বুধবার, ৩০ জুন, ২০২১, ০৯:৪৭:২৩

‘ভোক নাগলে মুই কী খাইম!’

‘ভোক নাগলে মুই কী খাইম!’

‘মুই আর স্কুলোত যাবার নও। বাবায় কইচে এ্যালা থাকি আর বোলে বিস্কুট দিবার নয়, তাইলে ভোক (ক্ষুধা) নাগলে মুই কী খাইম!’ টিফিনের সময় স্কুলে আর বিস্কুট দেওয়া হবেনা-এমন খবরে এভাবেই অভিব্যক্তি প্রকাশ করে রংপুরের তিস্তাকুলবর্তী গঙ্গাচড়া উপজেলার চর ইশোরকোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আবু রায়হান। এমনিতে করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা অনেকদুর পিছিয়ে পড়েছে। তার ওপর স্কুল ফিডিং প্রকল্প চালু না থাকলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ঝরে পড়বে বলে আশ'ঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষক-অভিভাবকসহ সচেতন মহল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বাড়ানো, ঝ'রে পড়া রোধ এবং শিশুদের অপুষ্টি দূর করতে নেওয়া হয় ‘দা'রিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্প, ২০১২ সাল থেকে যা কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ৭৫ গ্রাম ওজনের এক প্যাকেট উচ্চ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ বিস্কুট থেকে শিশুরা ৩৩৮ কিলোক্যালরি শক্তি পায়, যা তাদের প্রতিদিনের শক্তি চাহিদার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। কিন্তু সেই প্রকল্পও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নতুন কোনো প্রকল্প গ্রহণ কিংবা পুরনো প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোরও খুব একটা তৎপরতা নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।

প্রকল্পের আওতায় দেশের দারিদ্র্যপীড়িত ৩৫টি জেলার প্রাথমিক স্কুলের প্রায় ৩৩ লাখ শিশুকে প্রতিদিন টিফিন হিসেবে বিস্কুট খেতে দেওয়া হয়। সরকার ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সহায়তায় পরিচালিত এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ ৩০ জুন। এ অবস্থায় আসছে জুলাই মাস থেকে শিশুদের মধ্যে আর বিস্কুট বিতরণ করা সম্ভব হবে না। চলমান প্রকল্পে বিদ্যালয়ে বিস্কুট বিতরণের জন্য নিয়োজিত 

এনজিওগুলোর সাথে চুক্তির মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ব্যয় সাশ্রয় করার লক্ষে আগামী জুলাই থেকে ২২ সাল পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই প্রকল্পটি বর্ধিত করা হলে এনজিওদের সাথে চুক্তি করার প্রয়োজন হবে না। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নিজস্ব জনবল দ্বারা বিস্কুট বিতরণের কাজ সম্পন্ন করা যায়। এর আগে গত ২০২০ সালে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। পরে তা চলতি বছরের মার্চ মাসে ৬ মাস সময় বৃদ্ধি করা হয়।

পিছিয়ে পড়া রংপুরের চার উপজেলা গঙ্গাচড়া, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ ও কাউনিয়ায় স্কুল ফিডিং প্রকল্প চালু রয়েছে। ৫৬১ বিদ্যালয়ের মোট এক লাখ ১৪ হাজার ৩০৬ জন শিক্ষার্থী প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করছে। অভিভাবক-শিক্ষকসহ সচেতন মহল জানিয়েছেন, প্রাথমিকে শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত ও ঝরে পড়া রোধ করতে স্কুল ফিডিংই হচ্ছে একমাত্র উপায়। এমনকি উপবৃত্তির চেয়েও স্কুল ফিডিং বেশি জরুরি।

সরেজমিনে রংপুরের দারিদ্র্যপীড়িত গঙ্গাচড়ায় তিস্তার চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, করোনাকালীন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থীকে বাধ্য হয়ে বাবার সঙ্গে ভিন্ন পেশায় যুক্ত হতে হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এসব শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে ফেরার সম্ভাবনা খুবই কম। তার ওপর স্কুল ফিডিং প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে এসব এলাকার ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীই ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চর ইশোরকোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান, বিনবিনা চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শেণির শিক্ষার্থী শিহাব মিয়া জানায়, প্রতিদিন খালি পেটে তারা স্কুলে যায়। দুপুরে স্কুল থেকে দেওয়া বিস্কুট খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে। কিন্তু এর পরে বিস্কুট দেওয়া নাহলে তারা আর স্কুলে যাবেনা বলে জানিয়ে দেয়।

মাঠে খেলছিল ইচলী বাগেরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সায়েম, নিশাতসহ কয়েকজন। স্কুলে আর বিস্কুট দেওয়া হবেনা শুনে কেঁদে ফেলে তারা।

বিনবিনা চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন অভিভাবক হাবিবুর রহমান পেশায় কৃষিশ্রমিক। তিনি বলেন, ‘অভাবের সংসারোত ছাওয়াটা (ছেলে) মোর সাতে এ্যাকনা কাম (কাজ) করলে ভাল হয়। তয় বিস্কুট পাওয়ায় আশায় পত্তিদিন খালি স্কুলোত দৌড়ায়। বিস্কুট দেওয়া বন্ধ হইলে ওরা আর স্কুল যাবার নয়।’

বিনবিনা চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোবাশ্বের রহমান ও চর ইশোরকোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজগর আলী জানান, বর্তমানে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় একসঙ্গে বরাদ্দকৃত অনেক বিস্কুট শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এতে করোনাকালে তাদের গোটা পরিবার অনেক উপকৃত হয়েছে। প্রকল্পের বিস্কুটের কারণেই বিদ্যালয়গুলোতে উপস্থিতি এখন শতভাগ, আগে যা ছিল ৫০ ভাগেরও কম। এছাড়া পুষ্টিসমৃদ্ধ বিস্কুট খেয়ে শারিরীকভাবে সুস্থসহ অভাবি সংসারের শিক্ষার্থীদের রোগ-বালাইও কম হত। তবে প্রকল্প বন্ধ হলে আবারও আবারও ৫০ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার শঙ্কা রয়েছে বলে জানান তারা।

এ ব্যপারে যোগাযোগ করা হলে রংপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শাহজাহান সিদ্দিকী বলেন, দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্প বন্ধ করা হবে-এমন কথা এখনও বলা হয়নি। গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার প্রতিবছর এই প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করছেন। রংপুরের চার উপজেলায় এই প্রকল্প চালু আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতদিন ওই প্রকল্প চালু থাকায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার আগের তুলনায় অনেক কমেছে।’ সে কারণে শুধু প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করাই নয়, পিছিয়ে পড়া রংপুরের আট উপজেলাকে প্রকল্পের অন্তর্র্ভূক্ত করা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।-কালের কণ্ঠ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে