বুধবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২১, ১১:০৩:২২

‘উই অল আর প্রাইম মিনিস্টার’স ম্যান’

‘উই অল আর প্রাইম মিনিস্টার’স ম্যান’

লীনা পারভীন , কলামিস্ট: আল জাজিরা নামটি বাংলাদেশে প্রথম বেশি করে আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এর আগে এই চ্যানেলের নাম এদেশে কয়জন জানত সেটি গবেষণার বিষয়। কেন আলোচিত এই চ্যানেল? কাতারভিত্তিক একটি টিভি চ্যানেল যেটি কাতার সরকারের অর্থায়নে চলে তাকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের এত আলোচনার কারণ কী? চলুন একটু উত্তর খুঁজি। অনুসন্ধানী সাংবাদিক না হতে পারি কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমার একটি অনুসন্ধানী মন আছে যা আমাকে মগজ খাঁটাতে বাধ্য করল। এই উত্তরের সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি সরাসরি না হলেও সম্পর্ক আছে। কী সেই সম্পর্ক?

আমরা সবাই জানি যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল পাকিস্তানের শাসন, শোষণ ও নীপিড়নের বিরুদ্ধে। সেই যুদ্ধটি ছিল স্বাধিকার আদায়ের লড়াই যে লড়াইয়ে বাংলার মানুষ জয়ী হয়েছিল। আর সেই মুক্তির লড়াইয়ের সর্বাধিনেতা ছিলেন একজন, নির্দেশক ছিলেন একজন যার এক অঙ্গুলি ইশারায় সেদিন আপামর জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। জীবন দিয়েছিল ৩০ লাখ জনতা, ধর্ষণের শিকার হয়েছিল দুই লাখ মা-বোন, যাদের আমরা বীরাঙ্গনা নামে চিনি। ভালোবেসে সেই নেতার নাম দিয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু’ যাকে আমরা জাতির পিতা নামে স্বীকৃতি দিয়েছি। অভাগা জাতি আমরা সেই জাতির পিতাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ ও আন্তর্জাতিক চেনা-অচেনা শত্রুদের মদতে এদেশীয় এজেন্টরা সেদিন বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করেছিল। সেই হত্যার কারণ আমরা সবাই জানি।

 আল জাজিরার কেন বাংলাদেশকে নিয়ে এত আগ্রহ? এর উত্তরটাও লুকিয়ে আছে আমার উপরের আলোচনায়। আসল কারণটা হচ্ছে আল জাজিরা কাজ করছে জামায়াতে ইসলামীর আন্তর্জাতিক মিডিয়া পার্টনার হিসেবে। 

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন, শপথ নিলেন পিতা হত্যার বিচারের, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছিল ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিল আমাদের সূর্যসন্তানদের। হত্যার উৎসবে মেতেছিল সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে। কারা তারা? সেই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নেতারা ছিল সেই হত্যাকাণ্ডের পেছনে। পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামসের ব্যানারে। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল কেবল ৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেন। হাতে নিলেন ৭১ এর হত্যার বিচারের কাজে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শুরু হলো বিচারকার্য। প্রথম দফায় না পারলেও দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেই তিনি বিচারকার্যকে ত্বরান্বিত করলেন।

২০১৩ সাল তেমনি একটি সাল। সেই সালের ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ থেকে সারাবিশ্বের বাঙালিরা জেগেছিল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে। স্থাপিত হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। সেই মঞ্চে সামিল হয়েছিল নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সবাই। একে একে ফাঁসি কার্যকর হতে থাকল। কোমর ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ল জামায়াতে ইসলামী। তাদের পিতা পাকিস্তানও তাদের রক্ষা করতে পারছিল না। মাথা খারাপ হতে থাকল জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের। বিদেশি লবিস্ট নিয়োগ করল কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। কে সেই লবিস্ট? প্রমাণিত একজন লবিস্টের নাম ডেভিড বার্গম্যান। যার সূত্র ধরেই আন্তর্জাতিক মিডিয়া পার্টনার হিসেবে সিনে এলো আল জাজিরা নামের এক টেলিভিশন চ্যানেল। তারা সত্য-মিথ্যার রূপে একের পর এক বানোয়াট সংবাদ ও ডকুমেন্টারি প্রচার করতে থাকল। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার বা আন্তর্জাতিক মহলে হেয় করার উদ্দেশে এমন কোনো উদ্যোগ নেই যা নেয়নি। ৫ মে শাপলাচত্বরে হেফাজতের তাণ্ডবের কোনো সংবাদ না দিলেও বার্গম্যানের সহায়তায় গুজব ছড়িয়েছিল শত শত মৃত্যুর অথচ সেদিন কোনো হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি আজও।

এভাবেই ব্যর্থ হয়েছিল তাদের সকল প্রচেষ্টা। তাই বলে কি বসে থাকছে তারা? একের পর এক চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার কথা মনে করা যেতে পারে। শেখ হাসিনাকে হত্যা করার চেষ্টা কেবল একবার নয়, করা হয়েছে বারবার। কেন? এত ক্ষোভ কেন একজন শেখ হাসিনার ওপর? তিনি বঙ্গবন্ধু-কন্যা বলে? তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন বলে? যুদ্ধাপরাধের বিচার করে ইতিহাসের দায়মুক্তির উদ্যোগ নিয়েছেন বলে? বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে তলাবিহীন ঝুড়ির বদলে বাহারি ফলমূলের সাজানো একটু বাস্কেট হিসেবে প্রমাণ করেছেন বলে? বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক মহলের ষড়যন্ত্রকে পাত্তা না দিয়ে নিজের খরচে পদ্মা সেতু বানিয়ে মেরুদণ্ডের শক্তিটা দেখিয়েছেন বলে?

উত্তর দিচ্ছি না। পাঠক নিজের উত্তর খুঁজে নেবেন আশা করি। করোনায় যখন সারাবিশ্ব আজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কায় কাঁপছে বিশ্বের বাঘা বাঘা নেতারা, আমেরিকার মতো মোড়লদেশে বাড়ছে গৃহহীনের সংখ্যা ঠিক তখন করোনা মোকাবিলায় শেখ হাসিনা মডেল এক বিস্ময়ের নাম। করোনাকালীন অর্থনীতির গ্রাফ যেন কোনো এক জাদুবলে কেবল উপরেই উঠছে। ভারতের মতো এশিয়ান জায়ান্টকে আজ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের রুপির দাম কমতে কমতে তলায় ঠেকেছে। পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীরা কেঁদে কেঁদে আজ বাংলাদেশ হতে চাইছে। এর পেছনে কার অবদান? একমাত্র অবদান শেখ হাসিনার মতো একজন চৌকস ও বিচক্ষণ নেতার। যোগ্য নেতার আসনে বসে তিনি কেবল আজকের কথা মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নেন না, তিনি অনেক দূরের বাংলাদেশকে মাথায় রেখেই সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

এবার একটু দেখি আল জাজিরার কেন বাংলাদেশকে নিয়ে এত আগ্রহ? এর উত্তরটাও লুকিয়ে আছে আমার উপরের আলোচনায়। আসল কারণটা হচ্ছে আল জাজিরা কাজ করছে জামায়াতে ইসলামীর আন্তর্জাতিক মিডিয়া পার্টনার হিসেবে। কথা উঠতেই পারে যে আমরা কেন আল জাজিরা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছি? এই ভাবনায় কোনো সমস্যা নেই কারণ আল জাজিরার মতো একটি খয়রাতি চ্যানেল নিয়ে এতসময় নষ্ট করাটা আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতায় একদম অনুচিত। তবে কেন আলোচনা?

অতিসম্প্রতি তারা আবার সেই পুরোনো খেলাটা শুরু করেছে। শেখ হাসিনা ও সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের নামে পুরোনো কিছু মিথ্যাচারের কাহিনী রচনা করেছে। আমি বলছি না বাংলাদেশে দুর্নীতি নেই, বলছি না এখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেনা বা আইনের শাসন খুব শক্ত। কিন্তু এর সাথে একজন শেখ হাসিনাকে সরাসরি যুক্ত করা কতটা কাণ্ডজ্ঞানের পরিচায়ক? আল জাজিরা আর কোন কোন দেশের প্রধানকে নিয়ে এমন নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে? একটি আন্তর্জাতিক চ্যানেল কেন দিনের পর দিন একটি দেশকে নিয়ে অনুসন্ধান চালাবে? এর পেছনে কি কোনো স্বার্থ নেই? রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে যেকোনো সরকার প্রধানের ভুল-ত্রুটি হতে পারে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিণতিও আমরা জানি। কই, সেটি নিয়ে তো কোনো অনুসন্ধান করছে না আল জাজিরা। তবে কেন বারবার বাংলাদেশ নিয়ে? মিডিয়ার এহেন ভূমিকা কি সমর্থনযোগ্য?

আল জাজিরা যদি সত্যিকার অর্থে একটি নিরপেক্ষ মিডিয়া চ্যানেল হয়ে থাকে তাহলে সেটির প্রমাণ কোথায়? তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থের উৎসইবা কী? কেন হঠাৎ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিয়ে তাদের এত আগ্রহ জন্মাল? আসলে তাদের সকল সমস্যা নিহিত শেখ হাসিনাতে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে। সকল সূচকে বাংলাদেশের উন্নয়ন তাদের গা জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাদের পৃষ্ঠপোষক জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির পতন। তারা চাইলে সাধারণ মানুষের কাছে যাক। কী চায় তারা? কী মনে করে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব সম্পর্কে। একটি আন্তর্জাতিক জরিপও করতে পারে চাইলে। খারাপ দেখালে ভালোটাও যদি না আসে তাহলে সেখানে পক্ষপাতিত্বের প্রশ্ন থেকেই যায়।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে