ভূমিকম্পের সময় ও পরে যা করা উচিত
আবু এন. এম. ওয়াহিদ: যে দেশেই থাকি না কেন, মানুষ হিসেবে আমরা বিভিন্ন রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সময় সময়
মোকাবেলা করে থাকি। তার মধ্যে কিছু কিছু আছে ছোট খাট এবং মামুলি ধরণের - যেমন বৃষ্টি,
তুষারপাত, উষ্ণ প্রবাহ, শৈত্য প্রবাহ ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে কারোরই তেমন মাথা ব্যথা নেই,
কারণ এতে আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় একটু আধটু অসুবিধা হয় বটে, কিন্তু আমরা কোনো
রকম মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হই না। সমস্যা হল, প্রকৃতি যখন রাগে, দুঃখে, অথবা হতাশায়
বিগড়ে যায়, তখন সে বিশাল শক্তিতে উশৃঙ্খল বেশে পানি, মাটি, এবং বাতাস কাঁপিয়ে পৃথিবীর
কোনো কোনো অঞ্চলের ওপর ফেঁটে পড়ে। তখন ওই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ, পশুপাখি, এবং
গাছপালার ওপর নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। বিভিনড়ব অঞ্চলে প্রকৃতির এ ধরণের ধ্বংসাত্মক
আচরণের আমরা বিভিনড়ব নাম দিয়েছি - যেমন হ্যারিকেন, টাইফুন, টর্ণেডো, সাইক্লোন, বন্যা,
সুনামি, আগেড়বয়গিরির অগড়বুৎপাত, ভূমিকম্প, ইত্যাদি। এদের মধ্যে ভূমিকম্পের একটা পার্থক্য এবং
বিশেষত্ব আছে। এটা অতর্কিতে আঘাত হানে এবং অল্পক্ষণ স্থায়ী থেকে চলে যায়। এর বিনাশী
শক্তি এতই বেশি, যে আধা মিনিট এক মিনিটের ধকল সামলাতেই কী উনড়বত কী অনুনড়বত দেশে
মানুষের রীতিমত ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বড় ভূমিকম্পের আলামত পাওয়া যায় তার আগের ছোট ছোট
ভূমিকম্প থেকে। আবার বড় ভূমিকম্পের পরেও ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়, যেগুলোকে ইংরেজিতে
বলে ‘আফ্টার শক’।
বড় ভূমিকম্পের আলামত আগে পাওয়া গেলেও, তার রুদ্ররূপে আত্মপ্রকাশের প্রকৃত দিনক্ষণ
কোনো অবস্থাতেই আগাম বলা যায় না। যেহেতু এটা অল্পক্ষণ স্থায়ী থাকে এবং এর শক্তি ও
ধ্বংসলীলা সবচেয়ে বেশি, তাই ভূমিকম্পের সময় মানুষ স্বাভাবিকভাবেই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে
ফেলে এবং কী করবে না করবে কিছুই ভেবে পায় না। তাই ভূমিকম্প আঘাত হানার আগেই
জনগণকে জানতে হবে ওই সময় এবং এর অব্যবহিত পরে তাদের কী করা উচিৎ এবং কী থেকে
বিরত থাকা উচিৎ। এ উদ্দেশ্যেই আমার আজকের এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
১. ভূমিকম্প আঘাত হানার সময় যারা ঘরে থাকবেন তাদের করণীয়
প্রমতঃ দিশেহারা না হয়ে, ঠান্ডা মাথায় ধীর, স্থির, এবং শান্ত হয়ে থাকুন। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে
আহাজারি এবং কানড়বাকাটি করলে মাথা ঠিকমত কাজ করবে না, এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে
সময়মত সঠিক কাজটা করতে পারবেন না। একটা কথা মনে রাখবেন, সময় অতি অল্প,
এবং একটা সামান্য ভুলের কারণে মূল্যবান জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে অনেক গুণ।
তাই ভূমিকম্পের সময়, ধীর স্থির থাকা অত্যন্ত জরুরি।
ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি টের পাওয়ার সাথে সাথে চৌকি, খাট, পালঙ্ক, অথবা টেবিলের নিচে
আশ্রয় নিন। ওই রকম সুবিধা না থাকলে বালিশ, কাাঁ কম্বল, লেপ অথবা হাত দিয়ে মুখ
এবং মাথা যতটুকু সম্ভব ঢেকে ঘরের ভেতরের দিকে কোনো কোণে অথবা হলওয়েতে গিয়ে
ভেতরের দেয়ালের পাশে বসুন। জানালা, বাইরের দরজা এবং দেয়াল, আয়না, গ্লাস, সিলিং
ফ্যান, লাইট ফিক্সার, ভারী ফার্ণিচার, এবং অ্যাপ্লায়েন্স সমূহ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন।
ভূমিকম্পের সময় রানড়বাঘর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা। রানড়বাঘর থেকে সবাইকে সাথে সাথে
সরিয়ে নিন। ভূমিকম্পের সময় সিঁড়ি বেয়ে ওপর নিচ করবেন না। ওই সময় ঘর থেকে
বেরোবার চেষ্টা করবেন না। মনে রাখবেন, ভূমিকম্পের সময় জীবনের জন্য সবচেয়ে
ঝুঁকিপূর্ণ এবং মারাত্মক কাজ হলো অস্থির হয়ে ঘরের ভেতরে ছুটোছুটি করা কিংবা ঘর থেকে
বেরোবার চেষ্টা করা। বড় এবং উঁচা বিল্ডিংএ থাকলে লিফ্ট ব্যবহার করা থেকে বিরত
থাকুন। মনে রাখবেন ভূমিকম্পের কারণে বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহ চলে যেতে পারে, ফলে
বিল্ডিংএর লিফ্ট, ফায়ার এলার্ম, এবং পানির ¯িপ্রঙ্কলার কিছুই কাজ করবে না।
২. ভূমিকম্প আঘাত হানার সময় যারা ঘরের বাইরে থাকবেন তাদের করণীয়
দালানকোঠা, পাওয়ার লাইন, লাইট পোস্ট, বিদ্যুতের খাম্বা, বড় গাছপালা, ইত্যাদি থেকে
নিরাপদ দূরত্বে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকুন। গাড়িতে থাকলে সাথে সাথে গতি কমিয়ে
রাস্তার ডান অথবা বাঁদিকে সরে ট্রাফিক থেকে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে গাড়ির
ভেতরে বসে থাকুন। গাড়ি কখনো ব্রিজের ওপর, আন্ডার পাসের নিচে, বড় গাছের নিচে,
লাইট পোস্ট, পাওয়ার লাইন, অথবা সাইন সিগন্যালের কাছে পার্ক করবেন না। ভূমিকম্পের
ঝাঁকুনি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি চালাবেন না বা গাড়ি থেকে বেরোবেন না। আবার যখন
গাড়ি চালাবেন তখন খেয়াল রাখবেন, রাস্তায় কোথাও ফাঁটল, কিংবা বাম্প আছে কিনা।
রাস্তায় বড় পাথর অথবা গাছপালা পড়ে আছে কিনা। ব্রিজে ওঠার আগে নিশ্চিত হয়ে
নেবেন গাড়ি নিয়ে ব্রিজ পারাপার নিরাপদ কিনা।
৩. ভূমিকম্প আঘাত হানার সময় যারা পাহাড়ী অঞ্চলে থাকবেন তাদের করণীয়
খেয়াল রাখবেন ভূমিধ্বস, গাছপালা, কিংবা পাথর নড়বড়ে হয়ে আপনার ওপর পড়তে পারে
কিনা। পাহাড় থেকে বেরোবার পথ যদি গাছপালা, পাথর, অথবা মাটি পড়ে বন্ধ হয়ে যায়, তবে
অচেনা অজানা পথে ফেরার চেষ্টা না করে, বাইরের সাথে যোগাযোগ করুন, সাহায্য জন্য
অপেক্ষা করুন।
ভূমিকম্পের অব্যবহিত পরের করণীয়
ভূমিকম্প চলে যাওয়ার পর আফ্টার শকের জন্য প্রস্তুত থাকুন। আফ্টার শকের কারণে
ভূমিকম্পের সময় নড়বড়ে হওয়া জিনিস পত্র ও ডেবরি যত্রতত্র ভেঙ্গে পড়তে পারে তার দিকে নজর
রাখুন। আফ্টার শক কয়েক ঘন্টা, কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ, এমন কী কয়েক মাস পর্যন্ত চলতে
পারে। ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকে পড়া লোকদের নিজের সাধ্যমত সাহায্য করার চেষ্টা করুন। ঘর
বসবাসের অনুপযোগী হলে দেরি না করে রেরিয়ে পড়ুন। থাকার যোগ্য হলে ধুলো বালি, ডেবরি
ইত্যাদি পরিষ্কার করুন। কিচেন ক্যাবিনেট সাবধানের সাথে খুলুন। পান করার জন্য নিরাপদ কিনা
নিশ্চিত না হয়ে, টেপের পানি খাবেন না। বোতলের পানি ব্যবহার করুন। ঘরে বরফ থাকলে
গলিয়ে বোতলে ভরে রাখুন। শেল্ফ থেকে ভারি জিনিসপত্র যে কোনো সময় পড়তে পারে, সে দিকে
নজর রাখুন। রেডিওতে সরকারী ঘোষণা শুনে বোঝার চেষ্টা করুন কোথায় কী হয়েছে। সাগর
অথবা বড় লেকের পারে থাকলে সুনামি আসছে কিনা তা জানার চেষ্টা করুন। সুনামির ঘোষণা
থাকলে জলরাশি থেকে দ্রুত উঁচু জায়গায় সরে পড়–ন। প্রতিবেশীদের সাহায্য দরকার হলে তাদের
সাধ্যমত সাহায্য করুন। অতিরিক্ত জখম এবং ক্ষতি হওয়ার ভয় না থাকলে, পেশাগত সাহায্য ছাড়া
মারাত্মভাবে জখম হওয়া কাউকে ধরা বা সরাবার চেষ্টা করবে না। কারণ এতে আপনি তার উপকার
করতে গিয়ে আরো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারেন। গ্যাস, ফিউম, অথবা ক্যামিক্যালের গন্ধ
পেলে ঘর থেকে বেরিয়ে অন্যত্র নিরাপদ জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিন।
গ্যাস লাইন অফ্ থাকলে অন করবেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত না হয়েছেন যে কোনো গ্যাস লিক
নেই, ততক্ষণ পর্যন্ত ঘরের ভেতর দিয়াশলাই, সিগারেট লাইটার, চুলো জ্বলাবেন না এবং কোনো
প্রকার বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি চালাবেন না। এ নিশ্চয়তার জন্য গ্যাস কোম্পানির লোকদের জন্য
অপেক্ষা করুন। মেডিক্যাল এবং ফায়ার ইমার্জেন্সি ছাড়া টেলিফোন ব্যবহার করবেন না। কোনো
রকম বাইরের সাহায্য দরকার হলে সংশ্লিষ্ট স্থানে সরজমিন লোক পাঠাবেন। ধ্বংসস্তুপের নিচে
আটকা পড়লে, দিয়াশলাই জ্বালানো নিষেধ। বের হওয়ার জন্য ধ্বংসস্তুপের মধ্যে লাথি মারবেন না
বা ধাক্কা ধাক্কি করবেন না। নাক মুখ রুমাল অথবা পরিস্কার কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখুন। সাথে থাকলে
হুইসেল বাজাবেন, যাতে উদ্ধার কর্মীরা আপনাকে লোকেট করতে পারে। হুইসেল না থাকলে,
কোনো মেটেল পাইপ, অথবা শক্ত অন্য কোনো কিছুর ওপর আঘাত করতে থাকুন যাতে উদ্ধার
কর্মীরা বুঝতে পারে আপনি কোথায় আছেন। অন্য কোনো উপায় না থাকলে শেষ সম্বল হিসেবে মুখ
দিয়ে চিৎকার করবেন, অন্যথায় নয়। কারণ তাতে আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়বেন এবং অহেতুক চিৎকার
করলে নাক মুখ দিয়ে বিষাক্ত ডেবরি, ধুলো-বালি ফুসফুসে ঢুকে যেতে পারে।
নিজের এবং পরিবারের অন্যান্যদের শরীর ভাল করে দেখে নিন কোথাও কোনো ধরণের জখম
হয়েছে কিনা। জখম হয়ে থাকলে প্র মে ফার্স্ট এইড দিন এবং তারপর তড়িৎ চিকিৎসা সেবার
ব্যবস্থা করুন। ঘরে বয়স্ক, অসুস্থ, প্রতিবন্ধী, কিংবা শিশু থাকলে তাদের প্রয়োজনের দিকে নজর
দিন। ঘরের ভেতরে এবং বাইরে কোথায় কী কী ক্ষতি হয়েছে তা ভাল করে পরখ করে দেখুন।
পানি, গ্যাস, এবং বিদ্যুৎ লাইনে কোনো লিক অথবা কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা নিশ্চিত করুন।
লিক বা টোটা ফাঁটা ধরা পড়েেল তা সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করুন এবং যত শিগ্গির
সম্ভব মেরামতের ব্যবস্থা করুন। পরিবারের কোনো সদস্য বাইরে থাকলে কে কোথায় কিভাবে
আছেন তার খোঁজ খবর নিন।
এসব প্রস্তুতির কথা সরকারী এবং বেসরকারী রেডিও ও টিভি চ্যানেল, জাতীয় পত্রিকা, স্কুল কলেজ,
মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, গীর্জা, পেশাজীবি সংগঠন সমূহের সভা সমাবেশ, গণজমায়েত ও
রাজনৈতিক সমাবেশের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া উচিৎ। এ প্রসঙ্গে সবারই একটা কথা
মনে রাখা উচিৎ, এ প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে একটা জীবনও যদি রক্ষা পায়, তাইবা কম কী ?
আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কোরআন শরীফে বলেননি ? “.. যে ব্যক্তি একটা জীবন বাঁচাল, সে যেন সমস্ত
মানব জাতিকেই বাঁচাল...”।
লেখক: অধ্যাপক - টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি
৫ জানুয়ারি, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস
�