শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৬, ০১:৩৮:০৪

কী করতে চায় এরশাদের জাতীয় পার্টি

কী করতে চায় এরশাদের জাতীয় পার্টি

বেলায়েত হোসাইন : হঠাৎ রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে। অনেকটা  নতজানু হয়ে থাকা এরশাদ আচমকা সাহসী দুই সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাই জিএম কাদেরকে নিজের উত্তরসূরি ঘোষণার সঙ্গে দলের মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনলেন।

তার এ হঠাৎ সিদ্ধান্তে প্রথমে নড়েচড়ে বসেছিলেন দলীয় পরিচয়ে মন্ত্রী এমপি হওয়া নেতারা। কিন্তু এরশাদের দৃঢ়তায় তারা শেষতক এরশাদের প্রতিই আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। মেনে নিয়েছেন তার সিদ্ধান্ত। দলের হঠাৎ এই পরিবর্তন ও মেরূকরণকে ইঙ্গিতপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

অনেকে বলছেন, রাজনীতির নয়া হিসেব থেকেই এরশাদ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এটি বুঝতে পেরেই তার বিরোধীরাও তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আসলে এরশাদ এখন কি করতে চাইছেন। নতুন প্রেক্ষাপটে কি অবস্থান হবে জাতীয় পার্টির। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন দলের নেতাকর্মীরাও।

নতুন দায়িত্ব পাওয়া নেতারাও বলছেন, দলীয় রাজনীতিতে পরিবর্তনের জন্য তারা কাজ করছেন। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলের অবস্থান কি হবে এটি নিয়েও পর্যালোচনা হচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে এক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসবে।

জাপা সূত্র বলছে, এই মুহূর্তে সরকারের জন্য বিব্রতকর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় না দলটি। মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ ও সরকারবিরোধী কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতেও এই মুহূর্তে রাজি নন নেতারা। সারা দেশের তৃণমূলপর্যায়ে সংগঠন শক্তিশালী করার মনোনিবেশ করাই এখন দলটির মুখ্য উদ্দেশ্য।

যদিও জাপার নব নির্বাচিত কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের মনে করেন, যত তাড়াতাড়ি সরকার থেকে বেরিয়ে আসা যায়, পার্টির জন্য তত বেশি মঙ্গল। জাপা সূত্র বলছে, সারা দেশে ৭৬টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ৩০টি জেলায় জাতীয় পার্টির সংগঠন রয়েছে। বাকি জেলাগুলো জাতীয় পার্টি কমিটি একেবারেই নিষ্ক্রিয়।

এ ছাড়া ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে দলের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরাও প্রাণহীন। এই অবস্থায় করণীয় ঠিক করতে নবনির্বাচিত কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন। গতকাল সকালে দলটির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের বারিধারাস্থ বাসভবন প্রেসিডেন্ট পার্কে দীর্ঘ বৈঠক শেষে জিএম কাদের বনানীর কার্যালয়ে আসেন।

সেখানে মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিনি। দলীয় সূত্র বলছে, আগামী ৩০শে জানুয়ারি রাজধানীতে একটি যৌথ সভার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেখানে প্রতিটি জেলার সভাপতি ও সেক্রেটারিকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। এ ছাড়া দলের কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত থাকবেন ওই সভাতে। মূলত সেখান থেকেই আগামী দিনের করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

দলীয় সূত্র বলছে, কমিটিহীন ৪৬টি জেলার কাউন্সিলও খুব শিগগির শেষ করা হবে। যেহেতু আগামী এপ্রিল মাসে কেন্দ্রীয় সম্মেলন, তাই এপ্রিলের আগেই জেলাগুলোর কাউন্সিল শেষ করা হবে। এজন্য দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিভিন্ন জেলার দায়িত্ব দেয়া হবে। একই দিনে আলাদাভাবে কয়েকটি জেলার সম্মেলন একসঙ্গে শেষ করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দলের পক্ষ থেকে।

দলটির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, সাংগঠনিক সমস্যাকে আমি সমস্যা মনে করি না। মূলত, রাজনীতিহীনতার কারণেই সাংগঠনিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তাই আগে দলের রাজনৈতিক অবস্থান সুস্পষ্ট করতে হবে। কারণ আমাদের রাজনীতি নিয়ে জনগণের প্রশ্ন রয়েছে। জনগণের চাহিদার আলোকে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। তাহলে সাংগঠনিক শক্তি ফিরে আসবে।

তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে জাতীয় পার্টির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো- একতার অভাব। দীর্ঘদিন থেকে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করার একটা সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে। যেটা আগে ছিল না। আমরা সেটাকে এক করার চেষ্টা করছি। যদি কেউ দলের সিদ্ধান্ত বাইরে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায়, তাহলে নিতেই পারে। কেউ যদি দল থেকে বেরিয়ে যায়ও, এ নিয়ে দলে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। কারণ, তারা ব্র্যাকেটবন্দি হয়ে থাকবে। এটা আগেও হয়েছে। এখনও হতে পারে। কিন্তু এরশাদ মানেই জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি এরশাদের আদর্শ ঘিরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা যত তাড়াতাড়ি করা যায়, ততই পার্টির জন্য মঙ্গল। কারণ, এভাবে থাকলে বিরোধী দল হিসেবে আমাদের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাবে। তবে আমরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। নিয়মের ভিতরে থেকে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব, আমরা পদক্ষেপ নেবো। যদিও এই মুহূর্তে ধারাবাহিক রাজনীতি ব্যাহত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

সহজ-সরলভাবে রাজনীতি চলছে না। এ সময় জিএম কাদের দাবি করেন, তার কো-চেয়ারম্যান হওয়ার পেছনে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদেরও সম্মতি ছিল।

এদিকে সামনে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দলীয় অবস্থান নিয়েও নতুন চিন্তা হচ্ছে বলে দলীয় সূত্র দাবি করেছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনে নতুন জোট গঠন বা রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে দলটি। এজন্য আগে থেকেই প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকার আগাম নির্বাচন দিলে এতে দলটির অবস্থান কি হবে সেটি নিয়েও ভাবা হচ্ছে।

এদিকে দ্বিতীয় দিনের মতো মহাসচিব ও কো-চেয়ারম্যানকে নেতাকর্মীরা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। গতকাল দুপুরে তাদেরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, জাতীয় মহিলা পার্টির সহ-সভাপতি শাহাজাদী নাহিনা নুর। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ, শুনীল শুভ রায় ও দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।

এদিকে এরশাদকে তার সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে আনতে এখনও দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রেখেছেন পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও সদ্য বিদায়ী মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। জাপা সূত্র বলছে, সরকারকে তারা বিভিন্নভাবে বার্তা দেয়ার চেষ্টা করছেন। দলীয় সূত্র বলছে দলে নয়া মেরূকরণে এ তিন নেতার গুরুত্ব কমে যাবে বলে নেতাকর্মীরা মনে করছেন। এতে পরবর্তী দলীয় রাজনীতিতে তাদের অবস্থান কি হবে এটিও এখন প্রশ্নের মুখে।

গত রোববার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রংপুর সফরে থাকা অবস্থায় সংবাদ সম্মেলন করে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ছোট ভাই জিএম কাদেরকে তার পরবর্তী উত্তরসূরি ঘোষণা করে তাকে কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়ার কথা জানান।

পরের দিন দলের কিছু নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার ঘোষণা দেন। পরের দিন ঢাকা ফিরে এরশাদ জিয়াউদ্দিন বাবলুকে সরিয়ে দলের মহাসচিব হিসেবে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে নিয়োগ দেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে হঠাৎ এ পরিবর্তনের মাধ্যমে এরশাদ কার্যত নিজের হাতে দলের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন বলে দলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন।   -মানবজমিন

২২ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে