শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৬, ০৪:২৮:২০

ফেসবুকের বন্ধু কি আসল বন্ধু?

ফেসবুকের বন্ধু কি আসল বন্ধু?

আনিসুল হক : আমাদের বন্ধুসংখ্যা কত হতে পারে? যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানী ডানবার বলছেন, আমাদের গড়ে ৫ জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ১৫ জন সেরা, ৫০ জন ভালো এবং ১৫০ জন সাধারণ বন্ধু থাকতে পারে।

এর বাইরে ৫০০ জন থাকতে পারে জানাশোনা, ১ হাজার ৫০০ জন একবার দেখার মানুষ। তাহলে সব মিলিয়ে দাঁড়াল বন্ধু থাকতে পারে ২২০ জন, পরিচিতসহ থাকতে পারে ২ হাজার ২০০ জন। এর বাইরে আর কাউকে ধারণ করা কারও মস্তিষ্কের পক্ষে সম্ভব নয়।

শুনে আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমার যদি একজনও ভালো বন্ধু থাকত!
ঘনিষ্ঠ বন্ধু! পাঁচজন! দীর্ঘশ্বাস! দীর্ঘশ্বাস!
ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের একটা কবিতা আছে—কবি বুদ্ধদেব বসু সেটার অনুবাদ করেছিলেন—‘অচেনা মানুষ’।

‘বলো আমাকে, রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো:
তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নীকে?
পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নী—কিছুই নেই আমার।
তোমার বন্ধুরা?
ওই শব্দের অর্থ আমি কখনো জানিনি।
তোমার দেশ?
জানি না কোন দ্রাঘিমায় তার অবস্থান।
সৌন্দর্য?
পারতাম বটে তাকে ভালবাসতে—দেবী তিনি, অমরা।
কাঞ্চন?
ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন তোমরা ঘৃণা করো ভগবানকে।
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কি ভালবাসো তুমি?
আমি ভালোবাসি মেঘ চলিষ্ণু মেঘ ঐ উঁচুতে ঐ উঁচুতে...
আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল!’

এই কবিতায় কবি বলছেন, তিনি বন্ধুদের ভালোবাসেন না, তিনি ‘বন্ধু’ শব্দের সঠিক অর্থই জানেন না। তাহলে তিনি কী ভালোবাসেন? তিনি ভালোবাসেন মেঘ। চলিষ্ণু মেঘ। আকাশের অনেক উঁচুতে সঞ্চরণশীল আশ্চর্য মেঘদলকে।

আমারও সেই অবস্থাই। এই জীবনে বন্ধু ‘পাইলাম’ না! কাজেই আমি আকাশের মেঘ ভালোবাসি।
পাঁচজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু! একজনই হয় না। আমার তো পাঁচজন শত্রুই নেই। বন্ধু আসবে কোত্থেকে!
এ ব্যাপারেও কবি আল মাহমুদের কবিতাই আমার মনের কথা:
‘আমি সারা শহর একজন সুহৃদ খুঁজে বেড়াচ্ছি
এখন আমার একজন বন্ধু দরকার।’

বন্ধু যে পাইনি, এ জন্য আমিই দায়ী। এর কারণ আমি আত্মত্যাগ করতে জানি না। বন্ধু সেই যে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বন্ধুর সঙ্গলাভের আশায় ত্যাগ করতে জানে। আমি রাত দশটার পর জেগে থাকতে পারি না। এবং ঘুমানোর জন্য বিছানা পাব না, বালিশের বদলে ডিকশনারি মাথার নিচে রাখতে হবে—এই রকম পরিস্থিতি হবে জানতে পারলে সেখানে আমি যাবই না।

এই লোকের বন্ধু হবে কী করে! আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নিক্সন (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন, গণহত্যার জন্য এখন তাকেও দায়ী করা হয়) বলেছিলেন, ‘আমার জন্য এটা প্রকৃতিদত্ত নয় যে আমি একটা দোস্ত-দোস্ত টাইপ ছেলে হব।’ আমিও সেই রকম।

ইয়ার-দোস্ত বলতে যা বোঝায়, আমি সেই রকম নই-ই। আমাকে কেউ তুই বললেই আমি বিরক্ত হই। পরিবারের বাইরে আমাকে ‘তুই’ বলেন, এমন মানুষ খুব কমই আছেন। সুতরাং আমি নিঃসঙ্গ! আমি প্রায় রাষ্ট্রপতির মতো নিঃসঙ্গ।

তাহলে আমার ক্লাসমেটরা? আমার বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ও বড়-ছোট ভাইবোনেরা! আমার সহকর্মীরা? পাড়ায় যাদের সঙ্গে ফুটবল খেলেছি, তারা? তারা ওই ২ হাজার ২০০ জনের মধ্যে পড়বে।

বন্ধুত্ব এক আশ্চর্য সম্পর্ক। নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে প্রকৃতির প্ররোচনা থাকে, আত্মীয়তার মধ্যে স্বার্থ থাকে, কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর কোনো বৈষয়িক লেনদেন থাকে না। কাজেই পরিচিত মানেই বন্ধু নয়। বন্ধু সেই, যে বিপদে তোমাকে ত্যাগ করবে না। সেই যে ইশপের গল্পে ভালুকটি নিশ্বাস বন্ধ করে মরার মতো পড়ে থাকা বন্ধুটিকে বলেছিল, ‘যে বিপদে তোমাকে ছেড়ে গাছে উঠে পড়ে, সে তোমার বন্ধু নয়,’ এটা হলো হাজার কথার এক কথা।

কিন্তু সে রকম বন্ধু কি আমরা পাব? যে ভালুক এলে আমাকে ফেলে রেখে গাছে উঠে পড়বে না! চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বলে সবাই তো পালাবে। (সত্যি কথা বলতে কি, ওই পালানোর দলে সবার আগে থাকব আমি)
কাজেই কেউ আমার বন্ধু কি না জানি না, আমি কারও বন্ধু নই। ‘কারও কেউ নই তো আমি, কেউ আমার নয়, কোনো নাম নেই কো আমার শোনো মহাশয়’।
আহা রে, তোমায় বুঝি কেউ ভালোবাসে না!

এত কথা উঠল ২১ জানুয়ারি প্রথম আলোর বিজ্ঞান প্রযুক্তি পাতায় প্রকাশিত রয়্যাল সোসাইটি ওপেন সায়েন্স সাময়িকীর একটা গবেষণার ফলাফল থেকে। এই যে ফেসবুকে আমাদের হাজার হাজার বন্ধু, এটা কি স্বাভাবিক?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, না, স্বাভাবিক না। ১৫০ বন্ধুর বেশি তোমার মস্তিষ্ক মনেই রাখতে পারবে না।

তাহলে এই যে আমার পাঁচ হাজার বন্ধু, ওরা কারা?

হতাশ হবেন না। ওরা হলো, ভার্চ্যুয়াল বন্ধু। যা থাকার মতো, আসলে যা নেই।
মালয় দ্বীপে এক যে বোকা শেয়ালে,
লাগলে ÿক্ষুধা মুরগি এঁকে দেয়ালে,
আপন মনে চাটতে থাকে খেয়ালে।

এখানে শেয়ালটা বাস্তব, ক্ষুধাটা বাস্তব, তবে মুরগিটা ভার্চ্যুয়াল। আমি এর বেশি কিছু বলব না, আমার লেখা বাচ্চারা পড়ে।

আমাদেরও এখন অনেক বন্ধু। হাজার হাজার। কিন্তু কাজের বন্ধু আছে কি?
ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলে কী সব কমেন্টস যে আসতে থাকে।

ধরা যাক, আমি স্ট্যাটাস দিলাম—‘আজ খুব শীত পড়েছে’, তাহলে তার নিচে কমেন্টস আসবে—
১. শীতের দিনে শীত পড়ব নাকি গরম পড়ব?
২. একটা কম্বল পাঠায় দিয়েন।
৩. ঢাকা শহরে সুরম্য অট্টালিকায় বসে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন কেন, যান উত্তরবঙ্গে, গিয়ে দেখুন মানুষের কষ্ট।
৪. এবার শীতের কথা বললেন, গত সরকারের সময় কোথায় ছিলেন।
৫. shit lagse? : p: p: p
৬. লাইক মি লাইক মি...

কী করবেন? এরাই আপনার বন্ধু। আপনি যেকোনো কারও পেজে যান, সেটা সাকিব আল হাসানই হোন, কিংবা নরেন্দ্র মোদি—দেখবেন, আমাদের রুচি কত খারাপ হতে পারে।
কিন্তু ফেসবুকের বন্ধুরা কি ভালো কিছু করে না? তারা কি ভালো কোনো কাজে লাগে না?

লাগে। ফেসবুকের মাধ্যমে কত মরণাপন্ন রোগী রক্ত পেয়ে বেঁচে যাচ্ছেন। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নির্দোষ বন্দীকে মুক্ত করা গেছে।

ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের ফুটবলার বালিকাদের বাড়িতে পল্লী বিদ্যুৎ নেওয়া গেছে। আবার ফেসবুক দাঙ্গা বাধাচ্ছে। ফেসবুক ভুলিয়ে দিচ্ছে বাস্তবের বন্ধুদের, সামনের বন্ধুকে সময় না দিয়ে চেক ইন দিচ্ছি আমরা—আমার জানি দোস্ত এসেছে কত দিন পর...কিংবা মায়ের কপালে হাত রেখে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিচ্ছি, প্রে ফর মাই মাদার।

কথাটা সেই পুরোনো—ছুরি দিয়ে আপনি চিকিৎসাও করতে পারেন, ডাকাতিও করতে পারেন। কী করবেন সেটা নির্ভর করছে আপনার ওপর।

তারপরও বলব, ফেসবুকে আমরা তো বন্ধুর সংখ্যাই বাড়াচ্ছি, শত্রুর সংখ্যা তো নয়। আমরা তো বন্ধুত্বেরই চর্চা করছি, শত্রুতার তো না। ফেসবুকে লাইক বাটন আছে, ডিসলাইক বাটন নেই। সেটাই বা কম কী! লোকটা তো কাগজ দিয়ে ফুল না বানিয়ে বন্দুকও বানাতে পারত! প্রথম আলো

আনিসুল হক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
২২ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে