তৈমুর ফারুক তুষার : পৌরসভা নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের মদদদাতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে আওয়ামী লীগ। আগামী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের আগেই পৌরসভায় দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারীরা শাস্তি পেতে যাচ্ছেন। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি জেলা কমিটি থেকে লিখিত অভিযোগ গ্রহণ করেছেন কেন্দ্রীয় সাত সাংগঠনিক সম্পাদক।
আওয়ামী লীগের পরবর্তী কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে অভিযুক্তদের বহিষ্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতা জানান, সামনে আরো ৮৭টি পৌরসভা ও সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহের ঢল ঠেকাতে আর সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থেই এমন কঠোর সিদ্ধান্ত।
আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগেই পৌরসভায় বিদ্রোহী ও তাদের পক্ষে ছিলেন এমন নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়। ৯ জানুয়ারি দলের সর্বশেষ বৈঠকে বিদ্রোহীদের কেন বহিষ্কার করা হবে না সে বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো ও যারা বিদ্রোহীদের পক্ষে কাজ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়।
সাত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা এ অভিযোগের তদন্ত করছেন। এরই মধ্যে মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার/পৌরসভা মনোনয়ন বোর্ডের এক সভায় সাত সাংগঠনিক সম্পাদককে দ্রুত কাজ শেষ করার তাগাদা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বৈঠকে আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগেই পৌর নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দেশব্যাপী নেতাকর্মীদের একটি কঠোর বার্তা দেওয়া প্রয়োজন বলে মত দেন একাধিক নেতা।
এদিকে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন এমন কয়েকটি জেলার নেতারা জানান, তারা জেলা কমিটির পক্ষে শিগগিরই কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের হাতে লিখিত অভিযোগ তুলে দেবেন। এসব অভিযোগপত্রে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকছে।
পৌরসভায় দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। জবাবে তারা কেন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন সে বিষয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন। জবাব সন্তোষজনক না হলে তাদের বহিষ্কার করা হবে।’
কাজী জাফর উল্যাহ আরো বলেন, ‘কার্যনির্বাহী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে কয়েকজন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও জেলা-উপজেলার নেতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ কেন্দ্রের কাছে এসেছে। সে অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য সাত বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা তদন্ত করছেন, যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়, তাহলে তাদের আগামী মাসের মধ্যেই বহিষ্কার করা হবে। আর বহিষ্কার করা হলে সংশ্লিষ্টরা সংসদ সদস্য পদ হারাবেন।’
মঙ্গলবার গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার/পৌরসভা মনোনয়ন বোর্ডের এক সভায়ও পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান বোর্ডের সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ফারুক খান। তিনি বলেন, ‘মনোনয়ন বোর্ডের সভায় তদন্ত কমিটিকে কাজ ত্বরান্বিত করতে বলা হয়েছে। আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগেই একটি ফল দেখাতে হবে, যাতে বিদ্রোহীদের বিষয়ে আমাদের কঠোর অবস্থান পরিষ্কার হয়।’
বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রসঙ্গে ফারুক খান জানান, সাত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা তথ্য সংগ্রহ করছেন। পরে তারা একটি লিখিত অভিযোগ কেন্দ্রের কাছে জমা দেবেন। এতে কারা বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন, কারা তাঁদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছেন, কারা পর্দার পেছনে ছিলেন—এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেবে। দোষী ব্যক্তি দলের এমপি, মন্ত্রী, বড় নেতা যাই হন না কেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, তদন্তের দায়িত্বে থাকা সাত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা গুরুত্বের সঙ্গে বিদ্রোহে মদদদাতাদের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করছেন। বেশির ভাগ সাংগঠনিক সম্পাদক জেলা কমিটিকে লিখিত অভিযোগ জানাতে বলেছেন।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরাসরি দল সমর্থিত প্রার্থীদের কাছ থেকেও অভিযোগ ও প্রমাণ নেওয়া হচ্ছে। আর অভিযোগ আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে সাংগঠনিক সম্পাদকরা নির্বাচনকালীন তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতাও কাজে লাগাচ্ছেন। কারণ সাত বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকরাই নির্বাচনের আগে বিদ্রোহীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করেছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, ‘কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী পৌর নির্বাচনে বিদ্রোহীদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করছি। কারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে বিদ্রোহী ছিলেন, আর এসব প্রার্থীর পক্ষে কারা কাজ করেছেন তা লিখিতভাবে জানাতে জেলা কমিটিগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছি। বেশ কয়েকটি জেলা কমিটি লিখিত অভিযোগ পাঠিয়েও দিয়েছে। সবগুলো জেলা থেকে অভিযোগ হাতে আসলে কেন্দ্রের কাছে একটি তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করব।’
বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমরা তদন্ত শুরু করেছি। আশা করি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির আগামী বৈঠকের আগেই এ কাজ শেষ করতে পারব। জেলা কমিটিগুলো এ বিষয়ে খুবই আন্তরিক। দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আমরা সকলেই একমত আছি। যারা সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, ৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকেই বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাঁদের মদদদাতা কয়েকজন সংসদ সদস্যকে বহিষ্কারের দাবি তোলেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমসহ একাধিক নেতা। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বহিষ্কারের আগে অভিযুক্ত সংসদ সদস্য ও স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করা উচিত বলে মত দেন। পরে অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব পান সাত সাংগঠনিক সম্পাদক।
জেলা থেকে লিখিত অভিযোগ আসছে কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাত বিভাগের অনেকগুলো জেলায় বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদদ দেওয়ার লিখিত অভিযোগ কেন্দ্রের কাছে পাঠাবে জেলা কমিটি। বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল এমন কয়েকটি জেলার নেতারা পৌর নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে নিজেদের উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মঈনুদ্দিন মণ্ডল বলেন, ‘বিদ্রোহীদের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পাঠাতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২৫ জানুয়ারি জেলা কমিটির বৈঠকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ চূড়ান্ত করে কেন্দ্রের কাছে পাঠাব। এর আগে শিবগঞ্জ উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থীকে মদদ দেওয়ার প্রমাণ পাওয়ায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রাব্বানীকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়ে সে প্রস্তাব কেন্দ্রে পাঠায় জেলা কমিটি। আমরা এ সিদ্ধান্তে এখনো অটল আছি। আমরা আবার আমাদের এ সিদ্ধান্ত রেজুলেশন আকারে কেন্দ্রে পাঠাব। দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’
ময়মনসিংহ জেলার পাঁচটি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল। এ জেলার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন সরকার বলেন, ‘বিদ্রোহী ও তাদের মদদদাতাদের বিরুদ্ধে এখনো সবগুলো উপজেলা কমিটির রিপোর্ট হাতে এসে পৌঁছেনি। আশা করি তিন-চর দিনের মধ্যেই তা চলে আসবে। রিপোর্ট পাওয়ার পরপরই আমি তা ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদককে হাতে হাতে পৌঁছে দেব।’
নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তির বিরুদ্ধে কালিয়া পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থীকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ কেন্দ্রকে জানিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ। জানতে চাইলে নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বোস বলেন, ‘এখানে বিদ্রোহীদের যারা মদদ দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ কেন্দ্রীয় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদককে জানিয়েছি। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরে এ অভিযোগ পাঠানো হয়েছে।’
যশোর জেলার পাঁচটি পৌরসভায়ই বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল। তাদের মধ্যে চারজনের পক্ষে প্রকাশ্যে নামেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। নৌকা প্রতীকবিরোধী এ কাজে তিনি প্রশাসনকেও ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ আছে। তার এ কর্মকাণ্ড বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ চলছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলায় চুয়াডাঙ্গা ও জীবনগর পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেন। চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, জেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা বিদ্রোহীদের পেছনে থেকে মদদ দেন। জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলী আহমেদ চুয়াডাঙ্গা পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য এবং জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক আলী আজগর টগরের অনুসারীরা জীবননগর পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করেছেন। জীবননগরে বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভের পর সংসদ সদস্য টগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফুলের মালা বিনিময় করেন। এসব বিষয় দল সমর্থিত প্রার্থীরা ও জেলার একাধিক নেতা কেন্দ্রকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন।
২১ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি