নতুন পোশাকে নতুন বই নিয়ে স্কুলে যাওয়া হলো না আজিমের
নিউজ ডেস্ক : শেরশাহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আজিম হোসেন। ১লা জানুয়ারি বই উৎসবের দিন বইও সংগ্রহ করেছিল আজিম।
মঙ্গলবার নতুন বই নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল তার। স্কুলে যাওয়ার জন্য নতুন পোশাক পরে তৈরিও হয়েছিল সে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মাম পরিহাস, স্কুলের বদল কবরস্থানে যেতে হল আজিমকে।
মোবাইল চুরির ঘটনার প্রকাশ করার ‘অভিযোগে’ সকালে তাকে নিজ বাসায় রনি আকতার নামে এক নারী জবাই করে হত্যা করে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রনিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বায়েজিদ থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘আজিমের বাবা সকাল সাড়ে ১১ টায় কাজ থেকে ফিরে এসে দেখে আজিমের জবাই করা দেহ পড়ে রয়েছে বিছানায়। ৮ ডিসেম্বর আজিমের ঘর থেকে মোবাইল চুরি করে রনি আকতার নামে এক নারী। এই ঘটনা পরিবারের সবাইকে বলে দেওয়ায় শালিসের মাধ্যমে রনিকে জরিমানা করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হত্যার পরিকল্পনা করে রনি।’
শিশুটির বয়স মাত্র ৯ বছর। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। নতুন বই নিয়ে তার প্রথম স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল। নতুন বইয়ের মৌ মৌ গন্ধে মাতোয়ারা ছেলেটি তৈরি হচ্ছিল স্কুলে যাবে বলে। হয়নি তার স্বপ্ন পূরণ। তার পরিবর্তে ছেলেটি প্রতিবেশী মহিলার হাতে নৃশংস ভাবে খুন হলো। পুলিশ দ্রুততার সাথে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছে ঠিকই, তবে তার স্বপ্ন, তার মা বাবার স্বপ্নের অপমৃত্যু ঠেকাতে পারে নি। এ প্রসঙ্গে সিএমপির উপ কমিশনার (উত্তর) পরিতোষ ঘোষ বলেন, ঘটনাস্থলে আলামত দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম এটা প্রফেশনাল কারো কাজ নয়। প্রফেশনাল কেউ হলে অস্ত্র বাইরে থেকে নিয়ে আসতো, ঘরের বটি খুঁজে খুন করতো না। এগুলো আসলে সামাজিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, বায়েজিদ থানাধীন বাংলাবাজার গুলশান হাউজিংস্থ তিনতলা বিশিষ্ট দিদার কলোনির তৃতীয় তলার ১৮নং কক্ষে সপরিবারে বাস করেন মো: আজাদ হোসেন। পেশায় সবজি বিক্রেতা। তার স্ত্রী গার্মেন্টস কর্মী। পরিবারে আছে তার স্ত্রী, দুই পুত্র এক কন্যা। আজিম (৯) দ্বিতীয়। ঘাতক রনি আক্তার সপরিবারে থাকে পাশের কক্ষে। রনির স্বামী রিপন গার্মেন্টসে কাজ করেন। মিনহাজ নামে তিন বছরের একটা সন্তান রয়েছে এ ঘরে। রনি যেহেতু ঘরেই থাকে, সেহেতু পাশের কক্ষের চাবি মাঝে মধ্যে তার কাছেই রেখে যেতো আজাদ হোসেন ও তার স্ত্রী। এই সুযোগ নিয়ে গত মাসের ৮ ডিসেম্বর রনি আক্তার তাদের ঘরে ঢুকে একটি মোবাইল ফোন চুরি করে। প্রায় ২০ থেকে ২৫ দিন পর জানা যায় যে চুরিটা কে করেছে। বিষয়টি আজিমই ধরতে পারে। এর আগে পরেও ঐ কলোনি থেকে বেশ কয়েকটি মোবাইল সেট চুরি যায়। রনি আক্তার চুরি করেছে জানার পর পূর্বেকার সেটগুলো চুরির দায়ও আসে তার কাঁধে। এই নিয়ে ২৬ ডিসেম্বর বিচার বসে। বিচারে তাকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর থেকে নানাভাবেই তাকে চোর অপবাদ দিতে থাকে কলোনির মানুষ রনি আক্তার হয়ে যায় ‘চোরনি’।
মঙ্গলবার থানায় ওসি মো: মোহসিনের কক্ষে রনি আক্তার অকপটে এভাবেই খুলে বলে খুনের কারণ, কীভাবে করেছে পুরোটাই। সে জানায়, ‘চোরনি’ অপবাদ শুনতে হতো আমার সব সময়। ঘর থেকে বেরুতে পারতাম না, কিছু একটা চুরি গেলেই কলোনির মানুষ বড়ো বড়ো করে বলতো আগে আমাকে ধরতে। একপর্যায়ে সব রাগ গিয়ে পড়ে আজিমের উপর। চার বছর ধরে ঐ কলোনিতে আছি, ওর কারণেই আজ এ অপবাদ। দুই দিন আগে সিদ্ধান্ত নিই যে তাকে খুন করবো। একা পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।
মঙ্গলবার সকাল দশটার দিকে দেখি আজিমদের ঘরের সামনে এক জোড়া স্যান্ডেল। বুঝলাম ঘরে আর কেউ নেই। মোবাইল নম্বর লিখতে কলম চাওয়ার উসিলায় তাদের ঘরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিই। সে তখন স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। সে বলে, ‘কী রে, আবার কী চুরি করবার আইচস?’ শুনেই তাকে জাপটে ধরি। সে বাধা দিতে থাকে। ধস্তাধস্তি করতে করতে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিই। আবারো উঠে পড়ে সে। ধাক্কা দিলে তার মাথা দেওয়ালে ঠুকে যায়। এরপর তার ছোট বোনের ওড়না দিয়ে হাত ও তার প্যান্ট দিয়ে পা বেঁধে ফেলি। পায়ের বাঁধন খুলে গেলে ওড়না দিয়ে আবার বাঁধি। চিৎকার করে উঠলে মুখে বালিশ চাপা দিই। খাটের পাশে থাকা বটি দিয়ে জবাই করতে গেলে সে হাতের বাঁধন খুলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। এসময় তার দুটো আঙুল কেটে যায়। পুনরায় হাত বেঁধে জবাই করে দিই।
ওসি বায়েজিদ মো: মোহসিনকে বলেন, আমরা একটা পাঁচ মিনিটে খবর পায়। সাথে সাথে ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে চলে যায়। এর মধ্যে ডিসি নর্থ পরিতোষ ঘোষ স্যার ও এডিসি ডিবি বাবুল আক্তার স্যারসহ অন্যান্য কর্মকর্তাগণও চলে আসেন। প্রথম অবস্থায় রনি আক্তারকে সন্দেহ করা যায় নি। কারণ খুন করার পর সে নিজের ঘরে এসে রক্তমাখা কাপড় চোপড় ধুইয়ে ফেলে। কাঁদার অভিনয় করেছে, আমাদের সাহায্য করার ভান করেছে। পরে পুরো টীমকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে, কলোনির বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলি। আজিমের বাবা-মাও জানান যে তাদের কোন শত্রু নাই। শুধু রনি আক্তারের সাথে মোবাইল নিয়ে বিরোধ ছাড়া। রনি আক্তারকে আটক করে থানায় নিয়ে আসি। একটু জিজ্ঞাসাবাদেই সে পুরো ঘটনা স্বীকার করে।
হতভাগ্য আজিমের বাবা আজাদ হোসেন থানায় পুত্র শোকে আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘তার যদি ক্ষোভ থাকতো, তবে আমাকে খুন করতো, আমার মাসুম বাচ্চাটারে মারলো ক্যান? কত শখ কইরা আগের দিন পোলা আমার বইপত্তর গুছাইতেছিল স্কুলে যাইবো। শেরশাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করায় দিয়েছিলাম তারে। সক্কালে উইঠা গোছল সাইরা নিজে নিজেই রেডি অইতেছিল। হের মা আর আমি কামে যাওনের আগে বড়টারে দিয়া ছোড মাইয়াটারে বোনের কাছে রাখতে পাঠাইছিলাম। জানতাম না, আমার বাবারে যে আর দেহুম না। এহন কী কমু? কিচ্ছু বলার নাই, তয় তার শাস্তি চাই।’
৬ জানুয়ারি ২০১৬/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসএম/ডিআরএ
�