শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৬, ০৫:১৬:৪৪

বিএনপিতে নেতৃত্ব নিয়ে বিভাজন ও নানা মেরুকরণ

বিএনপিতে নেতৃত্ব নিয়ে বিভাজন ও নানা মেরুকরণ

হাবিবুর রহমান খান : ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে বিএনপিতে চলছে নানা মেরুকরণ। দলের ভেতর প্রভাব বিস্তারে কেন্দ্রীয় নেতারা গ্রুপ ভারি করার মিশন নিয়ে নেমেছেন। আগামী কাউন্সিলে মহাসচিব ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে এই বিভাজনের।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের পরবর্তী মহাসচিব হচ্ছেন- এটি এতদিন একরকম নিশ্চিতই ছিল। দলের বড় একটি অংশ এখনও মনে করে তিনিই (ফখরুল) হচ্ছেন পরবর্তী মহাসচিব। কিন্তু তাকে খালি মাঠে ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন না তার বিরোধীরা। তাকে ঠেকাতে জোরেশোরে মাঠে নেমেছেন দলের এই অংশটি।

স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামকে সামনে রেখে তারা মাঠে নেমেছেন। নতুন নেতৃত্বে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে দলের মূল নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চলছে নানা অপপ্রচার। সরকারের সঙ্গে আঁতাত রয়েছে- এমন অভিযোগ তুলে কাউকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে।

দল নয়, ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই করা হচ্ছে এসব কর্মপরিকল্পনা। দলের নীতিনির্ধারক ছাড়া অঙ্গসংগঠনের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে এই গ্রুপিং। বিগত সময়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চললেও সম্প্রতি তা প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে তর্কে জড়িয়ে পড়ছেন তাদের কেউ কেউ। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

এদিকে আগামী সপ্তাহে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম- স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকতে পারেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বেশ কয়েকটি কারণে স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠককে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন দলের নেতাকর্মীরা। জাতীয় কাউন্সিলের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা, দলের পুনর্গঠন নিয়ে পরবর্তী করণীয়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয়া এবং জোটের সঙ্গে সম্পর্ক- এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে।

জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে সারা দেশে চলছে দল পুনর্গঠনের কাজ। নিজ সমর্থকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে আনতে অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। দলে আধিপত্য বিস্তারের এই প্রতিযোগিতা আগামীতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে বলে আশংকা তৃণমূল নেতাকর্মীদের।

তারা মনে করেন, নীতিনির্ধারকরা তৃণমূলের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের পছন্দের লোককে দলের মনোনয়ন দিতে চেষ্টা চালাতে পারেন। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, পদ-পদবির জন্য দলে প্রতিযোগিতা রয়েছে কিন্তু কোনো বিরোধ নেই। বিএনপির মতো এত বড় দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, গ্রুপ ভারি করে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়া সম্ভব নয়। দলের প্রতি আনুগত্য এবং নেতাকর্মীদের যার প্রতি আস্থা রয়েছে এমন কাউকেই গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব দেয়া হবে। দলের চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের প্রতি সবার এমন আস্থা ও বিশ্বাস আছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী কাউন্সিলে দলের মহাসচিব কে হবেন তা নিয়ে নতুন করে মেরুকরণ শুরু হয়েছে। পরবর্তী মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারমুক্ত হচ্ছেন, না ওই পদে নতুন কেউ আসছেন তা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে নানা হিসাবনিকাশ। মহাসচিব পদ নিয়ে দলের সিনিয়র নেতারা জড়িয়ে পড়ছেন গ্রুপিংয়ে।

এখন পর্যন্ত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া প্রকাশ্যে কেউ মহাসচিব প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেননি। কয়েক মাস আগে দলের মধ্যে গুঞ্জন উঠে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মহাসচিব হতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। ওই গুঞ্জন আরও ডালপালা মেলতে থাকে যখন দলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্ব গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে দেয়া হয়।

চিকিৎসার জন্য ফখরুল দেশের বাইরে থাকার সময় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কারামুক্তি দিবসের আলোচনা সভার সমন্বয়কের দায়িত্ব পান গয়েশ্বর। এমনকি খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে ঈদুল আজহার দিন গয়েশ্বরের নেতৃত্বে জিয়ার মাজারে শ্রদ্ধা জানানো হয়। হঠাৎ করে গয়েশ্বর দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়ায় ফখরুল সমর্থকরা নানা হিসাব কষতে থাকেন।

সবশেষ ৫ জানুয়ারির জনসভায় সভাপতিত্ব করা নিয়েও খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতেই সিনিয়র নেতারা তর্কে জড়িয়ে পড়েন। সূত্র জানায়, ৪ জানুয়ারি রাতে গুলশান কার্যালয়ে জনসভার প্রস্তুতি নিয়ে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। তাদের কেউ কেউ জনসভায় সভাপতি হিসেবে মহানগর বিএনপি যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী আবুল বাশারের পক্ষে অবস্থান নেন।

অপরদিকে মহানগর আহ্বায়ক কমিটির এক নম্বর সদস্য হওয়ায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে সভাপতিত্ব করার পক্ষে ছিলেন কেউ কেউ। শেষপর্যন্ত গয়েশ্বর চন্দ্রকে সভাপতি করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ হন গয়েশ্বরবিরোধীরা। শুধু সভাপতি নয়, জনসভা পরিচালনা কে করবেন তা নিয়েও বিরোধে জড়িয়ে পড়েন নেতারা।

জনসভা পরিচালনার জন্য যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ এবং মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সাঈদ খান খোকনের নাম চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু সমাবেশের দিন দুপুরে গুলশান কার্যালয়ে ঠিক হওয়া তালিকা থেকে এ দু’জনের নাম বাদ দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু এবং সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। রিজভী ও সাঈদ আব্বাস-গয়েশ্বরপন্থী হিসেবে পরিচিত। অপরদিকে দুদু ও মিলন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের অনুসারী।

সূত্র জানায়, শেষ পর্যন্ত গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মহাসচিব প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে ফখরুলবিরোধীরা চেষ্টা করছেন যে কোনোভাবে তিনি (ফখরুল) যেন মহাসচিব হতে না পারেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামকে সামনে রেখে ফখরুলবিরোধীরা নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছেন। তরিকুলকে মহাসচিব হতে দলের বড় একটি অংশ অনেক দিন থেকে দাবি জানিয়ে এলেও স্বাস্থ্যগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্ব নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না তিনি।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি আবারও তরিকুলের নাম মহাসচিব পদে আলোচনায় উঠে এসেছে। ফখরুলবিরোধীরা এরই মধ্যে তরিকুলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বৈঠকও করেছেন। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকীতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে মাজারে যান তরিকুল। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছেন ফখরুল সমর্থকরা।

যদিও এখন পর্যন্ত তরিকুল সরাসরি মহাসচিব হতে আগ্রহ দেখাননি। তবে দলের হাইকমান্ড চাইলে শেষ পর্যন্ত তরিকুল মহাসচিব হতে সম্মতি জানাতে পারেন। তরিকুল মহাসচিব প্রার্থী হলে মূল লড়াইটা হবে ফখরুলের সঙ্গে।

সূত্র জানায়, দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদ নিয়েও শুরু হয়েছে নানা মেরুকরণ। এই পদের জন্য দলের বর্তমান যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান, রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপনের নাম শোনা যাচ্ছে। দলের গুরুত্বপূর্ণ ওই পদটি পেতে প্রকাশ্যে গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সঙ্গে মোহাম্মদ শাহজাহানের সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে শাহজাহানের সম্পর্ক ভালো। তৃণমূল পুনর্গঠনসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন শাহজাহান।

ফখরুল মহাসচিব আর মোহাম্মদ শাহজাহানকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দেখতে চান এই অংশের নেতাকর্মীরা। অপরদিকে ফখরুলের সঙ্গে রিজভী আহমেদের সম্পর্ক অতীতে ভালো থাকলেও বর্তমানে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।

আব্বাস-গয়েশ্বরের বলয়ের সঙ্গে রিজভীর সুসম্পর্ক রয়েছে। সেক্ষেত্রে এই বলয়ের নেতাকর্মীরা চাচ্ছেন, তরিকুল মহাসচিব ও রিজভী সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব। দুদু বরাবরই ফখরুলের আস্থাভাজন। রিপন নিরপেক্ষ থেকে পদ পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ দুটি পদ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক হতেও নেতারা গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানতে চাইলে বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বিরোধ নেই এটা বলা যাবে না। প্রকাশ্যে না হলেও মানসিক দূরত্ব রয়েছে। আর কাউন্সিলকে সামনে রেখে যে মেরুকরণ হচ্ছে তা উচিত নয়। নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। দলের মধ্যেও আরও গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, নেতা বানানোর জন্য কাউন্সিল হওয়া উচিত নয়। ভবিষ্যতে বিএনপির রাজনীতি কী হবে, দল কীভাবে চলবে, বিগত আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতার মূল্যায়ন তা কাউন্সিলে আলোচনা করে চূড়ান্ত করা উচিত। -যুগান্তর
২২ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে