মঙ্গলবার, ০৫ জানুয়ারী, ২০১৬, ০২:৫৯:০৫

১৮ ফাটলের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

১৮ ফাটলের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

তৌফিক মারুফ ও রফিকুল ইসলাম : বাংলাদেশের ভেতরেই ভূস্তরে বড় ধরনের পাঁচটি সক্রিয় ফাটল বা চ্যুতি রয়েছে। পাশাপাশি আরো ছোট ছোট ১৩টি ফাটলের অস্তিত্বও মিলেছে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে। ছোট ফাটলগুলো থেকেই ৬.৫ থেকে ৭.৪ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। আর বড় ফাটলগুলো জন্ম দিতে পারে আরো শক্তিশালী কম্পন। এমন ভয়ানক তথ্য জানিয়েছেন ভূতাত্ত্বিক ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা। আর অবস্থানগত কারণেই পার্শ্ববর্তী এলাকায় সংঘটিত যেকোনো ভূমিকম্পের প্রভাব বাংলাদেশের ওপর সব সময়ই পড়বে বলে জানান তারা। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা এখনো দেশে গড়ে ওঠেনি। তবে আতঙ্ক নয়, সবাই বলছেন, উপযুক্ত সচেতনতা ও নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ের অধ্যাপক এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল গতকাল রাতে বলেন, ভয়াবহতার তথ্য আতঙ্কিত হওয়ার মতো হলেও এখন সচেতন হতে হবে কিভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে, জানমাল রক্ষা করা যাবে সে ব্যাপারে। ওই বিশেষজ্ঞ জানান, মূল হিমালয়ের প্রধান চ্যুতিটির সঙ্গে দেশের ভেতরেই এখন কমপক্ষে পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ ফাটল রয়েছে এবং এর সবগুলোই সক্রিয়। এর মধ্যে আগে থেকেই ডাউকি ও মধুপুর চ্যুতি বা ফল্ট নিয়ে ব্যাপক আশঙ্কা ছিল এবং আছে। বাকি তিনটি হলো চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা বেল্ট ফল্ট, চট্টগ্রাম-রামরি ফল্ট ও সিলেট-আসাম ফল্ট। সবগুলোই সক্রিয়। এর বাইরে ছোটখাটো আরো ১৩ চ্যুতি বা ফাটলের উপস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি বলেন, ঢাকায় যেভাবে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে নগরায়ণ হচ্ছে, বাড়িঘর-ভবন উঠছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ পুরনো ভবনগুলো বহাল রয়েছে, সেগুলো মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের জন্যই বিপজ্জনক। এ ক্ষেত্রে দেশের ভেতরে না হয়ে পার্শ্ববর্তী কোথাও শক্তিশালী ভূমিকম্প হলেও এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। ভূতাত্ত্বিক ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্প কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। এমনকি কখন তা ঘটবে তাও নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে কোন অঞ্চলে অনুভূত হতে পারে এমন বিষয়ে গবেষণা চলছে। ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রয়োজন ব্যাপক প্রস্তুতি ও পরিকল্পিত অবকাঠামো। কিন্তু সে তুলনায় বাংলাদেশে প্রস্তুতি মোটেও পর্যাপ্ত নেই। উদাহরণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক রানা প্লাজা ধসের পর উদ্ধারকাজে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়েছে। উদ্ধারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে ধার নিতে হয়েছে। কিন্তু ভূমিকম্পে একাধিক ভবন ভেঙে পড়লে পরিস্থিতি মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশে মাঝারি আকারের ভূমিকম্প হলেও ঢাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ভূতাত্ত্বিক ও ভূগাঠনিক কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ। সোমবার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৩৫২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। সেটি ভূ-অভ্যন্তরের যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত ছিল, তার কম অংশই ছেড়েছে। বড় অংশ এখনো রয়ে গেছে। যেকোনো সময় বড় আকারে তা আঘাত হানবে। এই অধ্যাপক বলেন, বাংলাদেশ যে পরিমাণ ঝুঁকিতে রয়েছে, সে তুলনায় প্রস্তুতি খুবই নগণ্য। রানা প্লাজা ধসের সময় উদ্ধারকাজে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উদ্ধারকাজের যন্ত্রপাতি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভূমিকম্পে ১০টি ভবন ভেঙে পড়লে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে। ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারকাজের প্রশিক্ষণ দিয়েছে সরকার। কিন্তু ভূমিকম্পের সময় কিভাবে জীবনরক্ষা করতে হবে সে বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। এটি সরকারের একটি ভুল সিদ্ধান্ত। যে কাজটি আশু করা দরকার সেটির বিষয়ে সরকার এখনো নির্লিপ্ত। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় মানুষকে সচেতন করতে হবে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন বলেন, ‘বাংলাদেশ খুবই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। প্রতিবেশী দেশে তিনটি ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা রয়েছে। এই রেখা সংঘর্ষের দিকে যাবে—বিজ্ঞানীদের এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। আর সংঘর্ষ হলেই ভূমিকম্প হবে। কিন্তু ভূমিকম্পপ্রবণ দেশে যেসব প্রস্তুতি থাকে আমাদের দেশে তা নেই। অনিয়ন্ত্রিতভাবে, বিল্ডিং কোড না মেনে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। ভবনকে ভূমিকম্প থেকে মুক্ত করতে রেকটো ফিটিং পদ্ধতি রয়েছে। তবে তা খুব ব্যয়বহুল। জাপানে অবকাঠামো তৈরি করা হয় ভূমিকম্পকে বিবেচনায় রেখে। যাতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়।’ এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ঢাকায় মাঝারি আকারের ভূমিকম্প হলেও ক্ষয়ক্ষতি হবে ব্যাপক। এখানে ইউটিলিটি সার্ভিসগুলো মাটির ওপর দিয়ে। যেমন—গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন। এসব ক্ষেত্রে ক্ষতির মাত্রা বেশি হবে। সর্বোপরি জনগণকে সচেতন করতে হবে। ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে সরকারকে পরিকল্পনা করতে হবে। ড. মাহবুবা নাসরিন বলেন, আমেরিকায় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নিয়ে গবেষণা চলছে। কিন্তু তা হয়তো সম্ভব হবে না, কিন্তু কোন অঞ্চলে ভূমিকম্প হতে পারে সেই বিষয়টি জানা যাবে। অন্তত এটি হলেও কিছুটা সতর্ক থাকতে পারবে মানুষ। আরো একাধিক বিশ্লেষণে বলা হয়, মধ্য এশীয় টেকটোনিক প্লেটের (বিশাল ভূখণ্ড) নিচে ভারতীয় প্লেট অতি ধীরে ধীরে ঢুকে যাওয়ার ফলে হিমালয় অঞ্চলের পর্বতগুলো তৈরি হচ্ছে। প্রতিবছর দুই ইঞ্চি করে এই প্লেট দুটি পরস্পরের দিকে সরে আসছে। এর ফলে প্রচণ্ড এনার্জি সৃষ্টি হয়। আর বারবারই এ অঞ্চলে ভূমিকম্প হতে থাকে। ১৯৩৪ সালে বিহারে ৮ দশমিক ১ এবং ২০০৫ সালে কাশ্মীরে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার দুটি ভূমিকম্পে এক লাখেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। এই দুটি ভূমিকম্পের প্রভাবে বাংলাদেশেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এ ছাড়া মাঝে মধ্যে চীনে বড় ধরনের ভূমিকম্পে অনেক সময় বাংলাদেশও ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে। -কালের কণ্ঠ ৫ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে