আবদুল্লাহ আল মামুন : বিএনপিকে সঙ্গে নিয়েই আগামী জাতীয় নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চায় আওয়ামী লীগ। তাদের এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতেই বিএনপির প্রতি ‘উদারনীতি’ গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীনরা।
বিএনপির নেতাকর্মীরা যাতে মাঠে-ময়দানে সুষ্ঠুভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে যাবতীয় সহযোগিতা করতেও সংশ্লিষ্টদের ‘সবুজ সংকেত’ দেয়া হয়েছে। তবে কেউ যদি এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোনো ধরনের সহিংসতার সৃষ্টি করে, সেক্ষেত্রে তা কঠোর হস্তে দমন করা হবে। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নীতি-নির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীনদের ‘উদারনীতি’র অংশ হিসেবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দুই বছর পূর্তিতে রাজধানীতে একই সময়ে দুই দলই নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করেছে। পাশাপাশি গ্রেফতার হওয়া বিএনপির নেতাকর্মীদের জামিনে তীব্র বিরোধিতায় একরকম নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তারা।
এরই মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতাকর্মী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এছাড়া স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য এমকে আনোয়ার এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলায় জামিন পেয়েছেন। তিনিসহ বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর জামিনের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন।
বিরোধী দলের সহাবস্থানের রাজনীতির এ ধারা অব্যাহত রাখতে আরও ছাড় দিতে প্রস্তুত ক্ষমতাসীনরা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণকে খুবই ইতিবাচক বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা।
তারা মনে করছেন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের দুই নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের কলংকের দায় থেকে মুক্তি দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। কারণ সর্বশেষ পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কোনো প্রশ্নই তোলেনি যুক্তরাষ্ট্রসহ বহির্বিশ্বের কেউ। যা সরকারের জন্য একটি বড় অর্জন। কারণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট চলাকালেই বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। কিন্তু পৌর নির্বাচনে সেটি হয়নি।
নির্বাচনের একদিন পর কারচুপির অভিযোগ এনে তারা ফল প্রত্যাখ্যান করে। তবে বিএনপির দাবি এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা রাজনৈতিকভাবে জয়ী হয়েছে। বিএনপির এমন মনোভাবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে সরকার। আগামী মার্চে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও যাতে বিএনপি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে পারে সেলক্ষ্যে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে যাবতীয় পদক্ষেপ।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি এখন ইতিবাচক রাজনীতি করছে। জ্বালাও-পোড়াও চালিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে। তারা যদি এসব বাদ দিয়ে ইতিবাচক ধারায় রাজনীতি করতে চায়, তাহলে সরকার সহযোগিতা করবে।
বিএনপির প্রতি এই উদার মনোভাব সরকারের নতুন কৌশল কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাচ্ছি। তারা জ্বালাও-পোড়াও বাদ দিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকারের সমালোচনা করতেই পারে। সেটা গণতন্ত্রের জন্য ভালো।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, বিএনপিকে মাঠে রাখার জন্য নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে, ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য হবে বিএনপি। এতে ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কোনো সমস্যা হবে না। কারণ বিপর্যস্ত নেতৃত্বে পর্যুদস্ত বিএনপি এ মুহূর্তে একটির পর একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে জনবিচ্ছিন্ন।
গত বছর ৫ জানুয়ারি শুরু হওয়া তিন মাসের অবরোধে সহিংসতা চালিয়ে জনসমর্থন হারিয়েছে দলটি। আর এসব কারণেই পৌর নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবি হয়েছে বিএনপির মেয়র প্রার্থীদের। সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের আস্থা হারিয়েছে বিএনপি, যা সহসাই ফিরে আসবে না বলে মনে করছেন তারা।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সড়ক পরিবহন এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকায় সরকারের কোনো উদ্দেশ্য নেই। সরকারের এই প্রভাবশালী নীতিনির্ধারক বলেন, আমরা অলওয়েজ পজিটিভ। তারা নেগেটিভ আচরণ করলে সরকারও নেগেটিভ হবে।
তবে আমরা মনে করি বিএনপি একটা বড় রাজনৈতিক দল। তারা জ্বালাও-পোড়াও বাদ দিয়ে ইতিবাচক ধারায় থাকলে গণতন্ত্র শক্ত অবস্থানে দাঁড়াবে। ওবায়দুল কাদের আশা প্রকাশ করেন, সিটি ও পৌর নির্বাচনের মতোই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের একজন জানিয়েছেন, আগামী মার্চ থেকে পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শুরু হবে। তারা আশা করছেন এ নির্বাচনেও অংশ নেবে বিএনপি। যদি তাই হয়, তাহলে বিএনপিকে ব্যস্ত রাখতে তারা ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। তাদের লক্ষ্য রাজপথের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে সহিংসতা থেকে দূরে রাখা।
এর ফলে খুব দ্রুতই সরকারের দুই আমলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জনগণের কাছে দৃশ্যমান হবে। সেক্ষেত্রে সরকারের প্রতি আস্থা ও সমর্থন বাড়বে জনগণের। নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, সরকারের বাকি সময়টা নির্বাচনমুখী রাখতে পারলে বিএনপির আন্দোলন বা কোনো কর্মসূচি সফল হবে না, আর রাজপথে ব্যর্থ হলে বিদ্যমান ব্যবস্থাতেই তারা সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে এটা এখন স্পষ্ট যে, দেশকে অস্থিতিশীল করতে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটাতে গত বছর জানুয়ারিতে শুরু হওয়া টানা তিন মাসের অবরোধে সহিংসতা এবং পরবর্তী সময়ে সারা দেশে গুপ্তহত্যা চালিয়েছে বিএনপি ও জামায়াত। এসব সহিংসতা চালাতে গিয়ে মামলা ও গ্রেফতারে দলটির নেতাকর্মীরা এখন ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত। অন্যদিকে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে জামায়াত।
সহসাই দলটিকে নিষিদ্ধ করা হলে তাদের মেরুদণ্ড পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। ততদিন নাগাদ স্বাধীনতাবিরোধী দলটির শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায়ও কার্যকর হবে। সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির আস্থার পাশাপাশি সমর্থন পুরোটাই ঘরে তুলতে পারবে আওয়ামী লীগ, যা দিয়ে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া কঠিন হবে না বলে মনে করেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। - যুগান্তর
১৭ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি