. নিজাম উদ্দিন মিজান। শরীর কোনো কাজে সায় দিচ্ছে না। গায়ের পিপিই খুলে একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য যখন চেষ্টা করছেন ঠিক তখনই তার কাছে খবর এলো নিচে একজন রোগী এসেছেন। তার অবস্থা ভালো না।
পিপিই পরেই নিচে নেমে গেলেন ডা. নিজাম। দেখলেন হাসপাতালের সামনে রাস্তায় এক কিশোর তার নিথর বাবাকে কোলে নিয়ে রাস্তায় বসে আছে। কাঁ'দতে কাঁ'দতে সাহায্য চাইছে সবার। তার বাবাকে বাঁ'চানোর জন্য আর্তনাদ করছে সে। আশেপাশে অনেকেই দাঁ'ড়িয়ে আছে। কিন্তু কেউই সাহায্য করছে না।
ডা. নিজাম দ্রুত গিয়ে রোগীর নাড়ি চেক করলেন। পালস নেই। রোগীকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে সিপিআর দেয়া শুরু করলেন তিনি। একটা সময় পরে গিয়ে পালস পেলেন। তখনও সিপিআর চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সারাদিনের ক্লা'ন্তির পর এই কষ্টকর কাজটা করার জন্য শক্তিটুকুও যেন অবশিষ্ট নেই তার। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বিকেল থেকে পিপিই পরা, মুখে এন ৯৫ মাস্ক। ক্লান্তির সঙ্গে শ্বাস নিতেও অসুবিধা হচ্ছিল তার। একটা সময় পরে গিয়ে আর পারেন না তিনি।
ডা. নিজাম ক্লান্ত হয়ে থেমে যেতেই কিশোর ছেলেটা দায়িত্ব নেয়। পাশে থেকে দেখে বুঝে গেছে কীভাবে সিপিআর দিতে হয়। বাবাকে বাঁ'চানোর চেষ্টায় ক্রমাগত সিপিআর দিয়ে চলে সে। পাশে বসে রোগীর দিকে নজর রাখছিলেন ডা. নিজাম। হঠাৎ করেই রোগীর চোখ স্থির হয়ে গেল। এটা দেখেই দ্রুত পালস চেক করলেন তিনি। পালস নেই। তার চোখের সামনেই রোগী চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ছেলেটা তখনও সিপিআর দিয়ে চলেছে। ওর কাঁ'ধে আলতো করে হাত রাখলেন তিনি। ডাক্তারের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ছেলেটা, তারপর বাবার মুখের দিকে। স্থির হয়ে গেল তার হাত দুটো।
করোনাযো'দ্ধা ডা. নিজাম উদ্দিন মিজান বলেন, প্রা'ণপণ চেষ্টা করেও পঞ্চাশোর্ধ্ব পবন দাসকে বাঁচাতে পারিনি। কারণ আমাদের হাসপাতালে ভেন্টিলেটর সুবিধা নেই। ভেন্টিলেটর থাকলে হয়তো তাকে বাঁচানো যেত। তিনি বাঁচলে নিজেও স্বস্তি পেতাম।
ডা. নিজাম উদ্দিন মিজান জানান, গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর তিনি হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যোগ দেন। তিনি ৩৯তম বিএসএসে সরকারি চাকরি পান। মানব সেবার ব্রত নিয়ে এ পেশায় এসেছেন। জন্মস্থান নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার আমিশাপাড়া ইউনিয়নের পদিপাড়া হলেও ঢাকাতেই লেখাপড়া করেছেন। তবে দুর্গম হাতিয়া উপজেলা কর্মস্থল হলেও এখানে তার চিকিৎসাবসেবা দিতে কোনো কষ্ট হয় না। তবে কষ্ট লাগে যখন প্রাণপণ চেষ্টা করেও কাউকে বাঁ'চাতে পারেন না।