সিরাজুল ইসলাম : “চো…নীর ফোয়া, আঁর লয় মশকারী চো…র! জিইন দি অইয়স হিন দি ভরি দিওম।” এটা মাদ্রাসার হুজুরের কথা না। এটা আমার নিজের ক্লাসে এক ছাত্রকে উদ্দেশ্য করে অধ্যাপকের গালি। এই অধ্যাপক আরেক ছাত্রকে থাপড়াতে থাপড়াতে গাল লাল করে ফেলেছিলেন।
বলছিলাম চট্টগ্রাম কলেজের কথা। ১৯৮০ দশকে তৎকালীন চট্টগ্রাম [বর্তমান চট্টগ্রাম ও সিলেট] বিভাগের সেরা কলেজ। গোটা বিভাগের সেরা ছাত্রদের আকাংখা থাকত চট্টগ্রাম কলেজে এইচ,এস,সি, তে পড়ার। প্রচূর প্রতিযোগিতামূলক ছিল ভর্তির বিষয়টা। বিজ্ঞান বিভাগে তিন সেকশনে ৩৭৫ জন ও মানবিক বিভাগে দুই সেকশনে ২৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করানো হত প্রতি শিক্ষাবর্ষে। পরবর্তীতে ছাত্র শিবির আন্দোলন করে আরো ১২৫ জন [প্রতি সেকশনে ২৫ জন করে] বাড়ানোর দাবী আদায় করেছিল অধ্যক্ষ কাজী আব্দুর রশীদ সাহেবের কাছ থেকে। ভদ্রলোক ছিলেন ঘটি এবং একজন স্ট্রীক্ট ডিসিপ্লিনারিয়ান। এজন্য তিনি কেঁডা [কাঁটা] রশীদ হিসাবে কুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। কিন্তু আমরা উনাকে ভালবাসতাম এবং উনিও আমাদের ভালবাসতেন।
যাই হোক, ব্যাপারটা ছিল পদার্থ বিদ্যার ক্লাসে। বিজ্ঞান বিভাগের ৩টা সেকশন। আমি ছিলাম বি-সেকশনে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম সাহেব সেদিন পড়াচ্ছিলেন এবং পদার্থ বিদ্যার একটা সূত্র বুঝাচ্ছিলেন, আর তিনি বোর্ডে লিখছিলেন। পেছন থেকে কোন এক ছেলে সিনেমার ডায়লগের ভঙ্গিতে বলে উঠল “আচ্ছা!” তিনি পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছো?” সবাই চুপচাপ, কোন জবাব নেই। তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আবারো জিজ্ঞেস করলেন, “কেউ কি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছো?” এবারও কোন জবাব নাই। তিনি তখন প্রমিত বাঙলা ত্যাগ করে চাটগামী শুরু করলেন। আর শুরুর খিস্তিটাও ঝাড়লেন। ক্লাসে ছিল ৩০-৩৫ টার মত মেয়ে। আমরা মাথা নিচু করে থাকলাম। সেদিন বাকী সময় তিনি চাটগামিতে গালাগালি করেই পার করলেন।
অন্য আরেক দিন তিনি এ-সেকশনের ক্লাস নিচ্ছিলেন, আর আমরা পদার্থবিদ্যার লেকচার থিয়েটার গ্যালারীর বাইরে অপেক্ষা করছিলাম বি-সেকশনের ক্লাস শুরু হওয়ার জন্য। ঘণ্টা বাজলে এ-সেকশনের ছেলে মেয়েরা বেরিয়ে আসছিল। মেয়েরা গ্যালারির সামনের সারিগুলোতে বসত। ফলে তারা ছেলেদের আগে বেরিয়ে যেতে পারত। এ-সেকশনের মেয়েদের বেরিয়ে আসার সময়ে তাদের ভেতর ঠেলেঠুলে বি-সেকশনের একটা ছেলে ঢুকে পড়েছিল। বেচারা ঢুকতেই ভিতরে সিরাজুল ইসলাম স্যারের সামনে পড়ল। তিনিও আর দেরি না করে ছেলেটাকে থাপড়াতে শুরু করলেন দুই হাতে তার দুই গালে। কতক্ষণ থাপড়িয়েছেন এখন বলতে পারবো না, তবে তিনি নিজে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে শুরু করার আগ পর্যন্ত ছেলেটাকে থাপড়িয়েছেন। মাদ্রাসার যেই শিক্ষককে দেখলেন বেত দিয়ে বাচ্চাটাকে পিটাতে তার চেয়ে বেশিক্ষণ আমাদের সহপাঠিকে পিটিয়েছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম সাহেব সেদিন এবং মারটা ভিডিওর মারের চেয়েও ভয়ংকর ছিল।
নটরডেম কলেজের এক শিক্ষক নাকি ক্লাসের মধ্যেই ছাত্রদের পিটাতে পিটাতে মাটিতে শুইয়ে ফেলতেন। সেটা ছাত্রদের লিখা ব্লগে বেশ কয়েকবার এসেছে। গত কয়েক বছরে স্কুল শিক্ষক/শিক্ষিকার পিটুনিতে ছাত্র নিহত হবার ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটেছে। সেগুলো মিডিয়াতেও এসেছে; তবে ভিডিও ছাড়া। ফলে প্রতিক্রিয়াটা এই মাদ্রাসা শিক্ষকের পিটানির ব্যাপারে যেমন হয়েছে তেমন হয় নি।
আমাদের প্রাইমারী স্কুলে ৪র্থ শ্রেণিতে বাংলা পড়াতেন এক শিক্ষক যিনি বাচ্চাদের কান ধরে সামনে পেছনে অনেকক্ষণ টানতেন তারপর হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে প্রচণ্ড জোরে মুখে থাপ্পড় মারতেন। আমি যখন কলেজে যাই তখন শুনেছিলাম একটা ছেলের কান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ইংরেজী পড়াতেন যেই শিক্ষক তিনি হোম ওয়ার্ক না আনলে এবং পড়া না পারলে উনার বসার চেয়ারের নিচে ছাত্রদের মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে পাছার উপর বেত্রাঘাত করতেন।
মৌখিকভাবে ছাত্র/ছাত্রীদেরকে পীড়ন করাতো একটা সাধারণ বিষয় – ব্যঙ্গ করা ও হেয় করা ছিল কিছু শিক্ষকের জন্য মামুলি কাজ। ড. গুরুপদ পালিত ছিলেন আমাদের ক্যামিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের হেড এবং কলেজের শৃঙ্খলা বিভাগের প্রধান। পোলাপানকে ধমকানো ও গালাগালি করা কোন ব্যাপার ছিল না উনার। ফাইনাল পরীক্ষার ভাইভাতে অর্গানিক ক্যামিস্ট্রির একটা প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারি নি। ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির দিন কোন সমস্যা হয় নি। এক্সটার্নাল যিনি ছিলেন তিনি চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক ছাত্র। তিনি তখন ড. পালিতকে লক্ষ্য করে বললেন, “স্যার চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্ররা এই প্রশ্ন পারে না! পালিত তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, “তোর বাড়ি হঁডে?” আমি সন্দ্বীপ বললে তিনি বললেন, ‘উড়ির চর!” আমি সেদিন একটা পাঞ্জাবী পরা ছিলাম। তিনি সেদিকে নির্দেশ করে বললেন, “ইতে ত বাঁশখাইল্লা গরু ব্যারি, কেমিস্ট্রি বুঝিবো হঁডেত্তুন!”
সমস্যা আমাদের গোটা সাইকিতে [মননে]। এরপরের ব্যাপার হল প্যাডাগজিকাল ট্রেইনিং অধিকাংশ শিক্ষকের নেই। মাদ্রাসার যে লেভেলে শিক্ষকরা পড়ান তাঁদের অধিকাংশেরই কোন প্যাডাগজিকাল ট্রেইনিং নাই, ক্লাসরূম ম্যানেজমেন্ট ও ডিসিপ্লিন এক্সিকিউশনের প্রশিক্ষণতো আরো দূরের কথা।