রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বারবার উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে গেছেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। আর এসব উসকানিতে ব্যবহার করেছেন ধর্ম। তাঁর বক্তব্যের জেরেই ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি এলাকায় তাণ্ডব চালায় হেফাজতের অনুসারীরা। ধারাবাহিক তদন্ত, ডিজিটাল আলামত এবং কয়েকজন হেফাজত নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ মামুনুলের ব্যাপারে অনেক তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে।
মোহাম্মদপুর থানায় হামলা ও চুরির মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হলেও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তাধীন আরো ১৭ মামলায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকায় ১৮টিসহ অন্তত ৫০টি মামলা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মামুনুল হক নাশকতার কর্মসূচির ব্যাপারে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মুখ খুলছেন না। গ্রেপ্তারের আগেই সরিয়ে ফেলেছেন তাঁর মোবাইল ফোন। তবে দুই গোপন বিয়ে স্বীকার করে জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে বাইরে বিতর্কের মতোই পরিবারেও ঝামেলা হয়েছে। প্রথম স্ত্রী রাগ করে বাসা ছেড়েছেন।
গত রবিবার মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসা থেকে গ্রেপ্তারের পর তেজগাঁও থানা কমপ্লেক্সে রাখা হয় মামুনুলকে। রাতেই সেখান থেকে নেওয়া হয় মিন্টো রোডের ডিবির কার্যালয়ে। গতকাল সোমবার মোহাম্মদপুর থানায় হামলা-ভাঙচুর, মোবাইল ফোন-টাকা চুরি ও ধর্মীয় কাজে ইচ্ছাকৃত গোলযোগ তৈরির মামলায় তাঁর সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ঢাকা মহানগর হাকিম দেবদাস চন্দ্র অধিকারীর আদালত। গত বছরের ৭ মার্চ জি এম আলমগীর শাহীন মামলাটি করেন। ডিবি কার্যালয়ে তাঁকে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ ও ডিবি আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মামুনুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হেফাজত করলেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে—এমন নয়। অন্যদের ব্যাপারেও প্রমাণ আছে। তারা ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলে উসকানি দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছে। কোনো সংগঠনের হয়ে রাষ্ট্র ও সরকারকে চ্যালেঞ্জ করলে সরকার ছাড় দেবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘যারা নাশকতার সঙ্গে জড়িত তাদের সবাইকেই গ্রেপ্তার করা হবে।’
ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘২০১৩ সালের নাশকতার ঘটনায় ঢাকায় দায়েরকৃত ১৫টি মামলা আমাদের কাছে তদন্তাধীন। এসব মামলায় মামুনুল আসামি। এ ছাড়া সম্প্রতি পল্টন ও মতিঝিল থানায় দায়ের করা দুটি মামলার তদন্তভার আমরা পেয়েছি। এসব মামলায়ও মামুনুল আসামি। আমরাও তাঁর রিমান্ডের আবেদন করব।’
ডিএমপি সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুরের মামলাটি ছাড়াও মতিঝিল বিভাগের ডিবির কাছে ১৪টি, লালবাগ বিভাগে দুটি এবং তেজগাঁও বিভাগের একটি মামলায় তিনি আসামি। ২০১৩ সালের ১৫টি মামলার মধ্যে সাতটিতে তিনি এজাহারনামীয় আসামি। সম্প্রতি করা পল্টন থানা
ও মতিঝিল থানার দুটি মামলায় তাঁর নাম আছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, সোনারগাঁ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন থানায় করা পাঁচটি মামলার এজাহারে নাম আছে। এই ২৩টি মামলাসহ আগের এবং সাম্প্রতিক অর্ধশত মামলায় তিনি আসামি হচ্ছেন বলে জানায় সূত্র। হেফাজতে ইসলামের দাবি মতে, ২০১৩ সালে সারা দেশের ৩৩টি মামলায় মামুনুলের নাম আছে।
পুলিশের সূত্র জানায়, রবিবার তেজগাঁও থানা কমপ্লেক্স থেকেই মামুনুলকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়েছে। এ সময় তাঁর কাছে মোবাইল ফোন পাওয়া যায়নি। তবে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ড, তাঁর ফোনকল রেকর্ডসহ কিছু ডিজিটাল প্রমাণ এরই মধ্যে পুলিশের হাতে চলে এসেছে। সেখানে সরকারবিরোধী এবং জামায়তপন্থী কিছু নেতাকর্মীর সঙ্গে মামুনুলের নিয়মিত যোগাযোগের তথ্য মিলেছে। উসকানি দেওয়া বক্তব্যের মাধ্যমে বারবার সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার পেছনে কাদের ইন্ধন আছে— এমন প্রশ্নে চুপ থাকছেন মামুনুল। তাঁর যোগাযোগের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গতকাল রিমান্ডের পর তেজগাঁও বিভাগের পুলিশই মূলত মামুনুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ডিবি পুলিশও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে ব্যক্তিগত জীবনের বিতর্কিত বিষয়ে মামুনুল বলেছেন, জিডি হওয়ার ঘটনায় থাকা দুই নারীকেই তিনি ‘চুক্তিভিত্তিক’ বিয়ে করেছেন। তাঁদের সঙ্গে শর্ত ছিল বিয়ে প্রকাশ করা যাবে না। আত্মীয়স্বজন ও সমাজের কাছে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত করা হবে না। তবে ভরণপোষণ দেওয়া হবে। রিসোর্টকাণ্ডের পর এসব বিয়ে প্রকাশ পেলে প্রথম স্ত্রী এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছেন বলে জানান মামুনুল। তিন বিয়ে ছাড়া আর কোনো বিয়ে নেই বলেও দাবি করেন মামুনুল।
সাধারণ আসামিদের মতোই মামুনুলকে ডিবির হাজতখানায় রাখা হয়েছে। সহকর্মী হেফাজত নেতাদের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে তাঁর বক্তব্য যাচাই করা হবে বলে জানায় সূত্র।
গতকাল সকালে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মামুনুলকে আদালতে উপস্থাপন করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আবেদনে মামলার তদন্তকার্রী কর্মকর্তা বলেন, ২০২০ সালের ৬ মার্চ রাতে সাতমসজিদ রোডের সাত গম্বুজ মসজিদে আমল করাকালীন আসামি মানুনুল হক ও তাঁর ভাই মোহতামিম মাহফুজুল হকের নির্দেশে জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসার ছাত্র আসামি ওমর, ওসমান দুজন এসে জি এম আলমগীর শাহীনসহ তাঁর সঙ্গে থাকা অন্যদের আমল করতে নিষেধ করে, তাঁদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করে এবং মসজিদ থেকে বের হয়ে যেতে বলে। তাঁদের মসজিদের ভেতরে কিল-ঘুষি মারতে থাকে। এতে বাদী গুরুতর রক্তাক্ত জখম হয়। এ সময় তাঁর কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন, সাত হাজার টাকা ও ২০০ ডলার নিয়ে যায় আসামিরা। মামুনুল আসামিদের চিনেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে চোরাই যাওয়া মালামাল উদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চট্টগ্রাম নারায়ণগঞ্জ, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সহিংসতায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দাযেরকৃত ২৩টি মামলার তদন্তভার পেয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির সিনিয়র সরকারী পুলিশ সুপার জিসানুল হক এ তথ্য জানিয়েছেন। সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, আজ মঙ্গলবার তদন্তের বিষয়ে সিআইডিপ্রধান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন।কালের কণ্ঠ