শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৬, ০৪:৫৩:২৪

আমরা কি এক সংকটের মুখোমুখি?

আমরা কি এক সংকটের মুখোমুখি?

আনিসুজ্জামান : মাত্র কয়েক দিন আগে আমরা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়লাভের ৪৪ বছর পূর্ণ করলাম। এ ৪৪ বছরে আমাদের সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ করার ইচ্ছে হওয়া এ-সময়ে স্বাভাবিক, কিন্তু তার জন্যে যে-যোগ্যতা ও সময় লাগে, তার কোনোটাই আমার নেই। তাই মোটা দাগে কয়েকটি বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করব, যদিও তার বেশির ভাগই জানা কথা।

জন্মলগ্নে বাংলাদেশকে বিশ্ববিখ্যাত মানুষদের কেউ কেউ অভিহিত করেছিলেন ‘বাস্কেট-কেস’ বলে। এখন একবাক্যে সবাই স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি খুবই শ্লাঘার বিষয়। দেশের মানুষের গড় আয় ও গড় আয়ু দুইই বেড়েছে, শিক্ষা এবং আরো কিছু সামাজিক সূচকে তারা অনেকদূর এগিয়েছে—বিশেষ করে, মেয়েদের শিক্ষা, জীবিকা ও ক্ষমতায়নে।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমি নিয়েও খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ—কেবল খাদ্যশস্যে নয়, তরিতরকারি ও ফলমূলেও। দেরিতে হলেও মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং অপরাধীর শাস্তি দেওয়া যে সম্ভবপর হয়েছে, তাও কৃতিত্বের বিষয়।

ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমানা চিহ্নিত হয়েছে এবং ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের অংশ বৃহৎ এবং ভূমিকা কৃতিত্বপূর্ণ। ব্যর্থতার একটা দিক হচ্ছে, আমাদের গণতন্ত্র নড়বড়ে—শক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত নয়, তবে অনেক উন্নত দেশের মতো সংসদীয় রাজনীতিতে একটা দু-দলীয় ব্যবস্থার বিকাশ দেখা যাচ্ছে।

এই ৪৪ বছরে বাংলাদেশকে বেশ কিছু সংকটের সম্মুখীন হতে হয়। এর প্রথমটা হলো, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা। যাদের নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়, তাদের একজন ছাড়া সবাইকে একই আততায়ীদলের হাতে জীবন দিতে হয়। ওই ব্যতিক্রমী জনটি তখন বঙ্গভবনে ক্ষমতায় বসে কলকাঠি নাড়ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু এবং তার সহকর্মী চারজনকে যে বাংলাদেশ-প্রতিষ্ঠার কারণেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তা বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গেই যখন আমাদের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ পরিত্যক্ত হয় এবং স্বাধীনতালাভের পরিচয়সূচক আরো কিছু নামধাম বদলে ফেলা হয়। এত বড়ো প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা আমাদের দুঃস্বপ্নেও কখনো দেখা দেয়নি।

সংকটের দ্বিতীয় পর্যায় আমরা দেখি দু-দুবার সামরিক শাসনের প্রবর্তনে। প্রথমবার সামরিক শাসনের সুবাদে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ যায়, সংবিধানের প্রস্তাবনার মাথায় বিসমিল্লাহ বসে এবং পাশাপাশি জাতীয়তাবাদের নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের এই নতুন ব্যাখ্যা মুসলিম লীগের প্রবর্তিত এবং পরে বর্জিত বাঙালি মুসলমানের স্বাতন্ত্র্যের ধারণার সঙ্গে অভিন্ন।

বাংলাদেশের যেসব জনগোষ্ঠী বাঙালি নয়, নতুন ব্যাখ্যায় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে তাদের স্থান হলো না, বরঞ্চ সেইসঙ্গে অমুসলমান বাঙালিও বাদ পড়ল। বেসামরিক ভেকধারী দ্বিতীয় সামরিক শাসনকর্তা রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করে দেশের মানুষকে স্পষ্টতই বিভক্ত করে ফেললেন—রাষ্ট্রধর্মের অনুসারীরা যে-শ্রেণির নাগরিক, রাষ্ট্রধর্মের অনুসারী যারা নন—তারা নাগরিক হিসেবে তার নিচের শ্রেণির হয়ে গেলেন।

সামরিক শাসকদের কৃত সাংবিধানিক সংশোধনীতে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যায়। কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, চতুর্থ সংশোধনীর দ্বারা কি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়নি? হ্যাঁ, এর ফলে বদল হয়েছে সংবিধানের গণতন্ত্র-সম্পর্কিত নীতির, কিন্তু বাকি তিনটি নীতি তখন অক্ষুণ্ন ছিল। সামরিক শাসন তো গণতন্ত্রকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেই প্রবর্তিত হয়, তারপর সামরিক আদেশ জারি করে বাকি সব নীতির বদল কিংবা প্রকৃতপক্ষে উচ্ছেদ ঘটে।

উচ্চতম আদালতে পঞ্চম সংশোধনী যে অসাংবিধানিক বিবেচিত হয়েছে, তাতে তাই বিস্ময়ের কিছু নেই। অষ্টম সংশোধনীর রাষ্ট্রধর্মসংক্রান্ত ধারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করার জন্যে উচ্চ আদালতের সামনে কয়েকটি আবেদন পড়ে আছে—আমিও তার একজন আবেদনকারী। আদালত বিবেচনা করলে এই আবেদনও মনজুর হয়ে যেতে পারে, এমন আশা নিয়েই আমরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলাম।

পঞ্চম সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষিত হওয়ার পরে আমাদের সংবিধান আবার সংশোধিত হয়েছে। তাতে আদি সংবিধানের রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিগুলো ফিরে এসেছে, তবে রাষ্ট্রধর্মের বিধান রয়ে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি আর রাষ্ট্রধর্মের বিধান কীভাবে সহাবস্থান করে? বোধহয় সোনার পাথরবাটির নিদর্শন হিসেবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দেশে আরেকটি সংকট দেখা দিয়েছিল। এমন রাজনৈতিক সমস্যার যে সামরিক সমাধান হয় না, অনেক মূল্যে তা আমরা বুঝলাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি এখনো যে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলো না, তার জন্যে আেরা মূল্য দিতে হবে কি না, কে জানে!

অন্যদিকে, সাংবিধানিক যোগবিয়োগের তথা রাষ্ট্রিক কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনের পাশাপাশি, সামাজিক ক্ষেত্রে ঘটছিল সাম্প্রদায়িকতার প্রত্যাবর্তন এবং রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছিল জঙ্গিবাদের উত্থান। এই দুটি বিষয় বর্তমানে যে-রূপ ধারণ করেছে, একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের জন্যে তা কি নতুন সংকট সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, এখন সেটাই ভাববার বিষয়।

দুই.
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতীয় বন্ধুদের কাছে খুব বড়ো মুখ করে বলেছিলাম, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দুটি ব্যাপার আর কখনো ঘটবে না: সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর সামরিক শাসন। আমার ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যে প্রতিপন্ন হয়েছে। কিন্তু যে-কথাটা বলেছিলাম, তা আকাশ থেকে পাওয়া ছিল না।

পাকিস্তান-আমলে শেষবার বলা যায়—১৯৫০ সালের পর সেই প্রথমবার—সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হয় ১৯৬৪ সালে, কিন্তু সেবারে দাঙ্গাকারীর চেয়ে দাঙ্গা-প্রতিরোধকারীর সংখ্যা ছিল বেশি। আপনাদের হয়তো মনে পড়বে ইত্তেফাক, সংবাদ ও পাকিস্তান অবজারভারে প্রথম পৃষ্ঠায় ব্যানার হেডিং দেওয়া আহ্বান: ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ আর ওই শিরোনামের নিচে অভিন্ন সম্পাদকীয়।

রুখে দাঁড়িয়েছিল পূর্ব বাংলা, আক্রান্ত হিন্দু পরিবার রক্ষা করতে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় প্রাণ দিয়েছিলেন আমীর হোসেন চৌধুরী ও জিন্নাত আলী মাস্টার, মুসলিম লীগ নেতা আফতাবউদ্দীন যেমন বরিশালের গ্রামে প্রাণ দিয়েছিলেন ১৯৫০ সালে। বস্তুত পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাব যতই বিকশিত হয়েছে, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ততই দূরীভূত হয়েছে। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মনোভাব আরো দৃঢ় হয়। এই অভিজ্ঞতা থেকেই আমি ১৯৭১-এ অমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হিন্দুকে চিহ্নিত করেছিল ইসলাম ও পাকিস্তানের বিশেষ শত্রু হিসেবে এবং তারা ও তাদের দোসররা হিন্দুর প্রাণহরণের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু নারীর ওপর অত্যাচার এবং হিন্দুর বিষয়সম্পত্তি ও দেবালয়ের ব্যাপক ধ্বংসসাধনে প্রবৃত্ত হয়েছিল। তাদের প্রশ্রয়ে ও প্ররোচনায় বাস্তুত্যাগী হিন্দুর বাড়িঘর দখল করে নেয় প্রতিবেশী মুসলমানেরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাস্তুত্যাগীরা ফিরে এলে কী ঘটেছিল?

এ-বিষয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় একটি কৌতুককর গল্প শুনিয়েছেন। যশোরের মণিরামপুর অঞ্চলে এক বিহারি প্রতিবেশী হিন্দুর বাড়ি দখল করে নেয়। পরিণাম-চিন্তাহীন দখলদার একতলা পাকা বাড়িটিকে তিনতলায় পরিণত করে এবং সে-বাড়িতে প্রথমবার বিদ্যুৎ-সংযোগেরও ব্যবস্থা করে। পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের পরে সে-দখলদারও বাড়ি ফেলে পালিয়ে যায় এবং বাস্তুত্যাগী ভদ্রলোক ফিরে এসে এই বিবর্ধিত সম্পদের মালিক বনে যান। সকলেই এত সৌভাগ্যবান ছিলেন না।

সাধারণত বাস্তুত্যাগীরা ভিটেবাড়ি ফিরে পান বটে, কিন্তু কেউ কেউ যে পাননি, এ কথাও সত্য। এমন অনেক ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কোনো ফল হয়নি। ১৯৭২-৭৩ সালে পুজোর সময়ে কোথাও কোথাও গোলযোগ হয়। সেটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার প্রথম প্রকাশ।

ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার সাংবিধানিক বাধা উঠে গেলে এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াতে শুরু করে, তবে ১৯৯০ সালের আগে তা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেনি। দৈনিক ইনকিলাব তখন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে বলে যে-মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে, তার প্রতিক্রিয়ায় সারাদেশে হিন্দু নির্যাতন শুরু হয়ে যায়।

সরকারি নির্দেশে পরদিন পত্রিকাটি ভ্রান্ত সংবাদ পরিবেশনের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে, তবে অনেকেই বলেন যে, সেদিন ইনকিলাব এত অল্পসংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছিল যে, তার অধিকাংশ পাঠকই জানতে পারেনি যে, আগের দিনের সংবাদটি ছিল অপ্রকৃত। সাম্প্রদায়িক নির্যাতন-প্রতিরোধে সরকারি ভূমিকা ছিল অপ্রতুল এবং নাগরিক সমাজের প্রয়াসও ছিল দুর্বল।

তখন আমরা একটি ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা-প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করেছিলাম বটে, কিন্তু তার ভূমিকা ও প্রভাব ছিল খুবই সীমিত। মিথ্যে সংবাদ-পরিবেশনের জন্যে দৈনিক পত্রিকার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত না হলেও দাঙ্গায় ক্ষয়ক্ষতি ও দাঙ্গা-প্রতিরোধ-প্রয়াসের বিবরণ-সংবলিত গ্রন্থ— চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ডা. দিলীপ দে-সম্পাদিত গ্লানি—কিন্তু সরকার ঠিকই নিষিদ্ধ করে দেন।

১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ যখন সত্যি সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তখন বৃহত্তর পরিসরে একই নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এবারেও প্রশাসন ছিল অনেকটা উদাসীন এবং নাগরিক সমাজের প্রতিরোধ-প্রয়াস যথেষ্ট শক্ত নয়। এ-ধরনের ঘটনা আগে ঘটলে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের যে-স্বতঃস্ফূর্ততা মানুষের মধ্যে দেখা যেত, সেটা যেন কোথাও হারিয়ে গেল।

সাম্প্রদায়িক ঘটনার একটা বড়ো বিস্ফোরণ ঘটে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের অব্যবহিত পরে। নির্মমতা ও ব্যাপকতায় তা পূর্ববর্ণিত ঘটনাগুলোকে ছাড়িয়ে যায়। সেই প্রসূতির কথা আমার বিশেষ করে মনে পড়ে—সদ্য সন্তানের জন্ম দিয়ে তিনি দুহাতে শিশু ও গর্ভনাড়ি ধরে পায়ের আঘাতে ঘরের বেড়া ভেঙে বেরিয়ে ক্ষেতে এসে লুকিয়ে ছিলেন সারা রাত এবং বাঁশের কঞ্চি দিয়ে নিজেই নাড়ি কেটে নিয়েছিলেন। জীবনের মায়ার সঙ্গে সন্তানের মায়া যুক্ত হলে মা বোধহয় বাড়তি শক্তি পেয়ে যায়!

২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। রামুতে বৌদ্ধমন্দিরে আক্রমণ থেকে এর সূচনা ধরতে পারি। প্রথমদিকে দেখি, প্রাণহানি তেমন ঘটেনি যেমন হয়েছে ধর্মস্থানের ওপর আক্রমণ এবং প্রতিমা বা বুদ্ধমূর্তির ওপর হামলা।

২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘু-নির্যাতন ঘটেছে। এবারে বাড়িঘর এবং ব্যক্তির ওপরেও আক্রমণ ঘটেছে। দিনাজপুরে এক আদিবাসী বৃদ্ধা আমার হাত ধরে ব্যাকুল প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বাবা, আমরা কি দেশে থাকতে পারব?’ ঢাকা থেকে গেছি শুনে এবং আমাদের প্রহরায় পুলিশ দেখে তিনি আমাদেরকে ক্ষমতাশালী মানুষ বলে ভুল করেছিলেন।

মুখে বললাম বটে, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয় পারবেন’, কিন্তু নিজের কথাই আমার কাছে ফাঁকা মনে হলো। কে এঁদের রক্ষা করবে, কারা সাহস জোগাবে, নিজের জীবন বিপন্ন করে দুর্বৃত্তদের মুখোমুখি হবে কারা? আমরা ‘রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’ গঠন করেছি, কিন্তু তার কাজ দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হইনি।

আজ এ-নির্যাতন হিন্দু ও বৌদ্ধদের পরে খ্রিষ্টানদের ওপরেও চলছে। একাধিক খ্রিষ্টীয় ধর্মযাজক আক্রমণের শিকার হয়েছেন। শিয়াদের ওপরে পরিকল্পিত আক্রমণ ঘটেছে। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের একটা পালা চলে গেছে আগে, তাদের কেন্দ্র আক্রান্ত হয়েছে, কোরআন শরিফ দগ্ধ হয়েছে, আহমদিয়াদের মসজিদে তালা লাগিয়ে বাইরে ‘উপাসনালয়’ লিখে দেওয়া হয়েছে। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মনে হয়, বাংলাদেশে কেবল ওই দুর্বৃত্তদের অনুমোদিত ধর্মমতই অনুকরণ করে থাকতে হবে, অন্য কোনো ধর্মীয় বা সম্প্রদায়গত ধ্যানধারণা-বিশ্বাসের স্থান এখানে থাকবে না।

যে-অসহনশীলতার চূড়ান্ত প্রকাশ আমরা এসব ঘটনায় দেখি, তারই দালিলিক অভিব্যক্তি দেখি, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবিনামায়। পাকিস্তানে আহমদিয়াদের ধর্মীয় সংখ্যালঘু ঘোষণা করা হয়েছে; হেফাজতও চায়, বাংলাদেশে ‘সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা’ এবং তাদের ‘অপতৎপরতা’ বন্ধ করা।

জিয়াউল হক-প্রবর্তিত ‘ব্লাসফেমি ল’র মতো আইনও তারা চায় বাংলাদেশে। নারীনীতি ও শিক্ষানীতি বাতিল করতে হবে এবং দেশের সর্বত্র ভাস্কর্য অপসারণ করতে হবে। ‘ব্যক্তি ও বাক্স্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারীপুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্জ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা’ও তাদের দাবি। তারা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মধারা বন্ধ করতে চায় এবং ব্লগারদের কঠোর শাস্তি চায়।

বাংলাদেশের এই রূপ যাদের কাম্য, ১৯৭১ সালে তারা কোথায় ছিল, এ-কথা জানতে চাওয়া অস্বাভাবিক নয়। নাস্তিক আখ্যা দিয়ে ব্লগারদের হত্যা, ব্লগারদের প্রকাশক-হত্যা ও হত্যাচেষ্টা, সেইসঙ্গে পির ও মাজারের খাদেম-হত্যার প্রশ্নে আমরা পরে আসব।

যে-দেশ এরা চায়, সে-দেশ বাংলাদেশ নয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের যে-ভাবমূর্তি আমাদের মনে জায়গা করে নিয়েছিল, তার সঙ্গে এদের স্বদেশের ভাবমূর্তির একেবারেই কোনো মিল নেই। তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বদেশ হয়তো বাংলাদেশের সীমানার বাইরে গেলে পাওয়া যাবে, কিন্তু এখানে নয়। এখানে, বাংলাদেশে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্যে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব।

হেফাজতের এসব দাবিনামার আগে কিছুকাল ধরে চলেছে ফতোয়ার অত্যাচার। ফতোয়ার নামে অমানবিক শাস্তি দেওয়া হয়েছে মূলত মেয়েদেরকেই। ফতোয়ায় দণ্ডিত নূরজাহান অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলে দেশবাসীর টনক নড়ে। ফতোয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়।

বিষয়টা শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতে গড়ায়। বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে নিয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ সব ধরনের ফতোয়াকে বেআইনি ঘোষণা করেন। তবে তার পরে ইসলামী ঐক্যজোট নেতা মুফতি আমিনীর দেওয়া এক ফতোয়ায় বলা হয়, ‘যে-দুজন বিচারপতি ফতোয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন, তাঁরা মুরতাদ হয়ে গেছেন।’

জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, ওই দলের আরেকজন নেতা মওলানা ইউসুফসহ ২৫ জন মওলানা, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আমির চরমোনাইয়ের পির মওলানা ফজলুল করিম এবং তাহফিজে হারামাইন পরিষদের সভাপতি মওলানা সিদ্দিকী ফতোয়াদানের শরিয়তভিত্তিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টার কঠোর নিন্দা করেন।

ধর্মের নামে বাংলাদেশের সংবিধানকে অমান্য করার প্রয়াস এবং দেশকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা প্রতিরোধ করতে নাগরিক সমাজ নিশ্চয় নিজেদের কর্তব্য স্থির করবেন।

তিন.
বাংলাদেশের জঙ্গিবাদী কর্মতৎপরতার কথা ২০০১ সাল থেকেই ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায়। এই জঙ্গিবাদের উৎস একদিকে পাকিস্তান, অন্যদিকে মিয়ানমার। আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পাকিস্তান হয়ে বেশ কিছু বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবক সে দেশে যায় এবং স্বদেশে ফিরে এসে এরাই জঙ্গিবাদের প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করে।

২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয় যে, ‘বাংলাদেশ দ্রুত তালেবান রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। সাবেক তালেবান যোদ্ধা বাংলা ভাইয়ের সংগঠন জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমবি) কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রতিরোধ করার নীতি ঘোষণা করে পুরুষদের দাড়ি রাখতে ও মেয়েদের বোরকা পরতে বাধ্য করেছে, পাঁচ হাজার মানুষকে নির্যাতন করেছে এবং বিশ জনকে হত্যা করেছে।’

আমাদের দেশীয় সাংবাদিকেরাও কিন্তু জঙ্গিবাদের কার্যকলাপের খবরাখবর দিচ্ছিলেন মাঝেমধ্যে, তবে সরকার তা অস্বীকার করছিলেন এবং এমন কথাও বলছিলেন যে, জঙ্গিবাদীরা সাংবাদিকদের কল্পনাপ্রসূত। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সত্য আড়াল করা যায়নি।

জঙ্গিবাদীরা নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টে—বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে মুনশিগঞ্জ ছাড়া দেশের সব জেলার ৩৫০টি জায়গায়, তার মধ্যে রাজধানী ঢাকার ৩৪ স্থানে বোমা বিস্ফোরণ করে। তাজা বোমা উদ্ধার হয় ৫০টি, গ্রেপ্তার হয় ৯০ জন।

জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-প্রচারিত প্রচারপত্রে সরকার ও বিরোধী দলকে আহ্বান জানানো হয় সংবিধান বর্জন করে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে। নইলে, হুমকি দেওয়া হয়, সব প্রশাসনিক ও বিচারিক কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে।

জেএমবির শেষরক্ষা অবশ্য হয়নি। তার শীর্ষস্থানীয় নেতারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ২০০৭ সালে তাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে।

তবে জেএমবিই তো বাংলাদেশের একমাত্র জঙ্গিবাদী সংগঠন নয়। বাঙালি সমাজ ও সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ (২০০৫) গ্রন্থ নূহ-উল-আলম লেনিন বাংলাদেশে ১১৪টি জঙ্গিবাদী দলের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। এর সবগুলো সমান সংগঠিত ও সক্রিয় নয়, তবে এদের লক্ষ্য ও কর্মধারার মধ্যে মিল রয়েছে।

গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয়তার সঙ্গে ব্লগারদের হত্যার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যে রাজীব হায়দারকে তার ব্লগের জন্যে হত্যা করা হয় বলে জানা যায়, সে ছিল গণজাগরণ মঞ্চের একজন নেতা। অবশ্য নিহত সব ব্লগার গণজাগরণ মঞ্চে সক্রিয় ছিল না। অনেকে ব্লগে লিখেছেন, কিন্তু অন্যভাবে তৎপর ছিলেন না। ব্লগারদের সাধারণভাবে অভিহিত করা হয়েছে নাস্তিক ও ইসলামবিরোধী বলে।

ইসলামপন্থীদেরও তো ব্লগ আছে। লেখার জবাব লেখায় না দিয়ে সন্ত্রাস কেন, হত্যা কেন? বাংলাদেশে যার যার ধর্মপালনের অধিকার যেমন আছে, তেমনি ধর্ম পালন না করারও অধিকার আছে। ব্লগাররা কারো ধর্মপালনে বাধা দেয়নি। কাজেই যে-সহনশীলতা সভ্যতার ভিত্তি, গণতন্ত্রের ভিত্তি, তাকে বিসর্জন দিয়ে বলপ্রয়োগ কেন? ইসলাম ধর্ম কি আততায়ীদের এই শিক্ষা দিয়েছে?

এখন, দীপনের হত্যাকাণ্ডের পর, দেখা যাচ্ছে, ব্লগারের বই ছাপলেও রেহাই নেই। অর্থাৎ দেশের সংবিধান বাক্স্বাধীনতা, আইনি পেশা-অবলম্বনের যে-নিশ্চয়তা দিয়েছে, তা হরণ করা আততায়ীদের পক্ষে কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা একধরনের জঙ্গলের আইন-অনুসারী।

আবার, আস্তিক হলেও রক্ষা নেই। যারা ব্লগারদের হত্যা করেছে, তাদের হাতেই খুন হয়েছেন একজন পির এবং মাজারের এক খাদেম। কারণ হত্যাকারীরা পিরবাদ পছন্দ করে না, মাজারকেন্দ্রিক কাজকর্ম পৌত্তলিকতার তুল্য বিবেচনা করে।

এ-প্রসঙ্গে যে-প্রশ্নটি মনে জাগে, তা হলো, এই সব জঙ্গিবাদীর সাংগঠনিক কাঠামো এবং অর্থের উৎস ভেঙে দেওয়া ও বন্ধ করা সরকারের পক্ষে সম্ভবপর হবে কি না। সেটাই হতে হবে প্রথম পদক্ষেপ। আমরা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস বন্ধ করতে অগ্রসর হচ্ছি। সে ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস বন্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে পারি না। জঙ্গিবাদীদের অধিকাংশেরই আছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, তাদের অর্থের উৎসও দেশের বাইরে। প্রয়োজনে দেশীয় জঙ্গিবাদ দমন করতে আমরা আন্তর্জাতিক সাহায্যও নিতে পারি। আমাদের মানতে হবে, বাংলাদেশের সামনে এটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

চার.
আমি দুই অধ্যাপকের দুটি উদ্ধৃতি দিয়ে আমার আলোচনা শেষ করতে যাচ্ছি।

প্রথমটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসানুজ্জামানের। ২০০১ সালের ৫ জুনে তিনি কথাগুলো বলেছিলেন, এটি পাওয়া যাবে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বাংলাদেশের তারিখ, দ্বিতীয় খণ্ডে (২০০৮): ‘আল্লাহকে খুশি করার জন্য প্রয়োজনে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে হবে এবং দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার সকল মূর্তি ভেঙে ফেলা হবে।’

দ্বিতীয় উদ্ধৃতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদের, নয়া দিগন্ত পত্রিকার ২৮ নভেম্বর ২০১৫ সংখ্যায় তার কলাম ‘আত্মপক্ষে’ প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বিশ্ব পরিস্থিতি’ থেকে নেওয়া:

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলতে ঠিক কী বুঝতে হবে, সেটা এখনো আমার কাছে স্বচ্ছ নয়।...কার কাছ থেকে কে কীভাবে মুক্ত হয়েছিল, সেটা এখনো হয়ে আছে বিতর্কিত।...বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। আসলে এই পাকবাহিনী ছিল না বাইরে থেকে আসা কোনো বাহিনী।...১৯৭১ সালে শেখ মুজিব ঠিক কী চেয়েছিলেন, সেটা এখনো আমাদের মতো অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়।

এমনসব কথা যিনি বলেন, তিনি ১৯৭১ সালে রাজশাহী ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন কেন, তাই বা কে বুঝবে! যিনি এত কিছু বোঝেন না, তিনি কিন্তু একটি কথা ঠিকই বোঝেন:

এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চেয়ে মুসলিম চেতনা প্রধান হয়ে উঠতে চাচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে।

এটা আশ্চর্যের বিষয় যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে মুসলিম চেতনাকে স্থাপন করতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন না। ১৯৭১ সালে সেটাই তো ছিল পাকিস্তানিদের প্রচারকৌশল। আল্লাহকে খুশি করার জন্যে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাঙার প্রয়োজন যিনি বোধ করেন, তিনিই বা কোন ভিন্নপথে চলেন?

আজ, ৪৪ বছর পরে, আবার যে সেইসব কথার পুনরুক্তি শুনতে হচ্ছে, এ আমাদের দুর্ভাগ্য। জঙ্গিবাদীদের বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থনের পরিচয় এটা। জঙ্গিবাদ শুধু অস্ত্রের খেলা নয়, সঙ্গে অন্য কিছুও আছে। সংকট ঘনীভূত করতে সেসবের প্রয়োজন হয়।

চট্টগ্রামে প্রদত্ত ‘অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারক বক্তৃতা’। সূত্র : প্রথম আলো
২২ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে