ঝালকাঠিতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা-তা নিয়ে সন্দিহান নৌ মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা। তাদের মতে, ইঞ্জিনরুম থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটলে এত দ্রুত দোতলা বা তিনতলার কেবিনগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার কথা নয়। নিচতলায় ইস্পাতের তৈরি ডেক ছাড়া তেমন আসবাবপত্র ছিল না। তবে সেখানে চায়ের দোকান ছিল। ইঞ্জিনরুমে প্রচুর জ্বালানি তেল ছিল।
অপর দিকে দোতলায় অবস্থিত ক্যান্টিন বা চায়ের দোকানের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকলে সেটিও পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে পড়তে সময় নেওয়ার কথা।
অপর দিকে কেউ কেউ জানান, ইঞ্জিনের ত্রুটি বা অন্য কোনো উপায়ে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। সেই আগুন নেভাতে নৌযানটির শ্রমিকদের তৎপরতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কাছাকাছি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন থাকলেও সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে খবর দেওয়া হয়নি। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি ছিল কি-না এবং সেগুলো ব্যবহার কতটা করা হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং বাংলাদেশ নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে। লঞ্চটি পরিদর্শন করেছেন-এমন কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লাগে। গভীর রাতে ঘুমে আচ্ছন্ন যাত্রীরা আগুনের সংবাদ শুনে কিৎকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। অনেকেই জীবন বাঁচাতে নদীতে লাফ দেন।
ভোরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। তারা জানান, লঞ্চটি এমনভাবে পুড়ে গেছে যে, ইস্পাতের বডি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তারা বলেন, পণ্যবাহী নৌযানের ইঞ্জিনরুমে আগুন লাগার ঘটনা সচরাচর শোনা যায়। এভাবে দাউদাউ করে যাত্রীবাহী লঞ্চ দগ্ধ হওয়ার ঘটনা সম্প্রতি বছরগুলোতে দেখা যায়নি।
ঘটনার পরপরই লঞ্চটি পরিদর্শন করেন বিআইডব্লিউটিএ’ও চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক। তিনি বলেন, লঞ্চটি এমনভাবে পুড়ে গেছে যে শুধু লোহার খাঁচা পড়ে আছে। আমরা অনেক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, আগুনের তীব্রতা এতই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল যে, পুরো লঞ্চটি যেন গরম ইস্পাতে পরিণত হয়েছিল। এতেই অনেক মানুষের শরীর পুড়ে গেছে। অনেকে আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়েছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লঞ্চে অনেক দাহ্য পদার্থ যেমন-তেল, মবিল, কেবিন ও ডেকের ফার্নিচারসহ বিভিন্ন জিনিস থাকে। আগুন লাগার পর তা নেভাতে সঠিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছে কি-না- তা দেখার বিষয় রয়েছে। তবে এটি নাশকতা নাকি নিছক দুর্ঘটনা তা এখনই বলা যাবে না।
জানা গেছে, এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি ২০১৯ সালে নির্মাণ করা হয়। এটির দৈর্ঘ্য ৬৪ মিটার, প্রশস্ততা ১০.৫০ মিটার। লঞ্চের গভীরতা ২.৮০ মিটার। বাংলাদেশ নৌপরিবহণ অধিদপ্তরে লঞ্চটির রেজিস্ট্র্রেশন নম্বর ০১-২৩৩৯। এর মালিকের নাম মো. হানজালাল শেখসহ চারজন। লঞ্চটির সার্ভের মেয়াদ আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রয়েছে। রুটপারমিট রয়েছে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত। লঞ্চটিতে চার স্ট্রোক-বিশিষ্ট এক হাজার ১০০ অশ্বশক্তি সম্পন্ন দুটি ইঞ্জিন রয়েছে। দিনে লঞ্চটির ধারণক্ষমতা ৭৬০ জন ও রাতে ৪২০ জন। ঢাকা নদীবন্দর (সদরঘাট) থেকে ছাড়ার সময় এতে নাবিক-স্টাফসহ ৩১০ জন মানুষ ছিল বলে ভয়েজ ডিক্লারেশন দেওয়া হয়। ওই ডিক্লারেশনে বলা হয়, যাত্রার সময়ে লঞ্চটির ডেকে ২২০ জন ও কেবিনে ৫৫ জন যাত্রী রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, গভীর রাতে যখন লঞ্চটিতে আগুন ধরে তখন বাইরের আবহাওয়ার তাপমাত্র ছিল ১২ থেকে ১৫ ডিগ্রি। এমন ঠান্ডার সময় ইঞ্জিনরুমে আগুন লাগলে কীভাবে তা দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল।
তিনি বলেন, লঞ্চটি সামনের দিকে বাতাস ভেদ করে চলছিল। ওই অবস্থায় কীভাবে সামনের কেবিন ও মাস্টার রুমে আগুন চলে এলো?
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, পারাবত, সুন্দরবনের মতো লঞ্চের ভেতরে অনেক ইন্টেরিয়র ডিজাইন থাকে। এ লঞ্চটিতে তা না থাকায় ডেকে কাঠের জিনিস তেমন ছিল না বললেই চলে, তবুও কেন এত দ্রুত আগুন ছড়ালো তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একই ধরনের মন্তব্য করেছেন অন্য দুটি লঞ্চের মালিকও।
এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের মালিক মো. হানজালাল শেখ দাবি করেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি নাশকতামূলক। তিনি বলেন, ইঞ্জিনে আগুন লাগলে ইঞ্জিনরুম পুড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু উপরে বা আগুন সামনে যাওয়ার কথা নয়।